Source : BBC NEWS
নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দলের তাগাদা ও নানামুখী আলোচনার মধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দেড় বছরের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি সম্ভাব্য সময়সীমার কথা জানিয়েছেন। এরপরই প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশে গণঅভ্যত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত আরেকটি বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না।
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নিতে ‘বাধা আছে, কি নেই’ সম্প্রতি এ নিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদারের বক্তব্য ঘিরে নতুন করে আলোচনা তৈরি হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার রংপুরে এক অনুষ্ঠানে মি. মজুমদার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নিতে তিনি কোনো বাধা দেখছেন না।
মি. মজুমদারের এই বক্তব্যের পরে তার তা প্রত্যাখ্যান করে ওই রাতেই বিবৃতি দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
শনিবার বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহবায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “গণহত্যায় জড়িত আওয়ামী লীগের বিচার হতে হবে তার আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনের প্রশ্নই অপ্রাসঙ্গিক।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতো একই অবস্থান বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আরেকটি প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটিরও।
পরে শুক্রবার রাতে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার তার বক্তব্যের ব্যাখ্যাও দেন।
মি. মজুমদার শনিবার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্য কোনো দলকে বাদ দেয়া কিংবা ভোটে সুযোগ করে দেয়ার কোনো বিষয়, এটা আমাদের প্রস্তাবের বিবেচনার মধ্যেও নাই।”
নির্বাচন সংস্কার কমিশন মনে করছে, বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের যে আইন রয়েছে তাতে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা না হলে কিংবা বিচারিক প্রক্রিয়ায় দলটি দোষী সাব্যস্ত না হলে তাদের ভোটে অংশগ্রহণের একটি সুযোগ রয়েছে।
গত জুলাই অগাস্টে ছাত্রদের আন্দোলনের সময় গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে এরই মধ্যে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “গণহত্যা ও মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। কোনো দলের অপরাধ এখনো আমরা তদন্ত করছি না। ভবিষ্যতে আমাদের কাছে যদি মনে হয় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া উচিত সেটা তখন বলা যাবে।”
এই পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অংশ নেয়ার কতটা সুযোগ রয়েছে সেটি নিয়েও নানা প্রশ্ন দেখা যাচ্ছে।
হঠাৎই আলোচনা যে কারণে
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে রংপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের সাথে বৈঠক করেন কমিশন প্রধান বদিউল আলম মজুমদার।
পরে সাংবাদিকরা মি. মজুমদারের কাছে জানতে চেয়েছিলেন আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না?
জবাবে তিনি বলেছিলেন, “আমরা চাই একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন। যারা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে, কোনো রকম বাধা বিপত্তি তাদেরকে দেয়া হবে না। সে রকম একটা নির্বাচন চাই আমরা।”
এসময় তিনি এটিও বলেন যে “অযোগ্য যদি না হয় তাহলে তারাও (আওয়ামী লীগও) নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে। সেই সুযোগ সবারই থাকা উচিত।”
এই নিয়ে ওই রাতেই মি. মজুমদারের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিবৃতি দেয়।
যেখানে সংগঠনর পক্ষ থেকে বলা হয়, “আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে একাধিক গণহত্যার জন্য দায়ী গোষ্ঠী। এছাড়াও গুম, খুন, বিচার বহির্ভূত হত্যাসহ বিভিন্ন মানবাধিকার বিরোধী কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগ গত ১৬ বছর ধরে জড়িত ছিল। সর্বশেষ জুলাই গণহত্যায় প্রায় দুই হাজার শহীদের প্রাণ এবং ত্রিশ হাজারের অধিক মানুষের অঙ্গহানির করেছে দলটি।”
এতে আরও বলা হয় “যে দলটি বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করেছে, তাদেরকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান জন-আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধাচরণ।”
এই বিবৃতিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান জনাব বদিউল আলম মজুমদারকে তার বক্তৃতা প্রত্যাহার করে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দেয়ার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানায়।
শুক্রবার রাতে মি. মজুমদার নিজের বক্তব্য নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেন ও বিবৃতি দেন।
বিবিসি বাংলাকে মি. মজমুদার বলেন, “কোনো দলকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করা হলে নির্বাচন কমিশন তাদের নিবন্ধন বাতিল করতে পারে। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো দলের নিবন্ধন আছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে নির্বাচন থেকে বাদ দেয়ার সুযোগ আমাদের হাতে নেই।”
‘আগে গণহত্যার বিচার, পরে অন্য প্রশ্ন’
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি তাদের শরীক জোট ১৪ দলীয় জোটের নেতাদের কেউ কেউ এরই মধ্যে গণহত্যার বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন।
গণহত্যার বিভিন্ন মামলায় তাদেরকে হাজির করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যেকোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের বিপক্ষে অবস্থান করে। নির্বাচনসহ যে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের রক্তের অবমূল্যায়ন হবে।”
সংগঠনটির আহবায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “দল হিসেবে আওয়ামী লীগ গণহত্যায় জড়িত। তাদের সাথে ১৪ দলও একই অপরাধে জড়িত। আগে গণহত্যার বিচার হবে, তারপর অন্য প্রশ্ন।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আরেকটি প্লাটফরম জাতীয় নাগরিক কমিটিও এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিচার ও দল হিসেবে সংগঠনের বিচার নিয়ে বিভিন্ন সভা সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে জনমত তৈরি করছে।
এই সংগঠনটি মনে করে এই মুহূর্তে যদি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার না হয় তাহলে ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
দলটির আহবায়ক নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আওয়ামী লীগ নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে। হাজার হাজার ছাত্রদের আহত করা হয়েছে। যারা খুনি তাদের বিচারের আগেই যদি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যান, তাহলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।”
“বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে যদি সব কিছু হয় তাহলে আমাদের অনেক প্রশ্নের সমাধান হয়ে যাবে,” যোগ করেন মি. পাটোয়ারী।
নির্বাচনি আইন কী বলছে?
শুক্রবার রাতে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে যে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছিলেন সেখানে তিনি বলেছিলেন, “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি আইনে এরই মধ্যে অনেক মামলা রজু হয়েছে শেখ হাসিনাসহ অনেক আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের নির্বাচন কার্যক্রম নির্ভর করবে এসব মামলা সুরাহার ওপর।”
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আইনে কেউ দণ্ডিত হলে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিওতে বলা আছে, কেউ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কোনো দল আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে কিংবা নির্বাহী আদেশে কোনো দল নিষিদ্ধ হলে নির্বাচন কমিশন তাদের নিবন্ধন বাতিল করতে পারে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বা যে কোনো দলই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।”
মি. আলীম জানান, এর বাইরেও কোনো দল পরপর দুই বার নির্বাচনে অংশ না নিলে কিংবা দলীয় গঠনতন্ত্রে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু থাকলে সে দলের নিবন্ধন বাতিল করার সুযোগ নির্বাচন কমিশনের আছে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বাচনি ও ফৌজদারি অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে দণ্ডিত ব্যক্তি একসময় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা ফিরে পান। কিন্তু আইসিটি আইনে কেউ অপরাধী সাব্যস্ত হলে তিনি আজীবনের জন্যই নির্বাচনে অযোগ্য হবে।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান বদিউল আলম মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তারা যে সংস্কার প্রস্তাব আনছেন সেখানে আইসিটি আইনের এই ধারা বাদ দেয়ার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই।
ট্রাইব্যুনাল ও আওয়ামী লীগের বিচার
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে গত সাড়ে তিন মাসে প্রায় পৌনে দুইশো অভিযোগ জমা পড়েছে।
এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী, ১৪ দলের শীর্ষ নেতা, সাবেক ও বর্তমান আমলাসহ অনেককেই আসামি করা হয়েছে।
এছাড়াও এই ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগের গত সাড়ে ১৫ বছরের বেশি শাসনামলে গুম–খুনের বিভিন্ন ঘটনায় বেশ কিছু অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে।
এরই মধ্যে এইসব ঘটনায় তদন্ত কাজ শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “এই মুহূর্তে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হওয়ার পর যখন আনুষ্ঠানিকভাবে ফরমাল চার্জ জমা দিবো তারপর আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে। এটা কতদিনে শুরু বা শেষ হবে সেটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব না।”
তবে প্রাথমিকভাবে যে বিচারকার্য শুরু হয়েছে সেখানে আগে ব্যক্তির বিচার কাজ হবে। আওয়ামী লীগ কিংবা কোনো দলের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি চিফ প্রসিকিউটর মি. ইসলাম।
তবে আওয়ামী লীগের বিচার ও নির্বাচন ইস্যুতে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এটা যখন আমাদের জুরিশডিকশনের মধ্যে পড়বে তখনই আমরা এ ব্যাপারে মন্তব্য করবো। আওয়ামী লীগ মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ছিল, অভ্যুত্থানের মুখে তাদের পালিয়ে যেতে হয়েছিল। সেই বাস্তবতায় বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ বা সাধারণ মানুষ নির্ধারণ করবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিবে কি, নিবে না।”