Source : BBC NEWS
কলকাতার আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক-পড়ুয়াকে ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন কলকাতা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রাই। শিয়ালদহ আদালতের বিচারপতি সোমবার তার সাজার মেয়াদ ঘোষণা করবেন।
আইনজীবীরা বলছেন, যেসব ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে মি. রাইকে, তাতে যাবজ্জীবন কারাবাস এবং মৃত্যুদণ্ড – দুই হতে পারে।
শিয়ালদহ আদালতের তিনতলার ২১০ নম্বর ঘরে বিচারপতি অনির্বাণ দাসের এজলাসে দুপুর একটার আগে থেকেই তিলধারণেরও জায়গা ছিল না।
এই ঘরেই গত প্রায় দুই মাস ধরে চলেছে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক পড়ুয়ার ধর্ষণ ও হত্যার মামলা, যেখানে এখনও পর্যন্ত একমাত্র ধৃত – কলকাতা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রাই।
এতদিন অবশ্য এই ঘরে এজলাসে আইনজীবী ও সাক্ষী ছাড়া আর কারও প্রবেশের অনুমতি ছিল না – কারণ বিচারপতির নির্দেশে পুরো মামলার প্রক্রিয়াই চলেছিল ‘ইন ক্যামেরা’, অর্থাৎ গোপনে।
আদালতের বাইরে সকাল থেকেই স্লোগান তুলেছেন নাগরিক আন্দোলনের কর্মীরা।
এরই মধ্যে বেলা একটা নাগাদ কালো প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে নিয়ে আসা হয় ওই ঘটনার মূল এবং একমাত্র অভিযুক্ত সঞ্জয় রাইকে।
সাধারণত যে প্রিজন ভ্যানে বন্দীদের নিয়ে আসা হয়, জাল-ঘেরা জানলা দিয়ে তাদের মুখ কিছুটা হলেও দেখা যায়। কিন্তু সঞ্জয় রাইকে দেখার কোনও সুযোগই ছিল না শনিবার। চারদিকটাই ছিল বদ্ধ। আগে পিছে পুলিশের এসকর্ট। প্রিজন ভ্যান একেবারে আদালতের ভেতরে নিয়ে গিয়ে নামানো হয় সঞ্জয় রাইকে।
এজলাসে হাজির নির্যাতিতার বাবা-মা
যে কলকাতা একাধিকবার সবথেকে নিরাপদ শহরের তকমা পেয়েছে, সেখানকারই ব্যস্ত সরকারি হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় একজন তরুণী চিকিৎসক-পড়ুয়া ধর্ষণের শিকার হয়ে খুন হন গত বছরের নয়ই অগাস্ট। চারদিনের মাথায় কলকাতা হাইকোর্ট ঘটনার তদন্ত-ভার তুলে দেয় কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআইয়ের হাতে।
ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে অভূতপূর্ব নাগরিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল গত বছরের অগাস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত, যে ঘটনার প্রতিবাদে জুনিয়র ডাক্তাররা মাস দুয়েক ধরে ধর্না-অনশন চালিয়েছেন, যার জেরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীকে একাধিকবার আলোচনায় বসতে হয়েছে, এবং মিজ ব্যানার্জীর রাজনৈতিক জীবনে সম্ভবত সবথেকে বড় প্রতিবাদ-আন্দোলন হয়ে উঠেছিল – সব মানুষই অপেক্ষায় ছিলেন কখন শুরু হবে আদালতের রায় ঘোষণা।
অপেক্ষায় ছিলেন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরাও।
আদালত কক্ষে অগুনতি সাংবাদিক, উকিল, পুলিশের ভিড়েই বসেছিলেন এক প্রবীণ দম্পতি – ধর্ষণের শিকার ও খুন হওয়া ওই চিকিৎসক-পড়ুয়ার বাবা আর মা।
বেলা সওয়া দুটো নাগাদ শিয়ালদহ আদালতের বিচারপতি অনির্বাণ দাস আদেশ দেন সঞ্জয় রাইকে এজলাসে নিয়ে আসতে আর ২.৩২ এ রায়দান শেষ হয়ে যায়।
বিচারক ঘোষণা করেন, “সব সাক্ষীকে জেরা করে এবং সিবিআইয়ের তথ্যের ভিত্তিতে যা মনে হচ্ছে, তাতে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। শাস্তি আপনাকে পেতে হবে।”
আদালতে হাজির আইনজীবীরা বলছেন যে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ঠিক আগেই বিচারককে উদ্দেশ্য করে সঞ্জয় রাই বলতে থাকেন যে তাকে ফাঁসানো হচ্ছে। আর দোষী ঘোষণা করার পরে তিনি বলেন, “আমি গরিব, আমি এই কাজ করিনি, যারা করেছে, তাদের কেন ছাড়া হচ্ছে!”
এই সময়ে তাকে জোর করে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
‘বিচারের প্রথম সিঁড়ি পেরলাম’
যে কেন্দ্রীয় সংস্থা তদন্ত করছিল, তাদের আইনজীবী পার্থ সারথি দত্ত পরে জানান, “সিবিআই যে ৬৪, ৬৬, ১০৩ (১এ) ভারতীয় ন্যায় সংহিতা অনুযায়ী চার্জশিট সাবমিট করেছিল এবং চার্জও সেই সেকশানে ফ্রেম হয়েছে এবং অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত হল।
“যেসব ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, তাতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং মৃত্যুদণ্ড – দুটির বিধানই আছে। তবে সোমবার আদালত যেটা মনে করবেন, সেই সাজাই দেবেন,” বলছিলেন মি. দত্ত।
বিচারপতি অনির্বাণ দাস বলেছেন যে সোমবার সাজা ঘোষণার আগে অবশ্য সঞ্জয় রাইয়ের কথা শোনা হবে।
সঞ্জয় রাইকে যেভাবে আদালতে নিয়ে আসা হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
বাইরে তখন তার ফাঁসির দাবিতে স্লোগান উঠছিল।
এর অনেকটা সময় পরে আদালতের বাইরে আসেন ধর্ষণের শিকার ও খুন হওয়া চিকিৎসকের পরিবার-পরিজন।
তার বাবা সংবাদমাধ্যমের সামনে বিচারককে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে বলেন, “বিচারের যে প্রথম সিঁড়ি আজকে পার করেছি এবং তিনি যাতে আবারও দ্বিতীয় সাড়িতে উঠতে পারি, সে ধরনের জাজমেন্ট একটা উনি দেবেন, এই বিশ্বাস আমাদের ছিল এবং তিনি সেটা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। বিচারককে ধন্যবাদ জানানোর ক্ষমতা তো আমাদের নেই, বিচারক যেভাবে আমাদের এই ব্যাপারটাকে দেখেছেন, আমরা তার জন্য খুবই উনার কাছে কৃতজ্ঞ।”
শুধু একজনই কী দোষী?
নির্যাতিতার পরিবার ইতিমধ্যেই সিবিআইয়ের তদন্ত নিয়ে এক গুচ্ছ প্রশ্ন তুলেছেন কলকাতা হাইকোর্টের সামনে। তারা এবং বৃহত্তর নাগরিক সমাজ ও ধর্ষণের শিকার ও নিহত তরুণীর সহপাঠীদের একটা বড় অংশ মনে করে যে একা সঞ্জয় রাই এই অপরাধ করে থাকতে পারে না। আরও অনেকে জড়িত ছিল বলেই তাদের বিশ্বাস।
ওই পরিবারটির অন্যতম আইনজীবী অমর্ত্য দে বলেন, “এখনও সাপ্লিমেন্টারী চার্জশিট দেওয়া হয় নি। আমরা আশাবাদী এবং পরিবারের লোকও আশাবাদী সঠিকভাবে তদন্ত হবে এবং তদন্তে যে বা যারা যুক্ত হয়ে থাক, তাদের নামও সামনে আসবে।”
নাগরিক আন্দোলনের যে কর্মীরা শনিবার আদালতে হাজির হয়েছিলেন, তাদের অন্যতম অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী বললেন, “এটা মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে আসল যে দোষী, তাদের না ধরে একজনকে শিখণ্ডী হিসাবে খাড়া করে রেখে তাকে শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে দেশকে আইনের কথা বলল – যে আমরা বিচার করলাম। একজন এ ধরনের হত্যা করতে পারে না।”
ধর্ষণের শিকার ও খুন হওয়া ওই তরুণীকে চিহ্নিত করা হয় অভয়া এবং তিলোত্তমা নামে।
দিনের শেষে আদালতের সামনে জড়ো হওয়া নাগরিক আন্দোলনের কর্মীরা যখন মিছিল করে ফিরে যাচ্ছেন, সেখানেও শোনা যাচ্ছিল অগাস্ট মাস থেকে যে স্লোগান বারেবারেই শোনা গেছে : “তিলোত্তমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।’
তাদের কথায়, শেষ বিচার তারা ছিনিয়ে আনবেনই।