Source : BBC NEWS

প্লেন

ছবির উৎস, Getty Images

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার বিষয়ে সম্প্রতি আবারও নতুন করে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম এ দ্বীপটি আর্কটিক বা উত্তর মহাসাগরে অবস্থিত। ডেনমার্কের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল এই গ্রিনল্যান্ড।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম মেয়াদে ২০১৯ সালে ট্রাম্প প্রথম গ্রিনল্যান্ড কেনার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়ে ছিলেন।

কিন্তু এই সপ্তাহে অর্থনৈতিক বা সামরিক শক্তির মাধ্যমে গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে অস্বীকার করে তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছেন।

ড্যানিশ এবং ইউরোপীয়ান কর্মকর্তারা এ বিষয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, গ্রিনল্যান্ড বিক্রির জন্য নয় এবং এর আঞ্চলিক অখণ্ডতা অবশ্যই রক্ষা করা হবে।

তাহলে এরকম একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি কিভাবে তৈরি হতে পারে, যেখানে ন্যাটোর দুইটি মিত্র দেশ ৮০ শতাংশ বরফে আচ্ছাদিত কিন্তু বিপুল পরিমাণে অব্যবহৃত খনিজ সম্পদে ভরপুর একটি বিশাল ভূখণ্ড নিয়ে মতবিরোধে লিপ্ত?

তিনশ’ বছর ডেনিশ নিয়ন্ত্রণে থাকা গ্রিনল্যান্ডের ৫৬ হাজার অধিবাসীর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে কিভাবে এটি প্রভাবিত করতে পারে?

এই প্রতিবেদনে গ্রিনল্যান্ডের চারটি সম্ভাবনার কথা তুলে ধরা হয়েছে, যার মাধ্যমে এই পরিস্থিতির সমাপ্তি হতে পারে।

বিবিসি বাংলার অন্যান্য খবর
সাগর

ছবির উৎস, Reuters

ট্রাম্প আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন, কিছুই হবে না

কিছু জল্পনা রয়েছে যে ট্রাম্পের পদক্ষেপ কেবলই তর্জন – গর্জন।

এটি রাশিয়া এবং চীন উভয়েরই এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের হুমকির মুখে গ্রিনল্যান্ডের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য ডেনমার্ককে চাপ দেয়ার একটি পদক্ষেপ।

গত মাসে ডেনমার্ক আর্কটিকের জন্য এক দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলারের একটি নতুন সামরিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।

ট্রাম্পের মন্তব্যের আগেই এটি প্রস্তুত করা হয়েছিল।

কিন্তু এর কয়েক ঘণ্টা পরেই ডেনিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এ ঘোষণাকে ‘ভাগ্যের পরিহাস’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন।

পলিটিকেন সংবাদপত্রের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিবেদক এলিজাবেথ সেভেইন বলেছেন, “ট্রাম্প যা বলেছিলেন তাতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে ডেনমার্ককে আর্কটিকের ওপর তাদের বাধ্যবাধকতা পূরণ করতে হবে অথবা যুক্তরাষ্ট্রকে তা করতে দিতে হবে।”

রয়েল ডেনিশ ডিফেন্স কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মার্ক জ্যাকোবসন বিশ্বাস করেন এটি ট্রাম্পের ” অফিসে (কার্যালয়ে) প্রবেশের আগে নিজের অবস্থান তৈরি করার” মতো একটি ঘটনা।

এদিকে গ্রিনল্যান্ড স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে আরও আন্তর্জাতিক কর্তৃত্ব অর্জনের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছে।

তাই যদি ট্রাম্প এখন গ্রিনল্যান্ডের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন যা অধ্যাপক জ্যাকোবসন মনে করছেন, তাহলে এটাই সবচেয়ে সম্ভাব্য পরিস্থিতি।

তিনি নিশ্চিতভাবেই এই বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছেন।

কিন্তু অনেক বছর ধরেই গ্রিনল্যান্ডের স্বাধীনতার বিষয়টি আলোচনার মধ্যে রয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন এই বিতর্কটি বিপরীত দিকেও যেতে পারে।

“গত কয়েক দিনে আমি লক্ষ্য করেছি গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী তার মন্তব্যে শান্ত, ধীর-স্থির, হ্যাঁ আমরা স্বাধীনতা চাই কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে” বলেন সেভেইন।

গ্রীনল্যাণ্ডের অবস্থান

স্বাধীনতার পক্ষে গ্রিনল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চায়

গ্রিনল্যান্ডে একটি সাধারণ ঐক্যমত্য রয়েছে যে স্বাধীনতা অবশেষে আসবে এবং যদি গ্রিনল্যান্ড এর পক্ষে ভোট দেয়, তাহলে ডেনমার্ক তা গ্রহণ করবে ও অনুমোদন করবে।

তবে গ্রিনল্যান্ড স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেবে এমন সম্ভাবনাও কম।

তবে যদি না এর জনগণকে স্বাস্থ্য সেবা এবং কল্যাণ ব্যবস্থার মতো জিনিসপত্রের জন্য ডেনমার্ক থেকে বর্তমানে যে ভর্তুকি দেয়া হয় তা ধরে রাখার নিশ্চয়তা দেয়া হয়।

ডেনিশ ইন্সটিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের একজন জ্যেষ্ঠ গবেষক উলরিক গ্যাড বিবিসিকে বলেন, ” গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এখন হয়তো উচ্ছ্বসিত, কিন্তু যদি তিনি গণভোট ডাকেন, তাহলে গ্রিনল্যান্ডের অর্থনীতি এবং কল্যাণ ব্যবস্থা কিভাবে বাঁচানো যাবে সে সম্পর্কে তার কিছু বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনার প্রয়োজন হবে।”

পরবর্তী সম্ভাব্য পদক্ষেপ হল একটি মুক্ত সম্পর্ক যা বর্তমানে প্রশান্ত মহাসাগরীয় রাজ্য মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, মাইক্রোনেশিয়া এবং পালাউ এর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে।

গ্রিনল্যান্ড এবং ফ্যারো দ্বীপপুঞ্জ উভয়ের জন্যই ডেনমার্ক আগে এই স্ট্যাটাসের বিরোধীতা করেছিল।

কিন্তু ড. গ্যাডের মতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ম্যাটে ফ্রেডেরিকসেন স্পষ্টতই এর বিরুদ্ধে নন।

“গ্রিনল্যান্ডের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড্যানিশদের ধারণা ২০ বছর আগের তুলনায় অনেক ভালো” বলে তিনি জানান, ডেনমার্ক ঐতিহাসিক দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।

সাম্প্রতিক এই আলোচনা ” ফ্রেডেরিকসেনকে বলতে রাজী করাতে পারে ডেনমার্ককে আর্কটিকের মধ্যে রাখাই ভালো, গ্রিনল্যান্ডের সাথে কিছু সম্পর্ক রাখা যায় যদি এটি আরও দুর্বলও হয়” বলেন ড. গ্যাড।

সাম্প্রতিক সময়ে এটা পরিষ্কার হয়েছে যে গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্ক থেকে মুক্তি পেতে সক্ষম হলেও, যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুক্তি পাবে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দ্বীপটির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর আমেরিকানরা কখনো এই দ্বীপ ছেড়ে যায় নি এবং তাদের নিরাপত্তার জন্য এই দ্বীপটিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে।

১৯৫১ সালের এক চুক্তিতে দ্বীপটির মৌলিক সার্বভৌমত্ব ডেনমার্কের প্রতি নিশ্চিত করা হলেও কার্যত যুক্তরাষ্ট্র যা চায় তাই দিয়েছে।

ড. গ্যাড বলেছেন গ্রিনল্যান্ডের কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনের ভূমিকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিগত দুইটি প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ রেখেছিলেন।

” তারা এখন জানে যে যুক্তরাষ্ট্র কখনো দ্বীপটি ছেড়ে যাবে না ” বলেন তিনি।

বিবিসির সব খবর
গ্রিনল্যান্ড

ছবির উৎস, AFP

অর্থনৈতিক চাপ

জল্পনা রয়েছে যে, ট্রাম্পের অর্থনৈতিক বক্তব্য ডেনমার্কের জন্য সম্ভাব্য সবচেয়ে বড় হুমকি।

আমেরিকা ডেনিশ, এমনকি ইইউ’র কিছু পণ্যের উপর ব্যাপকভাবে শুল্ক বৃদ্ধি করছে। এর ফলে ডেনমার্ককে গ্রিনল্যান্ডের উপর কিছু ছাড় দিতেও বাধ্য করছে যুক্তরাষ্ট্র।

অধ্যাপক জ্যাকোবসন বলেছেন, ডেনিশ সরকারগুলো এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং শুধুমাত্র আর্কটিক অঞ্চলের কারণে নয়।

ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সব ধরনের আমদানির ওপর সর্বজনীন ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিচ্ছেন, যা ইউরোপীয় প্রবৃদ্ধিকে উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত করতে পারে।

কিছু ডেনিশ এবং অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো এখন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন ঘাঁটি স্থাপনের কথা বিবেচনা করছে।

আন্তর্জাতিক আইন সংস্থা পিলসবারির বেঞ্জামিন কোট মার্কেট ওয়াচ ওয়েবসাইটকে বলেছেন, শুল্ক বাড়ানোর সম্ভাব্য বিকল্পগুলির মধ্যে রয়েছে ১৯৭৭ সালের আন্তর্জাতিক জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতা আইন (আইইইপিএ) প্রয়োগ করা।

এর ফলে প্রভাবিত হতে পারে এমন প্রধান ডেনিশ শিল্পগুলির মধ্যে একটি হলো ওষুধ।

যুক্তরাষ্ট্র ডেনমার্ক থেকে শ্রবণ যন্ত্র এবং ইনসুলিনের মতো বেশিরভাগ পণ্য গ্রহণ করে। একইসাথে ডেনিশ কোম্পানি নভো নরডিস্ক তৈরি করে ডায়াবেটিসের ওষুধ ওজেম্পিক।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পদক্ষেপের ফলে যে মূল্য বৃদ্ধি হবে তা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের অনুকূলে হবে না।

ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ড আক্রমণ করতে পারেন

“পারমাণবিক বিকল্প” অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু ট্রাম্পের সামরিক পদক্ষেপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিলেও একেবারে বাতিল বলেও মনে করা যায় না।

মূলত, গ্রিনল্যান্ডে ইতোমধ্যেই ঘাঁটি এবং প্রচুর সৈন্য থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়া কঠিন হবে না।

অধ্যাপক জ্যাকোবসেনের মতে, “যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই কার্যত নিয়ন্ত্রণে আছে”।

তিনি আরও যোগ করেন যে ট্রাম্পের মন্তব্য অজ্ঞতাপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে এবং তিনি এর অর্থ বুঝতে পারেননি।

তা সত্ত্বেও, ওয়াশিংটনের যে কোনো সামরিক শক্তির ব্যবহার একটি আন্তর্জাতিক ঘটনা তৈরি করবে।

“যদি তারা গ্রিনল্যান্ড আক্রমণ করে, তাহলে তারা নেটোকেই আক্রমণ করে” বলেন সেভেইনি।

“তাই এটি সেখানেই থেমে যাবে। অনুচ্ছেদ পাঁচ কার্যকর করতে হবে। যদি কোনও নেটো দেশ নেটো আক্রমণ করে, তার মানে হলো, সেখানে আসলে কোনও নেটো নেই” বলেন তিনি।

ডঃ গ্যাড বলেন, ট্রাম্পের কথা শুনে মনে হচ্ছে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং তাইওয়ান সম্পর্কে কথা বলছেন বা রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন সম্পর্কে কথা বলছেন।

“তিনি বলছেন যে আমাদের এই জমি দখল করা বৈধ” বলেন মি. গ্যাড।

“আমরা যদি তাকে সত্যিই গুরুত্ব দেই, তাহলে এটি সমগ্র পশ্চিমা জোটের জন্য একটি অশুভ লক্ষণ” বলেন মি. গ্যাড।