Source : BBC NEWS

ছবির উৎস, Getty Images
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল বা এনসিটির ব্যবস্থাপনা বিদেশি কোম্পানিকে দেয়া হবে কি-না তার পক্ষ-বিপক্ষে বিতর্ক আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। অনেকে এ ধরনের সম্ভাব্য সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, প্রতিবাদ করছেন।
বিগত আওয়ামী লীগ আমলে এই টার্মিনাল ব্যবস্থাপনার দুবাইভিত্তিক একটি বিদেশি কোম্পানিকে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে দেয়ার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো, সেটিই এখন অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আবার গতি পেয়েছে-এমন খবরে অনেকেই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন।
যদিও পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় জানিয়েছে, এ নিয়ে একটি সমীক্ষা এখন চলছে।
“নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালটি পিপিপি পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ চলমান রয়েছে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় প্রাপ্ত সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে,” লিখিত জবাবে সংস্থাটি জানিয়েছে।
অন্যদিকে সরকারের নৌ পরিবহন উপদেষ্টা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অবসরপ্রাপ্ত) বলেছেন, বিদেশি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয়ার বিষয়টি সরকার নেতিবাচকভাবে দেখছে না।
“তবে সব অংশীজনের সাথে আলোচনা করেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। বিদেশি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয়া হলেও তাতে বন্দরের কারও চাকরি কিংবা এ সংক্রান্ত কোনো সমস্যা হবে না,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।
এদিকে যারা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন তাদের বক্তব্য হলো- নিউমুরিং টার্মিনালটি সুপার স্ট্রাকচার সমৃদ্ধ একটি আন্তর্জাতিকমানের টার্মিনাল এবং এটি সক্ষমতার চেয়ে বেশি সেবা দিতে সক্ষম হয়েছে গত বছরেও। আবার এটি সম্প্রসারণেরও সুযোগ নেই। ফলে এই টার্মিনালে আর নতুন করে বিনিয়োগের কোনো সুযোগই নেই বলে তারা মনে করেন।

ছবির উৎস, CA PRESS WING
সত্যিই দেয়া হচ্ছে বিদেশি কোম্পানিকে?
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাম্প্রতিক সময়ে বন্দর নিয়ে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তা থেকে অনেকেই ইঙ্গিত পাচ্ছেন যে নিউমুরিং টার্মিনালের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিদেশি প্রতিষ্ঠানকেই দেয়া হচ্ছে।
বন্দরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে যে ধারণা পাওয়া গেছে তাতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) ডিপি ওয়ার্ল্ড নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে সরকারি–বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে জিটুজি ভিত্তিতে টার্মিনালটি পরিচালনার ভার দেয়া হতে পারে।
গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই তাদের এ টার্মিনাল দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো। কিন্তু কয়েক বছরেও সেটি তারা চূড়ান্ত করতে পারেনি।
এখন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই প্রতিষ্ঠানটির সাথে আলোচনা আবার গতি পেয়েছে।
আবার এ টার্মিনালকে নিয়ে আলোচনা বেশি হওয়ার মূল কারণ হলো এটি চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি টার্মিনালের মধ্যে সবচেয়ে বড়, যাতে এক সাথে চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ ভিড়তে পারে। আবার এর সাথে স্বয়ংক্রিয় ক্রেন থাকায় দ্রুতগতিতে কন্টেইনার ওঠানো ও নামানো যায়।
অন্যদিকে বন্দরের হিসাবে, গত বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তিন লাখ কন্টেইনার বেশি ওঠানামা হয়েছে এই টার্মিনালে।
গত বুধবার চট্টগ্রাম গিয়ে এ টার্মিনাল পরিদর্শন করেছেন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
সেখানে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড হলো চট্টগ্রাম বন্দর। তাহলে যে সাইজের হৃৎপিণ্ড আছে, ওই সাইজে চলে না। এই হৃৎপিণ্ড বিশ্ব সাইজের হৃৎপিণ্ড হতে হবে।”
“কাজেই আমরা বললাম যে পৃথিবীর সেরা বন্দর ব্যবস্থাপক যারা আছে, তাদের ডাকো। দেখলাম যে আগেই ডাকা হয়েছে, কিন্তু কাজটা হচ্ছে না। বারবার সবার কাছে আবেদন করছি– এটা তাড়াতাড়ি করে দাও। যতই দিন যাবে, এই হৃৎপিণ্ডকে আর ওইভাবে স্থাপন করতে পারব না। এটা পরিবর্তন না করে বাংলাদেশে অর্থনীতি পরিবর্তন সম্ভব নয়,” বলেছেন তিনি।

ছবির উৎস, Getty Images
ওই অনুষ্ঠানেই প্রধান উপদেষ্টা জানান যে তিনি নৌপরিবহন উপদেষ্টাকে বলেছেন, “যারা বন্দরের ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ, পৃথিবীর সেরা যারা, তাদের দিয়ে এই কাজ করাতে হবে– যেভাবেই হোক।”
তারও আগে চলতি মাসের শুরুতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছিলেন, বন্দরের দক্ষতা বাড়াতে তারা “বিশ্বের সেরা ও অভিজ্ঞ বন্দর ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলোর” সঙ্গে আলোচনা করছেন।
তিনি বলেছেন, “আমরা সেই কোম্পানিগুলোর সাথে কথা বলছি যাদের পুরো পৃথিবীতে স্ট্যাবলিশড রেকর্ড আছে। কোনো ফালতু কোম্পানি না। যারা ৭০-৮০টা পোর্ট হ্যান্ডেল করছেন, বিভিন্ন মহাদেশে কাজ করছেন, তাদের সাথেই আমরা কথা বলছি। আমরা চাইছি এটা সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ করতে।”
বন্দর কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশি কোনো কোম্পানিকে টার্মিনাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিতে সরকারের নির্বাহী বিভাগ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব হবে পিপিপি কর্তৃপক্ষের। তারা এর মধ্যেই এ নিয়ে কয়েকটি বৈঠক করেছে বলে জানা গেছে।
এসব কারণেই বন্দরের সাথে বিভিন্ন খাতে যারা জড়িত তারা মনে করেন, দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের কাছে টার্মিনাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়ার দিকেই অগ্রসর হচ্ছে সরকার।
বিতর্ক কেন, বিরোধিতা কেন
নিউমুরিং টার্মিনালে অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি এনেছিলো চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। আর টার্মিনালটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে এখন আছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য মো. জাফর আলম বলছেন, বন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অভিজ্ঞ ও দক্ষ বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া এখন বৈশ্বিক ট্রেন্ড বা প্রবণতা।
“কিন্তু যে পোর্টে বা টার্মিনালে কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি, সেখানে বিনিয়োগ হবে যাতে করে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ দিয়ে পোর্ট বা টার্মিনাল তৈরি করতে পারে। এরপর তারা সেটি পরিচালনা করে তাদের বিনিয়োগ তুলে নেবে। কিন্তু নিউমুরিং পুরোদমে চলমান একটি টার্মিনাল। ফলে এখানে তারা কোথায় বিনিয়োগ করবে এবং বন্দরের দক্ষতা কতটা বাড়াবে সেটা জানানো উচিত।”

ছবির উৎস, Getty Images
জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৭০ শতাংশের বেশি কন্টেইনার ঢাকায় আসে এবং এরপর মালামাল রেখে আবার মালামাল নিয়ে কিংবা খালি কন্টেইনার বন্দরে ফিরে যায়।
ফলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজটি দেয়া হলে তারা যেন বন্দরের কানেকটিভিটির আওতায় বন্দর থেকে দিরাশ্রম পর্যন্ত ডেডিকেটেড কন্টেইনার করিডর এবং দিরাশ্রমে একটি আইসিডি বা ডিপো নির্মাণে পর্যাপ্ত অর্থ বিনিয়োগ করে সেটিও নিশ্চিত থাকা উচিত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
“শুধু কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ভালো করলে তো হবে না, জাহাজ থেকে নামানো কন্টেইনার দ্রুত ঢাকায় গিয়ে আবার ফিরে আসা নিশ্চিত করতে হবে,”বলছিলেন মি. আলম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত কোনো বন্দরে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে আনা হয় দুটো কারণে। এর একটি হলো বিনিয়োগ পাওয়া, আর অন্যটি হলো দক্ষতা বৃদ্ধি।
কিন্তু নিউমুরিং টার্মিনালে নতুন করে এসব খাতে বিনিয়োগের সুযোগ যেমন নেই, তেমনি- পাশেই নৌঘাঁটি থাকায় এটি সম্প্রসারণেরও সুযোগ নেই।
অন্যদিকে বে টার্মিনাল ও লালদিয়ার চরে টার্মিনালের কাজ বিদেশিদের দেয়া নিয়ে কেউ আপত্তি করছে না। এর কারণ হলো সেখানে জেটি নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ ও সুপার স্ট্রাকচার আনার সুযোগ আছে।
একই কারণে পতেঙ্গার টার্মিনালের দায়িত্ব সৌদি প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও কোনো কথা ওঠেনি।

ছবির উৎস, Getty Images
বন্দরের জেটি পরিচালনাকারী বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ‘বার্থ অপারেটরস, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরস ও টার্মিনাল অপারেটরস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের’ সভাপতি ফজলে একরাম চৌধুরী বলছেন, সরকার সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন, তবে দেখতে হবে সেটা উইন-উইন হচ্ছে কি-না।
“নিউ মুরিং তো ভালো করছে। লোকসানেও সেই। বন্দর কর্তৃপক্ষও এর মাধ্যমে দক্ষ হয়ে উঠছে। এই ব্যবস্থাপনার সুযোগ বন্দর কর্তৃপক্ষ না পেলে একটা সময় পর যখন বিদেশিরা বন্দর বা টার্মিনাল হস্তান্তর করবে তখন কারা কীভাবে চালাবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
ওদিকে, চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারী কিংবা অপারেটররা অনেকে ইতিমধ্যেই বিদেশিদের হাতে নিউমুরিং না দেয়ার দাবি করেছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিক্ষোভও হয়েছে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যৌথ উদ্যোগে গঠিত ‘দেশ বাঁচাও বন্দর বাঁচাও’ কমিটির সদস্য শাহাদত হোসেন সেলিম বলছেন, এ সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সরে না আসলে তারা শিগগিরই প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।
“৭০০ কোটি টাকা দিয়ে ২০ বছর আগে এই টার্মিনাল করা হয়েছে। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। কেউ বিদেশি অপারেটরের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। এরপরেও যা করা হচ্ছে তা হয় জেদ কিংবা লোকদেখানো। বরং বিদেশি কোম্পানিকে বে টার্মিনাল বা লালদিয়ার চর দিলে তারা সেখানে আধুনিক জেটি গড়ে তুলতে পারবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার ঘোষণার প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় সমাবেশ করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। তারা বলেছে “দেশের টাকায় সবকিছু করে এখন বিদেশিদের হাতে টার্মিনালটি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত রহস্যজনক ও চক্রান্তমূলক”।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, বন্দরের কাজ বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হবে আত্মঘাতী এবং এটি অন্তর্বর্তী সরকারের কাজও হতে পারে না।
“বন্দরে আধুনিক প্রযুক্তি আনা হয়েছে। দেশীয় ব্যবস্থাপনায় এটি লাভজনকও। তাহলে বিদেশি প্রতিষ্ঠান কেন? এর সাথে নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নও আছে। সরকারের উচিত হবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা,” বলছিলেন মি. হক।