Source : BBC NEWS

ছবির উৎস, Getty Images
৩ মিনিট আগে
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনার মাঝে ভারতের চিরাচরিত পররাষ্ট্রনীতি ও রণকৌশলে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পহেলগামে গত ২২শে এপ্রিল হামলার পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চরম উত্তেজনা চলছে। ওই হামলায় ২৫ জন পর্যটকসহ ২৬ জন নিহত হয়।
ভারত ছয় ও সাতই মে মধ্যরাতে পাকিস্তান ও পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ‘সন্ত্রাসীদের ঘাঁটিগুলো’কে নিশানা করে এই হামলা চালানো হয়েছে।
ভারতের ‘অপারেশন সিন্দুর’কে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়ে। যার জবাবে শুক্রবার দিবাগত রাতে পাকিস্তান ‘অপারেশন বানিয়ান মসরুর’ এর ঘোষণা দেয়।
ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলার পর ভারত যেভাবে তাদের কূটনৈতিক এবং সামরিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে তাতে দেশটির চিরাচরিত কৌশলে পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছেন এবার ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কৌশল অবলম্বন করেছে ভারত’।

ছবির উৎস, Getty Images
ভারতের কৌশল কি বদলেছে?
অতীতে দেশে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলার পর ভারত সাধারণত কূটনৈতিক স্তরে কাজ করার চেষ্টা করেছে। ২০০৮ সালের ২৬শে নভেম্বরের মুম্বাই হামলার জন্যও লস্কর-ই-তৈয়বাকে দায়ী করে ভারত। তার স্বপক্ষে অনেক প্রমাণও হাজির করা হয়েছিল।
মুম্বাইয়ের বেশ কয়েকটা জায়গা ও ঐতিহাসিক ভবনে তখন প্রাণঘাতী হামলা চালায় সশস্ত্র হামলাকারীরা। এই হামলায় ১৬০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হন।
সম্প্রতি মুম্বাই হামলার অভিযুক্ত তাহাউর রানাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে প্রত্যর্পণ করা হয়েছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক হামলার পর ভারতের রণকৌশল কি বদলেছে?
বিবিসি হিন্দির সম্পাদক নীতিন শ্রিবাস্তবের সাথে এক সাক্ষাতকারে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হ্যাপিমন জেকব বলেন, “আমার মতে এই যে অপারেশন সিন্দুর যার মাধ্যমে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিয়েছে- এটা একটা নতুন নীতি।”
“২০০১ সালে যখন সংসদ ভবনে হামলা হয়, তারপর ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর যখন মুম্বাইয়ে হামলা হয়, তখন কিন্তু ভারত সরকার পাল্টা ব্যবস্থা নেয়নি।”
এই প্রসঙ্গে একটা উল্লেখযোগ্য বিষয়ের কথা বলেছেন তিনি।
তিনি বলেন, “পাকিস্তানের কাছে পরমাণু অস্ত্র আছে বলে সব সময় একটা ভয় ছিল। আমরা যদি তাদের প্রচলিত পদ্ধতিতে হামলা চালাই, তাহলে তারা পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে- এই আশঙ্কা ছিল ভারত সরকারের মনে। ভারতের কৌশলগত চিন্তাবিদরাও একই বিষয় নিয়ে চিন্তিত ছিলেন।”
কিন্তু ২০১৬ সালে উরিতে ১৯ জন সেনা নিহত হওয়ার পর নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালায় ভারত।
২০১৯ সালে পুলওয়ামায় হামলায় আধাসামরিক বাহিনীর ৪০ জন জওয়ান নিহত হয়েছিলেন। এরপরই বালাকোটে ‘এয়ার স্ট্রাইক’ চালানো হয়।
হ্যাপিমন জেকব বলছেন, “আমি মনে করি এই তিনটে হামলার (উরি, পুলওয়ামা এবং পহেলগাম হামলা) প্রেক্ষিতে একটা নতুন নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে।”
“এই নীতি হলো যখনই পাকিস্তান সাব-কনভেনশনাল পদ্ধতিতে ভারতে আক্রমণ করবে, তখন ভারত তার জবাবে প্রচলিত পদ্ধতিতে হামলা চালাবে অর্থাৎ সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করবে।”
এর পিছনে উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
তার কথায়, “এথেকে গুরুত্বপূর্ণ উপসংহার হলো পাকিস্তান জানবে যে যখনই কোনও সন্ত্রাসী সংগঠন তাদের হয়ে ভারতে হামলা চালাবে তখন ভারত অবশ্যই তার জবাব দেবে।”
উল্লেখ্য, পহেলগামে হামলার জন্য ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করলেও পাকিস্তান তা অস্বীকার করে আসছে। এবং ভারতের বিরুদ্ধে প্রমাণ ছাড়াই তাদের দিকে আঙ্গুল তোলার অভিযোগ করেছে।

ছবির উৎস, Getty Images
‘ভারতের নীতি মার্কিন-ইসরায়েলের মতো’
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত পাকিস্তানে হামলা চালানোর পর একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে বর্ণনা করে তারা কোথায় এবং কেন হামলা চালিয়েছে, হামলার লক্ষ্যবস্তুগুলো বেছে নেয়ার পেছনে তাদের কারণ ব্যখ্যা করে।
মি জেকবের কথায়, “ভারত কোনও আন্তর্জাতিক ফোরামের দ্বারস্থ হয়ে হামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়নি, যেমনটা সাধারণত দেখা যেত আগে। এটা ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে এটা একধরনের বড় মৌলিক পরিবর্তন, যেখানে বলা হচ্ছে- আমরা ইচ্ছামতো আঘাত করব।”
এটা কি মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টির কোনও কৌশল?
হ্যাপিমন জেকব বলছেন, “আমেরিকায় যখন কোনও হামলা হয়, তখন আমেরিকা কিন্তু আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে যায় না। ইসরাইলেরও একই নীতি। তারাও কোনও ফোরামে গিয়ে বলে না যে আমাদের উপর হামলা হয়েছে। আমরা কী করব?”
তার মতে, ভারতও সেই পন্থাই নিয়েছে।
মি. জেকবের কথায়, “ভারতও একই কৌশল অবলম্বন করেছে এবং বার্তা পাঠিয়েছে আমাদের লোকদের হত্যা করা হলে আমরা ব্যবস্থা নেব। অবশ্য এই বিষয়টা আন্তর্জাতিক ফোরামে গেলে, ভারতের পক্ষেও সমর্থন রয়েছে।”
“আমরা প্রমাণ হিসেবে এটা বলতে পারি যে পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন টিআরএফ অর্থাৎ দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট এর দায় স্বীকার করেছে। এর যোগ রয়েছে লস্কর-ই-তৈয়বার সঙ্গে এবং পাকিস্তানের মুরিদকেতে লস্কর-ই-তৈয়বার সদর দফতর রয়েছে। এই প্রমাণই যথেষ্ট।” ভারতের অবস্থান ব্যখ্যা করে বলেন অধ্যাপক জেকব।
হ্যাপিমন জেকবের কথায়, “পাকিস্তান বহু বছর ধরে এই বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি এবং বহু বছর ধরে এই সন্ত্রাসী সংগঠনকে জিইয়ে রেখেছে। বিশ্বের সামনে এটাই তার প্রমাণ, আর এর ভিত্তিতে ভারত বলবে, তারা এই সন্ত্রাসী সংগঠনের ক্ষতি করার পরিকল্পনা করছে, যার নাম অপারেশন সিন্দুর।”
“আর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের দিক থেকে আমি বিষয়টাকে অন্যভাবে দেখতে চাই। ২০০১ বা ২০০৮ সালে যখন হামলা হয়, তখন আমেরিকা একটা শক্তিশালী দেশ ছিল। তারা অবশ্য এখনও ক্ষমতাবান, কিন্তু সে সময় আমেরিকা বিশ্ব পুলিশের মতো আচরণ করত। কিন্তু আজ আমেরিকা বৈশ্বিক ইস্যুতে ততটা আগ্রহী নয় এবং ভারত আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।”
এই চিন্তা থেকেই ভারত তাদের চিরাচরিত পররাষ্ট্রনীতি থেকে বেশ খানিকটা সরে এসেছে বলে মনে করছেন অধ্যাপক জেকব।
“প্রতিবেশী দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থা যাই বলুক, ভারত বুঝতে পেরেছে যে তাদের এত মনোযোগ দেওয়ার দরকার নেই।”
“আমরা যদি জানতে পারি যে আমাদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে এবং আমরা যদি জানি কারা করেছে, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব।” বলেন অধ্যাপক জেকব।
দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের ‘সংঘাত’ কতটা ‘গুরুতর’
সুইডেনের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের কাছে ১৭২টা পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে এবং পাকিস্তানের কাছে ১৭০টা পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে।
তবে দুই দেশের কাছে কতগুলো পরমাণু ওয়ারহেড মোতায়েন করা রয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।
দুই দেশই পরমাণু শক্তিধর হওয়ার কারণে তারা কখনও একে অন্যকে আক্রমণ করবে না, অতীতে এমনটাই মনে করা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সংঘাতের পর এই ধারণা কি বদলেছে?
অধ্যাপক হ্যাপিমন জেকব বলছেন, “তাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে পারমাণবিক অস্ত্র আপনাকে আক্রমণ থেকে রক্ষা করে, কিন্তু তা সন্ত্রাসী হামলা বা প্রচলিত হামলা ঠেকাতে পারে না। অতএব, এটা বলা ন্যায্য হবে যে পারমাণবিক শক্তি থাকার ফলে কেবলমাত্র সীমিত স্তরের সুরক্ষা সরবরাহ করে।”
তিনি বলেন, “এখন পাকিস্তানের বিমানবাহিনী নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে। তারা খুবই সক্ষম। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, পাকিস্তানের প্রচলিত শক্তির দিক থেকে মজবুত হলে তারা পরমাণু অস্ত্রের দিকে যাবে না। আর যদি প্রচলিত যুদ্ধ হয়, তাহলে সামরিক ও অর্থনীতি উভয় দিক থেকেই ভারত অনেক বেশি শক্তিশালী।”
অধ্যাপক হ্যাপিমন জেকব মনে করেন, বৈশ্বিক পর্যায়ে ভারতের ভালো বন্ধু রয়েছে, যা পাকিস্তানের নেই। এমন পরিস্থিতিতে প্রচলিত যুদ্ধে ভারত মনে করছে তারা জিততে পারে এবং ভারতের মূল্যায়ন অনুযায়ী, পরমাণু অস্ত্রকে এই সমীকরণের বাইরে রয়েছে।

ছবির উৎস, Getty Images
কোনও বিশেষ বার্তা দিতে চায় কি ভারত?
ভারত ও পাকিস্তান এমন দুই প্রতিবেশী দেশ যার মধ্যে সবসময় একধরনের উত্তেজনা থাকে। দুই দেশের মধ্যে একাধিকবার যুদ্ধ হয়েছে।
সাধারণত দুই দেশের মধ্যে এমন উত্তেজনা দেখা দিলে পরিস্থিতি শান্ত করতে তৃতীয় কোনো দেশের তৎপরতা দেখা গিয়েছে। কিন্তু এইবার ভারত কোনও তৃতীয় দেশের মধ্যস্থতাকে গুরুত্ব দেয়নি।
অধ্যাপক হ্যাপিমন জেকব বলছেন, “পাকিস্তান ১৯৪৭ সাল থেকে বরাবরই চেয়েছে মাঝখানে তৃতীয় পক্ষকে এনে মধ্যস্থতা করাতে। পাকিস্তান যখন জম্মু-কাশ্মীরের উপর হামলা করে, তারপর জাতিসংঘকে আনা হয়। ১৯৬৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে (মধ্যস্থতার জন্য) টেনে আনা হয়।”
“কিন্তু ১৯৭১ সালে ভারত বলেছিল, আমরা চাই না এর মধ্যে তৃতীয় কোনও পক্ষকে আনা হোক, যা হওয়ার আমাদের মধ্যেই হোক।”
হ্যাপিমন জেকব মনে করেন, “এবার ভারতের কৌশল হচ্ছে আন্তর্জাতিক মতামতের পরোয়া না করেই জবাব দেওয়া, কারণ ভারতের উপর হামলা হয়েছে। এ কারণেই ভারত মনে করে যে তাদের স্ট্রাইক (আঘাত হানার) করার অধিকার রয়েছে এবং তারা তা করছেও।”
বর্তমান ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে দেখা গিয়েছে শুধু পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরেই নয়, পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলেও হামলা চালিয়েছে ভারত।
অধ্যাপক জেকব বলেছেন, “আমি বিশ্বাস করি এর মধ্যে বার্তা হলো ২০১৬ সালে ভারত যখন প্রথম সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছিল, তখন সেটা ছিল নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে একটি টেস্ট কেস। এরপর ২০১৯ সালে আমরা আরেকটু এগিয়ে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে হামলা চালাই।”
“সম্প্রতি যে হামলা হলো, তা ঘটেছে পাকিস্তানে, পাকিস্তানের পাঞ্জাবের অভ্যন্তরে, অর্থাৎ সে দেশের কেন্দ্রস্থলে। এর অর্থ হলো ভারতের কাছে প্রচুর বিকল্প রয়েছে। যদি ভবিষ্যতে ভারতে কোনও সন্ত্রাসী হামলা হয়, তবে আমি বিশ্বাস করি যে ভারতের কাছে প্রতিশোধ নেওয়ার অনেক বিকল্প থাকবে।”