Source : BBC NEWS

ডাবিংয়ের কাজ করছেন রাফিয়াথ রশিদ মিথিলা

ছবির উৎস, Khalid Hossain Ovi

দশ বছর আগের ঘটনা। বেসরকারি টিভি চ্যানেল দীপ্ত টিভি চালু হয় বাংলাদেশে। তখন থেকেই চ্যানেলটিতে প্রচার শুরু হয় দেশি-বিদেশি বেশ কিছু সিরিজ বা সিরিয়াল। বিশেষ করে প্রচারে আসার কয়েকদিনের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘সুলতান সুলেমান’ সিরিজ। তুর্কি এই সিরিজ জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে বাংলায় করা ‘ডাবিং’।

ছয়শ বছর আগের অটোমান সাম্রাজ্যের রাজপ্রাসাদের নানা ঘটনা নিয়ে নির্মিত তুর্কি এই সিরিজটি বাংলাদেশে প্রচারের আগে তৈরি করা হয় ডাবিং স্টুডিও, নিয়োগ দেয়া হয় ডাবিং শিল্পীদের।

ফলে বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে সুলতান সুলেমান, হুররাম সুলতান, নিগার গালফা, ইব্রাহিম পাশাসহ নানা চরিত্র হয়ে ওঠে খুব পরিচিত। কারণ তারাও অনর্গল কথা বলে ‘প্রমিত বাংলায়’।

তবে আরও বড় কারণ এই সিরিজের গল্প, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও নির্মাণ কৌশল। শুধু সুলতান সুলেমানই নয়, কসেম সুলতান, ফেরিহাসহ জনপ্রিয় হয়েছে বেশ কিছু সিরিজ।

সুলতান সুলেমানের পথ ধরে দেশের বেশ কিছু বেসরকারি টিভি চ্যানেল এবং ওটিটি প্লাটফর্ম ডাবিং সিরিজ প্রচারের উদ্যোগ নেয়।

তবে দীপ্তই প্রথম নয়, একসময় দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভিতেও প্রচার হতো ডাবিং সিরিজ ও সিনেমা। শোনা যায় সেসব সিরিজের ডাবিং করা হতো ভারতের কলকাতা থেকে। যদিও নব্বই দশকের পর থেকে সেটা কমতে থাকে।

নতুন করে ২০১৫ সালে বড় পরিসরে শুরু হয় বিদেশি সিরিজের ডাবিং এবং প্রচার।

এসব বিদেশি সিরিজের চরিত্রগুলোকে দেশের মানুষের কাছে আপন করে তুলতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন দেশের ভয়েস ওভার আর্টিস্ট বা বিদেশি ভাষার নাটক-চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দেওয়া শিল্পীরা।

আরো পড়তে পারেন:
কণ্ঠ দিচ্ছেন জাকিয়া বারী মম

ছবির উৎস, Khalid Hossain Ovi

বিনোদন মাধ্যমে গত কয়েক বছরে নতুন একটি পেশা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে ভয়েস অভার আর্টিস্ট বা ডাবিং শিল্পী।

প্রমিত ভাষার চর্চা, শুদ্ধ উচ্চারণ, আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি, আর অল্পবিস্তর অভিনয় জানা থাকলে যে কেউ আসতে পারেন এই পেশায়।

তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন এজন্য থিয়েটার বা মঞ্চ নাটকের সঙ্গে যুক্ত থাকা শিল্পীরা আসলে বেশি সুবিধা করতে পারবেন।

শুধু বিদেশি সিরিজ বা সিনেমাতেই নয়, বিজ্ঞাপন ভিডিও, অ্যানিমেশন বা ডকুমেন্টারি ফিল্ম, অডিও বুক এমনকি ভিডিও গেমসের চরিত্রদের জীবন্ত করে তোলেন এই শিল্পীরা।

চরিত্র অনুযায়ী তাল মিলিয়ে কণ্ঠ দিয়ে পর্দার পেছনে কাজ করেন তারা। তবে তাদেরকে অনেকে কণ্ঠ অভিনেতা বা ভয়েস অ্যাক্টরও বলেন।

দীপ্ত টিভির ডাবিং টিমের সদস্যরা

ছবির উৎস, Dipto TV

নতুন করে যেভাবে শুরু

দীপ্ত টিভি শুরু করার আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া হয় ডাবিং টিম তৈরির, যেটা দেশের আর কোনো টিভি চ্যানেল কখনো উদ্যোগ নেয়নি বলে জানান ওই সময়ের টিমের প্রধান অভিনেতা ও ভয়েস অ্যাক্টর দীপক সুমন।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এটা আমাদের জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ আমাদের এরকম কোনো টিম বা স্টুডিও ছিল না।”

“ওই সময় পেশাদার ডাবিং শিল্পী হিসেবে কাউকে রাজি করানো খুব কঠিন ছিল। কারণ তখন এই পেশার কোনো অস্তিত্ব ছিল না দেশে। আসলে কেউ রাজি হবে কিনা, হলেও তারা কতটা দক্ষ হবেন বা তাদের বেতনই বা কেমন হবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন ছিল,” বলেন তিনি।

দীপক সুমন জানান, আশির দশকে ইরানি সিনেমাগুলোর বাংলায় ডাবিং হতো ইরানি কালচারাল সেন্টারে। এছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) প্রচার হওয়া সিরিয়ালগুলোর ডাবিং হতো কলকাতায়। এরমধ্যে জনপ্রিয় হওয়া আলিফ লায়লা, টিপু সুলতান সিরিজও রয়েছে।

আরো পড়তে পারেন:
সুলতান সুলেমানের চরিত্রে কণ্ঠ দিয়েছিলেন দীপক সুমন

ছবির উৎস, Nazmul Hossain

দীপ্ত টিভি চালুর সময় প্রায় ১৫ জনের একটা টিম করেছিলেন সুলতান সুলেমানের চরিত্রে কণ্ঠ দেওয়া দীপক সুমন। কয়েকবছর পর তিনি নিয়মিত চাকরি ছেড়ে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ শুরু করেন। এখনো তাই করছেন।

দীপ্ত ডাবিং টিমের ভয়েস ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন লতা মজুমদার। তিনি শুরু থেকেই এই টিমের সঙ্গে যুক্ত।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা যখন শুরু করি তখনও আমাদের তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। বিজ্ঞাপনের ভয়েস দেওয়া এবং মঞ্চ নাটক করার অভিজ্ঞতা ছিল। এটা খুব কাজে লেগেছে।”

এখন পর্যন্ত এই টিম থেকে ডাবিং সিরিয়াল প্রচার হয়েছে ১৮টি। এর মধ্যে তুর্কি সিরিয়াল ছিল চারটি। এছাড়া বিভিন্ন সিনেমার ডাবিংও করেন এই টিম থেকে।

লতা মজুমদার জানান, এই টিমের একজন আর্টিস্ট একাধিক চরিত্রে ভয়েস দিয়ে থাকেন। এছাড়া ফ্রিল্যান্সার হিসেবেও বাইরে থেকে ভয়েস আর্টিস্ট নেওয়া হয়।

লতা মজুমদার মনে করেন, তারা ভয়েস আর্টিস্ট নন, ভয়েস অ্যাক্টর।

“আমরা ভোকাল বা কণ্ঠ ব্যবহার করে অভিনয় করছি। চরিত্রের সঙ্গে মিল রেখে আমাদের কণ্ঠ যেমন উঁচু-নিচু করতে হয় তেমনি শ্বাস-প্রশ্বাসের বিষয়টিও অভিনয় করেই দেখাতে হয়। শুধু নিজের চেহারাটা দেখা যায় না,” বলেন তিনি।

আরো পড়তে পারেন:
লতা মজুমদার

ছবির উৎস, Dipto TV

পেশা হিসেবে নেয়ার সুযোগ কতটা?

তরুণ কেউ চাইলে ভয়েস অ্যাক্টিংকে পেশা হিসেবে নিতে পারবেন কিনা জানতে চাইলে লতা মজুমদার বলেন, ”আমরা যখন শুরু করি তখন এই সেক্টর নিয়ে ধারণা ছিল না। এখন অনেকটাই ধারণা তৈরি হয়েছে। যারা আগ্রহী তারা আসতে পারেন। পাশাপাশি যে কেউ চাইলে ফ্রিল্যান্সার হিসেবেও কাজ করতে পারেন।”

সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন দেশে প্রায় ১৫টির মতো ডাবিং স্টুডিও আছে। যেখান থেকে নানা দেশের সিরিয়াল, সিরিজ, সিনেমা বা কার্টুন ছবির ডাবিং তৈরি করা হয়। তাদের তৈরি করা ডাবিং সিরিয়াল দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেল থেকে শুরু করে ওটিটি প্লাটফর্মে প্রচার হয়।

প্রায় ১২ বছর ধরে ডাবিং এর সঙ্গে যুক্ত থাকা গ্লোবাল কনটেন্ট প্রডিউসার ও ভয়েস ডাবিং ডিরেক্টর খালিদ হোসেন অভি বলেন, “গত ১২ বছর ধরে আমি ভয়েস ডাবিং ও গ্লোবাল কনটেন্ট এক্সিকিউশনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। আন্তর্জাতিক কনটেন্টকে বাংলাভাষী দর্শকদের জন্য ভাষাগতভাবে মানানসই করে তোলা, বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী তা উপস্থাপন করা – এটাই আমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র।”

”আমি বিশ্বাস করি, বাংলা ভাষায় আন্তর্জাতিক মানের ডাবিং কনটেন্ট তৈরি করে আমরা বিশ্বমানের বিনোদনকে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি,” বলেন অভি।

তিনি জানান, নতুন বা তরুণরা চাইলেও এই পেশায় আসতে পারেন। তবে এজন্য তাকে দক্ষ হতে হবে।

বিদেশি নাটক বা চলচ্চিত্রের সাথে মিলিয়ে কণ্ঠ দেন অভিনেতারা

ছবির উৎস, Dipto TV

সংশ্লিষ্টরা জানান, সিরিয়ালে ভয়েস দেওয়া বা ডাবিং এর ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সার শিল্পীরা কাজ করেন আট ঘণ্টার শিফট ভিত্তিতে।

এখানে এ, বি ক্যাটাগরির ডাবিং শিল্পী রয়েছে। যাদের প্রতি শিফটে বি ক্যাটাগরির শিল্পীর পারিশ্রমিক থাকে দুই থেকে তিন হাজার টাকার মতো। আর এ ক্যাটাগরির শিল্পীরা পান চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা।

এছাড়া খ্যাতিমান শিল্পীদের ক্ষেত্রে দৈনিক হিসেবে সম্মানী দেয়া হয়।

তবে কেউ স্থায়ী চাকরি হিসেবে নিতে চাইলে বেতন হয় ১৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। ভয়েস ওভারের কাজের ক্ষেত্র অনুযায়ী পারিশ্রমিকে থাকে ভিন্নতা। বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় কাজের চুক্তি হয় প্যাকেজ হিসেবে।

এছাড়া অনলাইনে নানা ক্ষেত্রে ভয়েস ওভারের কাজে পারিশ্রমিক হিসেব করা হয় কাজের সময় অনুযায়ী। এক্ষেত্রে প্রতি মিনিটে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা পারিশ্রমিক নিয়ে থাকেন অভিজ্ঞ শিল্পীরা।

এই পেশা কেমন লাগে জানতে চাইলে দীপ্ত টিভির ডাবিং টিমের ভয়েস অ্যাক্টর মরু ভাস্কর বলেন, ”আমার ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল অভিনেতা হবো। সেটাই এখন আমার চাকরি হয়ে গেছে। হয়তো আমাকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু আমাকে আসলে অভিনয়ই করতে হচ্ছে। এই কাজটি আমি দারুণ উপভোগ করছি।”

ডাবিংয়ের কাজ করছেন রুবাইয়া মাতিন গীতি

ছবির উৎস, Dipto TV

আছে কিছু জটিলতা

ডাবিংকে পেশা হিসেবে নিতে চাইলে আছে কিছু জটিলতাও। কারণ ২০১৫ সালের পর থেকে যেভাবে কাজের সুযোগ, পারিশ্রমিক ও মানসম্পন্ন কাজ হতো সেটা এখন হচ্ছে না বলে মনে করেন দীপক সুমন।

তিনি বলেন, ”চিত্রনাট্য অনুবাদ করে ডাবিং করা এবং ভয়েস অ্যাক্টর হিসেবে কাজ করা দুটোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এখন অনেক কাজই মানসম্পন্নভাবে ডাবিং হচ্ছে না। এ কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।”

”দীপ্ত টিভির পাশাপাশি অনেক টিভি চ্যানেলই ডাবিং সিরিয়াল প্রচার শুরু করেছিলো, কিন্তু মানসম্পন্ন কাজ না পাওয়ায় অনেকে আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তবে আমাদের দেশে এটার একটা বড় বাজার রয়েছে,” বলেন দীপক সুমন।

পাশাপাশি ডাবিং সিরিয়াল প্রচারের জন্য সরকারিভাবে সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়াও একটা বড় কারণ বলে জানান দীপক। এছাড়া যে কোনো বিদেশি সিরিজ প্রচারের আগে সেন্সর করে নেওয়ারও আইন রয়েছে।

দীপক সুমন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, একসময় ভারত থেকে ডাবিং সিরিয়াল আমদানি করা হতো। এত নিয়ম কানুন ও মানহীন কাজের কারণে আবারও সম্ভবনাময় এই মাধ্যম বেহাত হতে পারে।