Source : BBC NEWS

কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে যেসব “কনসার্ন” উত্থাপন করেছে, সেগুলোকে “অতিসত্বর অ্যাড্রেস” করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ।
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলসহ চার দফা দাবিতে আজ শনিবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলাম আয়োজিত মহাসমাবেশে যোগ দিয়ে ওই কথা বলেন তিনি।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারীদের রাজনৈতিক দল এনসিপি’র একজন কেন্দ্রীয় নেতার হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে অংশগ্রহণ এবং বহুল আলোচিত ‘নারী সংস্কার ইস্যুতে’ তার সুস্পষ্ট বক্তব্যের মাঝে “নারীবিদ্বেষী অবস্থান” নিহিত রয়েছে কিনা এই প্রশ্ন সামনে এসেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে মি. আব্দুল্লাহ’র অংশগ্রহণ থেকে এটি স্পষ্ট যে এনসিপি ইসলামিক দলগুলোর সাথে এক ধরনের “ঐক্য” ঘোষণা করছে।

ছবির উৎস, Hasnat Abdullah/Facebook
সমাবেশে যা বলেছেন হাসনাত
হেফাজতে ইসলাম যে চার দফা দাবি নিয়ে শনিবার ঢাকায় মহাসমাবেশের আয়োজন করে, সেগুলো হলো— নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন ও এর প্রতিবেদন বাতিল; সংবিধানে বহুত্বদের পরিবর্তে আল্লাহ’র ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল; হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলা প্রত্যাহার ও শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডসহ সব গণহত্যার বিচার; ফিলিস্তিন ও ভারতে ‘মুসলিম গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধে’ সরকারকে ভূমিকা রাখা।
এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ তার বক্তব্যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও শেখ হাসিনার ফাঁসি’র দাবি জানিয়েছেন।
২০১৩ সালের পাঁচই মে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ এবং ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান নেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনায় নিহতদের তালিকা প্রকাশ করার জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
এরপরই তিনি সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ করে বলেন, “নারী সংস্কার নিয়ে যে কনসার্ন আপনাদের কাছে এসেছে, আমরা চাই ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই কনসার্নগুলোকে আপনি অতিসত্তর অ্যাড্রেস করবেন।”
“অপ্রয়োজনীয় সংস্কারগুলোকে পাশ কাটিয়ে প্রয়োজনীয় যে সংস্কারগুলোর মধ্য দিয়ে নারীদের অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত হয় এবং আমাদের দেশের ধর্মীয় ও কালচারাল সম্মান যেন অক্ষুণ্ন থাকে, সেই সংস্কারগুলোর ওপর জোর দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, তাতে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীদের সমান অধিকার, বহুবিবাহ বন্ধের প্রস্তাব, যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি, বিভিন্ন বিষয়ে নারী-পুরুষ সমান অধিকার দেওয়ার মতো কিছু প্রস্তাব রয়েছে। এর মধ্যে বেশকিছু প্রস্তাবকে ‘ইসলামবিরোধী’ হিসেবে মনে করছেন হেফাজত নেতারা।

এখন, নারী সংস্কার ইস্যুতে হেফাজতে ইসলামের উত্থাপিত আপত্তিগুলোকে সরকার যেন আমলে নেয়— এই মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে পড়েছেন হাসনাত আব্দুল্লাহ।
তবে সমাবেশ শেষে আজ সন্ধ্যায় এ বিষয়ে মি. আব্দুল্লাহ’র সাথে কথা হয় বিবিসি বাংলা’র। তখন তিনি বলেন যে তার বক্তব্যকে “ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে”।
তার ভাষ্য, সংস্কারগুলো নিয়ে হেফাজতে ইসলাম উদ্বেগ জানিয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে তিনি আলোচনা করতে বলেছেন।
“আমি বলেছি আলোচনা করতে এই বিষয়গুলো নিয়ে। যদি মনে হয় ভ্যালিড, যারা সংস্কার কমিশনের ছিলেন তাদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে যেখানে নারীদের সম্মান এবং অধিকার যে সংস্কারের মধ্য দিয়ে অক্ষুণ্ন থাকবে।”
“আমাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ রয়েছে, ধর্মীয় মূল্যবোধ রয়েছে, মানুষের মাঝে ধর্মভীতি রয়েছে, এটা সকল ধর্মেরই… এই বিষয়গুলো যেন কম্প্রমাইজ না হয়, আমি এটাই বলেছি। ইসলামিক মূল্যবোধ-বিরোধী সংস্কার কমিশন বাদ দিতে হবে- আমি এটা কোথাও বলিনি,” বলেন তিনি।
নারী সংক্রান্ত কোন কোন বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের আপত্তি আছে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, “তারা বিয়ে ইস্যু এনেছে, সম্পদের বণ্টন নিয়ে তারা কথা বলেছে, ম্যারিটাল রেপ নিয়ে কথা বলেছে। ওই ইস্যুগুলোতে লিগ্যাল ইস্যুতে যারা এক্সপার্ট, যারা সংস্কার কমিশন নিয়ে কাজ করেছে, আবার যারা রিলিজিয়াস গ্রাউন্ডে এক্সপার্ট আমার মনে হয় তারা এক সাথে বসে একটা কনসেনশাসে (ঐকমত্যে) পৌঁছানো উচিত।”

হাসনাতের বক্তব্যই কি এনসিপি’র অবস্থান?
প্রশ্ন করা হলে মি. হাসনাত জানান, এনসিপির প্রতিনিধি হিসেবে হেফাজতের কর্মসূচিতে গিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, “গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করা এবং হেফাজতে ইসলাম গত ১৬ বছরে যেসব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে সেটার শিকার, ২০১৩ সালে পাঁচই মে গণহত্যার তারা ভিকটিম। সেই জায়গা থেকে ওখানে যাওয়া।”
তবে এনসিপি’র সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বিবিসিকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের এই সমাবেশে দল হিসেবে এনসিপিকে আহ্বান করা হয়নি। অভ্যুত্থান-পরবর্তী নেতা হিসেবে ব্যক্তিগত জায়গা থেকে হাসনাত আব্দুল্লাহ এই সমাবেশে অংশ নিয়েছেন।
কিন্তু হাসনাত আব্দুল্লাহ যে ওই সমাবেশে অংশগ্রহণ করবে, এটি কি এনসিপি জানতো? জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যাবে, এটা জানতাম। যাওয়ার বিষয়ে আমরা নেতিবাচক ছিলাম না।”
এসময় তিনি এটাও জানান, “হেফাজত দল থেকে কাউকে পাঠাতে বলেনি। তারা স্পেসিফিক্যালি হাসনাতকেই সংহতি প্রকাশের জন্য ইনভাইট করছে।”
“তবে ব্যক্তিগতভাবে অংশগ্রহণ করে তার যে অবস্থান ছিল, তা আমরা দেখেছি। তার বক্তব্যকে আমরা আমলে নিয়েছি এবং এখানে তার বক্তব্যকে আমাদের কাছে পুরোপুরি নেতিবাচক মনে হয়নি। নারী সংস্কার কমিশন বাতিল বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য ছিল না,” বলেন মি. আদীব।
তার মতে, “হাসনাত আব্দুল্লাহ শুধু এটাই বলতে চেয়েছেন যে আমাদের দীর্ঘদিনের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ যে কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক না হয়”।
“সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক, প্রতিবেদনে এমন কিছু প্রস্তাবনা আছে। নারী বিষয়ক সবগুলোতে আমাদের আপত্তি নেই। স্পেসিফিক কয়েকটি বিষয়ে আমাদের আপত্তি আছে। যেমন…উত্তরাধিকার আইন… সমানাধিকার… বিয়ে,” বলেন তিনি।

হেফাজতের সমাবেশে এনসিপি নেতার উপস্থিতি ও বক্তব্য নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জোবাইদা নাসরীন বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিষয়টাকে “স্রেফ ব্যক্তিগত মতামত” বলে মনে করছেন না।
“এটিকে আমি এনসিপি’র বক্তব্য বলে মনে করছি এবং তাদের অবস্থানও তাই।”
“হাসনাতের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কমিশন ও নারী বিষয়ে এনসিপি’র অবস্থান পরিষ্কার হচ্ছে। এনসিপি কিংস পার্টি। এখানে সরকারের দল হিসেবে এনসিপি বিভিন্ন মঞ্চে, ফোরামে তাদের অবস্থান ও বক্তব্য জানান দিচ্ছে,” বলেন এই বিশ্লেষক।
তার মতে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়ই এনসিপি দাঁড়িয়ে আছে এবং এনসিপি সরকারি দল হিসেবেই সমাবেশে গিয়ে ইসলামিক দলগুলোর সাথে এক ধরনের ঐক্য ঘোষণা করছে।
“এনসিপি এখন পর্যন্ত তাদের গঠনতন্ত্র ও মূলনীতি স্পষ্ট করেনি। কিন্তু তারা তাদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে…কার সঙ্গে তারা জোট করবে, কার সাথে রাজনৈতিক অংশীদারিত্ব করবে, তা তারা স্পষ্ট করছে, তাদের মতাদর্শিক-রাজনৈতিক অবস্থান জানান দিচ্ছে।”