Source : BBC NEWS

আদালতে নেয়ার দৃশ্য

১৭ মিনিট আগে

বাংলাদেশে সুপরিচিত অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়াকে ঢাকা বিমানবন্দরে আটকের পর হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেফতার দেখানোর ঘটনায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। রোববার আটকের পর আজ সোমবার আদালতের আদেশে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই বলছেন, আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে সরকারি উদ্যোগে বানানো সিনেমায় অভিনয়ের জন্যই মিজ ফারিয়াকে এখন ‘শাস্তি’ দেয়া হচ্ছে।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অবশ্য জানিয়েছেন, তার ভাষায় ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার সহযোগী হওয়ার কারণে নুসরাত ফারিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে’।

সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা এ ঘটনাকে বিব্রতকর উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিদেশ গমনকে কেন্দ্র করে ক্ষোভের পর ওভার নারভাসনেস থেকেই হয়তোবা এইসব ঘটনা ঘটে থাকতে পারে’।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী অবশ্য বলেছেন, মামলা থাকায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তবে শিল্পী কলাকুশলী, আইনজীবী, মানবাধিকার সংগঠকসহ অনেকেই নুসরাত ফারিয়ার এ ঘটনায় বিস্মিত হয়েছেন। তাদের কেউ কেউ ‘প্রতিহিংসামূলক’ বলে উল্লেখ করেছেন।

প্রসঙ্গত, ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সিনেমায় শেখ হাসিনার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নুসরাত ফারিয়া।

ওই সিনেমায় শেখ হাসিনার মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা, যিনি ব্যক্তিগত জীবনে সংস্কৃতি উপদেষ্টার স্ত্রী।

এর আগে গত বছর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে তখনকার সরকার সমর্থক সংস্কৃতি কর্মীদের এখনো অনেকে আত্মগোপনে আছেন। আবার অনেকে দেশে সক্রিয় থাকলেও তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে নানা ধরনের মামলা হয়েছে। কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন না এমন অনেককেও এসব মামলার আসামি করা হয়েছে।

সম্প্রতি অভিনেতা ইরেশ যাকেরকেও একই ধরনের একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় জড়ানো হলে তা নিয়েও ব্যাপক শোরগোল হয়েছিলো।

এছাড়া পুরনো ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী সাইফুদ্দিন মোহাম্মদ এমদাদকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে করা মামলায় প্রবীণ অভিনেতা ও নাট্যকার মামুনুর রশীদসহ ১৪ জন অভিনয়শিল্পীর নাম ছিলো।

বিবিসি বাংলায় আরও পড়ুন:
হত্যাচেষ্টা মামলায় অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া কারাগারে

ছবির উৎস, NUSRAAT FARIA/FACEBOOK

আদালতে যা ঘটেছে

মার্চ মাসে এনামুল হক নামের এক ব্যক্তি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৮৩ জনকে আসামি করে ভাটারা থানায় একটি মামলা করেছিলেন। সেই মামলাতেই নুসরাত ফারিয়া, চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস, নিপুণ আক্তার, জায়েদ খান, মেহের আফরোজ শাওন, আশনা হাবিব ভাবনাসহ ১৭ জন অভিনয়শিল্পীর নাম ছিলো।

আইনজীবীরা জানিয়েছেন, ১৯শে জুলাই ভাটারা এলাকায় এনামুল হক নামের ওই ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন উল্লেখ করে সিএমএম আদালতে মামলাটি করেছেন।

রোববার নুসরাত ফারিয়াকে আটকের পর সেই মামলাতেই গ্রেফতার দেখিয়ে আজ আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। আদালতে তার আইনজীবী মোহাম্মদ ইফতেখার হাসান জানিয়েছেন যে, মামলায় ঘটনার তারিখ হিসেবে ১৯শে জুলাইয়ের কথা বলা হয়েছে এবং সেই দিন নুসরাত ফারিয়া কানাডায় অবস্থান করছিলেন।

অন্যদিকে আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে পিপি ওমর ফারুক ফারুকী বলেছেন যে নুসরাত ফারিয়া ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার অন্যতম সহযোগী’। তিনি দাবি করেন তার ভাষায় ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার সহযোগী হওয়ার কারণে নুসরাত ফারিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে’।

শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োপিকে অভিনয় করার প্রসঙ্গে তিনি আদালতে বলেন ‘রুপালি পর্দায় তিনি শেখ হাসিনার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। অভিনয় করা কোনো দোষের কিছু নয়। কিন্তু তিনি পরবর্তীতে বলেছিলেন, প্রতিটা ঘরে ঘরে শেখ হাসিনা রয়েছে। এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে তিনি ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে খুশি করতে চেয়েছিলেন।’

মি. ফারুকী আরও দাবি করেছেন যে নুসরাত ফারিয়া সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি হওয়ার চেষ্টা করেছেন।

এজাহারভুক্ত ২০৭ নম্বর আসামী মিজ ফারিয়ার নামের পাশে মামলায় বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগের অর্থ যোগান দাতা তিনি।

ছবির উৎস, NUSRAAT FARIA/FACEBOOK

সংস্কৃত উপদেষ্টার পোস্ট

নানা প্রতিক্রিয়া, আলোচনা

রোববার ঢাকায় বিমানবন্দরে নুসরাত ফারিয়াকে থাইল্যান্ড যাওয়ার সময় ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে আটকের পরপরই এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায় সামাজিক মাধ্যমে। অনেকেই তার আটকের সমালোচনা করেছেন।

অভিনেতা মামুনুর রশীদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, গত মাসের ত্রিশ তারিখে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার পর খবর পেয়েছিলেন যে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

“মাত্র একদিনের ব্যবধানে আমি চলে এসেছি। না হলে আমার পরিণতি হয়তো নুসরাতের মতোই মতো। এটা দুর্ভাগ্যজনক আমরা যারা অভিনয় করে খাই, মঞ্চ নাটক করি,মাঝে মাঝে সত্য উচ্চারণ করি- সেই অপরাধে আমাদের এমন ভাবে মামলা দিয়ে হেনস্থা করতে হবে? এটা কোন বিবেচনা? অথচ সরকার বলেছিলো যা খুশী বলুন। গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখিয়েছিলো। কিন্তু সেই স্বপ্ন দু:স্বপ্নে পরিণত হচ্ছে প্রতিদিন”।

তিনি বলেন, শিল্পীদের নামে যে মামলা হচ্ছে এটা অন্যায়।

“আমি আশা করবো শুভবুদ্ধির উদয় হবে সরকারের। এভাবে চিরদিন চলে না,” বলছিলেন তিনি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মিতি সানজানা বলছেন, ঢালাও মামলার একটি মহোৎসব দেখা যাচ্ছে এবং এতে নানা পেশার মানুষকে হিংসা ও বিদ্বেষমূলক মামলায় জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। তার মতে এগুলো এখনই বন্ধ হওয়া উচিত।

“এসব ঢালাও মামলা বন্ধ করা উচিত। মামলাগুলো টার্গেট করে ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকারও তো স্বীকার করছে হয়রানিমূলক। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে হেয় করতে প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে মামলা হচ্ছে বলেই মানুষ মনে করে। দেশেই ছিলেন না এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধেও মামলা হচ্ছে। সরকারকে স্পষ্টভাবে দেখাতে হবে যে হয়রানিমূলক মামলা যেন না হতে পারে। একেবারে ভিত্তিহীন এসব মামলা কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

অনেক হয়রানিমূলক, বিদ্বেষমূলক মামলা হচ্ছে বলে আইন উপদেষ্টা নিজেও স্বীকার করেছেন।

প্রসঙ্গত, সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল নিজেও সম্প্রতি একাধিক বক্তৃতায় কিংবা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন যে, অনেক হয়রানিমূলক, বিদ্বেষমূলক মামলা হচ্ছে। অন্যের জায়গা-জমি ও ব্যবসা দখল করার জন্যও মামলা হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকার পুলিশ-আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকার দেওয়ার চেষ্টা করছে।

মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন বলছেন নুসরাত ফারিয়া একজন সংস্কৃতকর্মী।

‘তাকে কাজের জন্য খেসারত দিতে হবে এটা মানা যায় না। তাকে এক ধরনের শাস্তি দেয়া হচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

“মামলার প্রাথমিক সত্যাসত্য যাচাইয়ের আগেই অনেককে হয়রানি বা বিদেশ যাত্রায় বাধা দেয়া হচ্ছে। এটি মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। মানুষের বিরুদ্ধে শঙ্কা ও সন্দেহ তৈরি হচ্ছে যে গণঅভ্যুত্থানের মৌলিক চেতনার সাথে এগুলো যায় কি-না। কোন মানুষকে এভাবে মামলায় আটকে দিবেন তার নিন্দা জানানো ছাড়া আর কিছু বলার নেই”।

তিনি বলেন, সরকার তদন্ত না করে কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে না বলছিলো কিন্তু তারপরেও এসব মামলায় মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে।

নুসরাত ফারিয়া আটকের পর থেকেই অনেকে সামাজিক মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োপিকে তার অভিনয়ের প্রসঙ্গ তুলে ধরে ওই একই বায়োপিকে সংস্কৃতি উপদেষ্টার মোস্তফা সরয়ার ফারুকী স্ত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশার অভিনয় করার প্রসঙ্গটিও তুলেছেন।

অবশ্য আজ বুধবার মি ফারুকি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, “… ফারিয়ার বিরুদ্ধে এই মামলাতো অনেকদিন ধরেই ছিলো। সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত শেষ হওয়ার আগে গ্রেফতারের কোনো উদ্যোগ নেয়ার বিষয় আমার নজরে আসেনি।”

”কিন্তু এয়ারপোর্টে যাওয়ার পরেই এই ঘটনাটা ঘটে। আওয়ামী লীগের সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিদেশ গমনকে কেন্দ্র করে ক্ষোভের পর ওভার নারভাসনেস থেকেই হয়তোবা এইসব ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। কয়দিন আগে ব্যারিস্টার আন্দালিব পার্থের স্ত্রীর সঙ্গেও এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে। এইসব ঘটনা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য না। আমি বিশ্বাস করি ফারিয়া আইনি প্রতিকার পাবে”।

ওদিকে সংস্কৃত অঙ্গনের অনেকেই নুসরাত ফারিয়ার গ্রেফতারের প্রতিবাদ করে তার মুক্তি দাবি করেছেন।

অভিনেত্রী আজমেরি হক বাধন লিখেছেন, “এই মেয়েটির কোনো দোষ নেই। সে মোটেই দায়ী নয়। যারা ফ্যাসিবাদী শাসন চালিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার করেছে তাদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। বর্তমান পরিস্থিতি এবং ব্যবস্থা নিয়ে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা এমন দেশে বাস করি না, যেখানে ন্যায়বিচার সাধারণভাবে প্রচলিত। তবে এবারের ঘটনাটি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।”

পরিচালক শিহাব শাহীন লিখেছেন “অবিশ্বাস্য আর আজগুবি অভিযোগে নুসরাত ফারিয়ার গ্রেফতার হয়রানিমূলক!”

জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলীয় সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ তার ভেরিফায়েড পাতায় লিখেছেন: “……… ৬২৬ জনকে নিরাপদে বের করে দিয়ে এখন নুসরাত ফারিয়াকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার করে বোঝাতে চাচ্ছেন আপনারা খুব বিচার করছেন? এগুলো বিচার নয়, এগুলো হাসিনা স্টাইলে মনোযোগ ডাইভারশন”।