Source : BBC NEWS

মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল থেকে গত একবছরে নতুন করে আরো অন্তত এক লাখ আঠারো হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। এখনও প্রতিদিন গড়ে ২০-৩০ জন রোহিঙ্গা সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে বলে জানিয়েছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়।
কক্সবাজারে স্থানীয় বাংলাদেশিরা বলছেন নতুন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আরো অনেক বেশি এবং বিষয়টি স্থানীয় বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য গভীর উদ্বেগের। নতুন এই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিবন্ধন, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়েও দুশ্চিন্তা রয়েছে।
কক্সবাজারে উখিয়ায় টেকনাফ ঘুরে বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা খতিয়ে দেখেছেন কী কারণে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মিয়ানমারের রাখাইনের পরিস্থিতি সম্পর্কে কী তথ্য দিচ্ছেন নতুন করে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।
রাখাইনে কী পরিস্থিতি?
মে মাসের শুরুতে স্বামী, দুই সন্তান ও বাবাকে নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে হামিদা বেগম। রাখাইনে পরিস্থিতি তাদের জন্য এতটাই খারাপ যে তার মাকে একা রাখাইনে ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আাশ্রয় নিলেও হামিদার পরিবার নতুন আসা রোহিঙ্গাদের সরকারি- বেসরকারি হিসেবের বাইরে।
হামিদা ও তার পরিবার যেখানে আশ্রয় নিয়েছেন তার কাছাকাছি আরেকটি ঘরে উঠেছেন সাবেরা নামের আরেক নারী। গত মার্চ মাসে তিনি ছয় শিশু সন্তান সঙ্গে করে পালিয়ে এসেছেন।
সাবেরা জানান, প্রায় চারমাস ধরে বুচিডং থেকে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। একগ্রাম থেকে আরেক গ্রামে মানুষের সাহায্য নিয়ে নিয়ে তিনি পালিয়ে আসেন।
“তিন চার মাইল করে হেটেছি। চার পাঁচ মাস লেগেছে। মানুষের সাহায্য নিয়ে নিয়ে এসেছি।”

সাবেরা বলছেন কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা খাওয়ার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু তারপরও এটাই তিনি ও তার সন্তানদের জন্য নিরাপদ।
“বুচিডংয়ে বোমায় আমার মা, স্বামী, এক ছেলে মারা গেছে। কাজ নাই। মগের কারণে কাজ করা যায় না। মগেরা মার ধর করে। কারো কাছে সাহায্য নেব সে অবস্থাও নেই। তাই কষ্ট করে চলে আসছি,” বলছিলেন সাবেরা।
রোহিঙ্গারা এখন কেন নিজ দেশে থাকতে পারছেন না সেই প্রশ্ন করেছিলাম বুচিডং থেকে আসা মাদ্রাসা শিক্ষক মকবুল আহমেদকে। তিনি নয় সদস্যের পরিবার নিয়ে শরণার্থী হয়েছেন বাংলাদেশে। মিয়ানমার আর্মি এবং আরসা সদস্যদের সহযোগিতার অভিযোগ তুলে সেখানে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক নির্যাতন করা হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন।
“আরসার কাছে ওষুধ বিক্রি করেছিস। ভাত খাইয়েছিস। তোরাও আরসার সমর্থক। এসব মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আমার বাড়ি নিয়েছে। বিরাট ওষুধে দোকান দখল নিয়েছে।”
মকবুল আহমেদ জানান গত মার্চে রোজার সময় তারা তিনশজন রোহিঙ্গা একসঙ্গে বাংলাদেশে ঢুকেছিলেন। তার পরিবারের বাকি আটজন সদস্য আসেন তার দুদিন পর। রোহিঙ্গাদের নতুন করে আসার পেছনে রাখাইনে নিত্যপণ্যের মারাত্মক সংকট একটা বড় কারণ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
মকবুল আহমেদের কথায় খাদ্য সংকটের কারণে নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী।
“না ওষুধ আছে, না ডাক্তার আছে, না খাদ্য আছে। আমি দেখছি এক বস্তা চাল বার্মা টাকায় একলাখ টাকা বিক্রি হয়। দুই কেজি পিয়াজ ৭০ হাজার, এক লিটার তেল বিশ হাজার। মরিচ এক কেজি আশি থেকে এক লাখ বার্মা টাকা (মিয়ানমারের মুদ্রায় সতের কিয়াত সমান বাংলাদেশি এক টাকা)। এই সংকটে কী করে থাকবে? রোহিঙ্গাদের পক্ষে সেখানে থাকা সম্ভব না।”
উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের একটি ক্যাম্পের মাঝি মোহাম্মদ রফিক। তিনি এসেছেন ২০১৭ সালে। তিনি বলছেন তার ক্যাম্পেই এক হাজারের বেশি নতুন পরিবার যুক্ত হয়েছে গত এক বছরে। কেন নতুন করে এই রোহিঙ্গাদের আসাটা বেড়ে গেল সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাখাইনে বসবাসের অবস্থা নেই। সব মিয়ানমার সরকার নয় আরাকান আর্মি সব নিয়ন্ত্রণ করছে।
“রোহিঙ্গা যারা আছে, তারা নিরাপদ নয়। বিশ বছরের ছেলে দেখলে তাদের দলে নিয়ে যায়। মিয়ানমার আর্মির সাথে যুদ্ধ করার সময় তাকে সামনে দিয়ে দেয়। সেখানে মারা যাচ্ছে। অথবা বিরুদ্ধে কোনও কথা বললে তারা মেরে ফেলতেছে। মা বোনদের মধ্যে দেখতে ভালো লাগলে তাকে তুলে নিয়ে ইজ্জত ধ্বংস করে। নিজ বাড়িতে থাকতে পারতেছে না। আরাকান আর্মি যেখানে চায় সেখানে থাকতে হচ্ছে। পশুপাখির মতো পাহাড় জঙ্গলে রাখা হচ্ছে বলেও জানা যাচ্ছে।”

ছবির উৎস, Getty Images
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসার সঙ্গে আরাকান আর্মির একটা দ্বন্দ্ব চলছে এমন আলোচনাও রয়েছে। ক্যাম্পে এসব সদস্যদের থাকার বিষয়টি অনেকে আঁচ করতে পারেন। এই সদস্যরা কিছুদিন ক্যাম্পে থাকে আবার মিয়ানমারে আসা করেন বলেও তথ্য রয়েছে।
“আরসা নামে একটা সংগঠন আছে এটা মিথ্যা না। তারা রোহিঙ্গার পক্ষে দাঁড়ায়। ওখানে তারা মেহনত করতেছে। তাদের আত্মীয় স্বজন থাকতে পারে। ওখানে যে গ্রাম আছে সেখানে তাদের আত্মীয় স্বজন থাকতে পারে। খাওয়া দাওয়া করতে হয়। আরসার সহযোগী হিসেবে অভিযোগ এনে নির্যাতন করে। যারা আরাকান আর্মির বিরুদ্ধ কথা বলে তাদের অভিযুক্ত করে নির্যাতন করে।”
উদ্বেগ কোথায়?
নতুন আসা রোহিঙ্গারা জানান নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে গোপনে তারা নৌকায় পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। টেকনাফ, সেন্টমার্টিন ঘুরে শাহপরীর দ্বীপ সহ বিভিন্ন জায়গা দিয়ে লুকিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছেন রোহিঙ্গারা ।
বাংলাদেশ অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতেই আর কোনও রোহিঙ্গা আশ্রয় না দেয়ার নীতিগত অবস্থান ঘোষণা করেছিল কিন্তু রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ থামানো যায়নি। এছাড়া গত আট বছর ধরে থাকার পরেও প্রত্যাবাসনের কোনও অগ্রগতি নেই। সবমিলিয়ে নতুন অনুপ্রবেশ এবং সার্বিক রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে স্থানীয়রা বাংলাদেশিদের।
বাস্তবতা হলো প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বর্তমান পরিস্থিতিতে অসম্ভব বলেই অনেকে মনে করছেন। অন্যদিকে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বেড়েছে বলেও স্থানীয় বাংলাদেশি নাগরিকদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।
কক্সবাজারের নতুন অনুপ্রবেশ এবং সার্বিক রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা এবং উদ্বেগ বাড়ছে স্থানীয়রা বাংলাদেশিদের।
কক্সবাজার উখিয়ায় স্থানীয় নাগরিকদের অধিকার বাস্তবায়ন কমিটি নামের একটি সংগঠনের সভাপতি রবিউল হোসাইন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে মাদকসহ নানা অপরাধ বাড়ছে। এছাড়া অনেকেই ক্যাম্পের বাইরে বাসা ভাড়া করে বসবাস করছে। ক্যাম্পের বাইরে থাকা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি বলেও ধারণা করছে অধিকার বাস্তবায়ন কমিটি।
“যখন প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা আসছে তখনই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বেড়েই যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে মায়ানমারে কোনও রোহিঙ্গা অবশিষ্ট থাকবে না যদি আমাদের সীমান্তে কঠোর নিরাপত্তা বলয় নিশ্চিত করা না যায়। প্রতি মাসে ৫-৬ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে।”

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বিবিসিকে জানান নতুন রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন চলছে। অনেকেই নিবন্ধনের অপেক্ষায় আছেন। গড়ে প্রতিদিন ২০-৩০ জন এখনও বাংলাদেশে ঢুকছেন বলে তারা শুনছেন।
“ওইখানে মূলত রোহিঙ্গারা মাঝখানে পড়েছে। আরাকান আর্মি যখন মংডু দখল নেয়ার চেষ্টা করে আক্রমণটা চূড়ান্ত পর্যায় পৌছে তখন রোহিঙ্গাদের আগমনটা বেড়ে যায়। এটা মে জুন মাসে বেড়ে যায় এরপর জুলাই আগস্ট সেপ্টেম্বরে আরো বেশি আসে। বিশেষ করে আমাদের সীমান্তে যখন কিছুটা শীথিলতা দেখা দেয় যখণ বিজিবিকে আইন শৃঙ্খলার জন্য বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় সে সময়টাতে অনেক লোক ঢুকে পড়ে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে এবার মিয়ানমার সরকারের পাশাপাশি আরাকান আর্মির সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা চলছে বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে বাংলাদেশ। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন,
“সরকার নিশ্চই যারা ঢাকায় এগুলো ডিল করছেন তারা চেষ্টা করছেন যে নন স্টেট ফ্যাক্টর যারা আছেন ফিল্ডে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। যদিও ফরম্যালি সেটা হয়নি তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ঠ যারা আছেন তারা চেষ্টা করছেন। আমাদের টার্গেটটাই হচ্ছে প্রত্যাবাসন সুতরাং যেকোনও অ্যক্টরই থাকুক না কেন ফিল্ডে তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। “
মি. রহমান বলছেন,
“একটি মানুষকেও প্রত্যাবাসনে নিতে পারিনি। আমাদের কাছে প্রত্যাবাসন ছাড়া বিকল্প নেই। সরকার গুরুত্বসহকারে এগুচ্ছে। যদিও মানুষজন এখনও আসছে। পরিস্থিতি ওইপারে প্রত্যাবাসনের জন্য সহায়ক না।সরকার নেপিডো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করছে।”
জাতিসংঘ কী বলছে
২০১৭ সালে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার পর কক্সাবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ৩৩টি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। সরকারি হিসেবে এসব ক্যাম্পে দশলাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা জানাচ্ছে নতুন পুরোনো মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা কঠিন হচ্ছে। তবে এসব রোহিঙ্গাদে নিজ দেখে ফেরত পাঠানোর মত পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

কক্সবাজারে অবস্থিত ইউএনএইচসিআর’র মুখপাত্র শারি নিজমান বলেন, সেখানে মানবিক সংকট এবং নিরাপত্তার অভাবেই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছে। বর্তমান পরিস্থিতি প্রত্যাবাসনের অনুকূল নয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
“তাদের দেশত্যাগের কারণ আছে। নিরাপত্তার জন্যেই জীবনের ঝুকি নিয়ে এসে শরণার্থী শিবিরে তারা এই পরিস্থিতির মধ্যে বাস করছেন। এর অর্থ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বর্তমান পরিস্থিতি তাদের ফেরার জন্য মোটেও অনুকূল নয়। সেখানে তারা নিরাপদ নয়, সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার অবস্থা নেই, মৌলিক চাহিদা পূরণের সুযোগ নেই, চলাফেরার স্বাধীনতা নেই। যতদিন পর্যন্ত এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে সেখানে তাদের ফেরার জন্য উপযুক্ত নয়।”