Source : BBC NEWS

এক ঘন্টা আগে
উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করছেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বা কুয়েটের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার আজ বুধবার তাদের সঙ্গে দেখা করে কর্মসূচি থেকে সরে আসার আহ্বান জানলেও তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তবে পদত্যাগের বিষয়টি তার নিজের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে না বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন উপাচার্য মুহাম্মদ মাছুদ।
শিক্ষার্থীরা একবাক্যে শিক্ষা উপদেষ্টার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, তারা উপাচার্য পদত্যাগ না করা পর্যন্ত এই কর্মসূচি থেকে সরবেন না।
অন্যদিকে উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ মাছুদ বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, সরকার তাকে সরিয়ে না দিলে তিনি নিজ থেকে পদত্যাগ করবেন না।
তিনি বলেন, “আমাকে সরকার নিয়োগ করেছে। এখন সরকার যদি মনে করে আমি এই পদের জন্য যোগ্য না, অবশ্যই আমি তো আর থাকতে পারবো না। এটা সম্পূর্ণ সরকারের ওপর নির্ভর করছে। এটা এখন আমার ওপর নির্ভর করছে না।”
তবে কুয়েটের আন্দোলনকারী ও অনশনরত শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করা শিক্ষার্থীদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে এখন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
অনশনরত ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র গালিব ইফতেখার রাহাত বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ভিসির পদত্যাগ কিংবা অপসারণের একদফা দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আমরা মরে যাবো, তবে অনশন থেকে উঠবো না।”
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তিন সদস্যের কমিটি এসে বুধবার সকাল থেকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেছেন।
বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার পর বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বহিষ্কৃত ৩৭জন শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশে প্রত্যাহারের কথা জানানো হয়।
গত ফেব্রুয়ারিতে সংঘর্ষের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল।
এদিকে উপাচার্য পদত্যাগের দাবিতে সারা দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ-অনশনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা।

কুয়েট ক্যাম্পাসে শিক্ষা উপদেষ্টা
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে বুধবার সকালে কুয়েট ক্যাম্পাসে যান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার।
সকাল পৌনে ১০টার দিকে উপদেষ্টা কুয়েট ক্যাম্পাসে পৌঁছালে তখন আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীরা উপাচার্যবিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন।
পরে অনশনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে আধাঘণ্টারও বেশি সময় ধরে কথা বলেন শিক্ষা উপদেষ্টা।
কীভাবে ছয় দফা থেকে আন্দোলন উপাচার্য পদত্যাগের এক দফা দাবিতে এলো, সেই বিষয়টিও শিক্ষার্থীরা জানান উপদেষ্টাকে।
এর আগে মঙ্গলবার বিকেলে ফোন করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন শিক্ষা উপদেষ্টা।
পরে উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, “এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে পরিস্থিতি এ পর্যায়ে এসে গেছে। ছাত্রদের অনশন করতে হচ্ছে। আমি এখানে একজন পিতা হিসেবে এসেছি। আমি তাদের বলেছি যারা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে তারা যেন পানি পান করে। আর যারা সুস্থ আছে, তারা অনশন পালন করুক। কিন্তু তারা সেটা শোনেনি।”
“তারপরও আমি তাদের অনুরোধ করছি, তারা যেন অনশন ভাঙে। আমি আশা করছি যত দ্রুত সম্ভব তাদের এই সমস্যা সমাধান হবে,” বলেন শিক্ষা মি. আবরার।
তিনি বলেন, “তারা চাচ্ছে আমরা এখনই কোনো ঘোষণা দেই যার মাধ্যমে তারা অনশন ভাঙতে পারে। আমি তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি আইনি কিছু বিষয় রয়েছে। আমরা যাই করি না সেটা আইন দ্বারা নির্দিষ্ট হতে হবে।”
এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের কয়েকজন সদস্য শিক্ষা উপদেষ্টার সাথে কথা বলার অনুরোধ জানালে তাদের সাথে দেখা করেননি তিনি।

ছবির উৎস, ARIAN RAHMAN ADITTYA
শিক্ষার্থীদের অনড় অবস্থান
গত সোমবার থেকে কুয়েটের স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার সেন্টারের সামনে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেন ৩২ জন শিক্ষার্থী।
কুয়েট শিক্ষার্থীরা জানান, অনশন কর্মসূচিতে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে বুধবার দুপুর পর্যন্ত ছয় জন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের ভর্তি করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারসহ আশাপাশের হাসপাতালে।
সকালে শিক্ষা উপদেষ্টার অনুরোধ সত্ত্বেও তারা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এই কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
অনশনরত ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র মুনতাসির বিল্লাহ নকিব বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমাদের শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো। আমাদের অনেক ভাই হাসপাতালে ভর্তি। তবুও কেউ অনশন ভাঙতে রাজি হয়নি।”
আন্দোলনকারী ও অনশনরত শিক্ষার্থীদের অন্তত চার জন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ভিসি পদত্যাগের একদফা দাবি বাস্তবায়ন না হলে তারা কেউ আন্দোলন ও অনশন থেকে সরে আসবেন না।
ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র গালিব ইফতেখার রাহাত বিবিসি বাংলাকে বলেন, “শিক্ষা উপদেষ্টা আমাদের কাছে এসেছেন, অবশ্যই ওনার প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু অতীতে বিভিন্ন সময়ে আশ্বাস পেয়ে অনশন থেকে সরে আসার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু পরে সে সব দাবির বাস্তবায়ন হয়নি।”
যে কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের একদফা দাবি পূরণের জায়গাতেই অনড় থাকার কথা শিক্ষা উপদেষ্টাকে জানিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন আরিয়ান রহমান আদিত্য বিবিসি বাংলাকে বলেন, “দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কেউই অনশন ভাঙতে রাজি হচ্ছে না। কিন্তু তীব্র গরমে একের পর এক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ মাছুদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমাদের ছাত্রদের পাঁচটি দাবি ছিল। তাদের পাঁচটা দাবিই পূরণ করা হয়েছে। তারপর তারা দাবি নিয়ে এসেছে ভাইস চ্যান্সেলরের পদত্যাগ। এটা নিয়ে তো আর কিছু বলার নেই।”

ছবির উৎস, ABDULLAH AL MAMUN
দেশজুড়ে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ
কুয়েট উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা।
কুয়েট শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে খুলনার জিরো পয়েন্ট মোড় অবরোধ করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
বুধবার বিকেল তিনটায় ক্যাম্পাস থেকে মিছিল নিয়ে তারা জিরো পয়েন্ট মোড় অবরোধ করেন। এ সময় খুলনা-সাতক্ষীরা ও খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশের অনুরোধে তারা সড়কের পাশে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন।
এর আগে কুয়েট শিক্ষার্থীদের দাবির সমর্থনে সকাল থেকে ক্লাস বর্জন করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ফলে খুবির অধিকাংশ বিভাগে কোনো ক্লাস হয়নি।
এদিকে কুয়েট শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি জানিয়ে এবং উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে মঙ্গলবার রাত থেকে আমরণ অনশন শুরু করেছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।
বুধবার সংগঠনটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সাধারণ আহ্বায়ক মোফাজ্জল হোসেন সাদাত গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে জানানো হয়। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
একই দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আটজন শিক্ষার্থী আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করছেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
একই দাবিতে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসে অনশন কর্মসূচি পালন করেছেন।
এর আগে মঙ্গলবার রাতে কুয়েট উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় ‘ব্লকেড’ (অবরোধ) করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একদল শিক্ষার্থী। পরে রাতে তারা সেখান থেকে সরে যান।

যেভাবে এক দফার আন্দোলন
কুয়েটের অষ্টম উপাচার্য হিসেবে গত বছরের পাঁচই সেপ্টেম্বর দায়িত্ব গ্রহণ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাছুদ।
গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি নিয়ে কুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে অনেক শিক্ষার্থী আহত হন।
পরদিন প্রশাসনিক ভবনসহ সব অ্যাকাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা।
ওই দিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় কুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে কমিটি করা হয়।
ওই রাতে খানজাহান আলী থানায় অজ্ঞাত পরিচয় ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করে প্রশাসন।
পরে ২৫শে ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি সিন্ডিকেট সভায় কুয়েটের সব আবাসিক হল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন সকাল ১০টার মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে হলত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এরপর আবাসিক হলগুলো খুলে দেওয়ার দাবিতে শিক্ষার্থীরা গত ১৩ই এপ্রিল বিকেল থেকে আন্দোলন জোরালো হয়।
পরদিন ১৪ই এপ্রিল রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৭জন শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্তের কথা জানায় কর্তৃপক্ষ।
এরপর ১৫ই এপ্রিল শিক্ষার্থীরা উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ মাছুদের পদত্যাগের এক দফা দাবির ঘোষণা দেন। ঘোষণার পর আন্দোলনকারীরা কুয়েটের ছেলেদের ছয়টি হলের তালা ভেঙে হলগুলোয় প্রবেশ করেন।
১৬ই এপ্রিল দুপুরে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। ওইদিন বিকালে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা পদত্যাগের দাবিতে প্রতীকী গদিতে আগুন জ্বালানোর কর্মসূচি পালন করেন।
পরদিন উপাচার্যের পদত্যাগে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হয় এবং বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে পদত্যাগ না করলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশনে বসার ঘোষণা দেন।
পরে গত সোমবার থেকে উপাচার্য পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।