Source : BBC NEWS
কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে এক চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত কলকাতা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রাইকে সোমবার আমৃত্যু কারাবাসে দণ্ডিত করেছে শিয়ালদহ আদালত।
সোমবার দুপুরে নিহত চিকিৎসকের অভিভাবক, আইনজীবী ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সাজা ঘোষণা করেন বিচারক অনির্বাণ দাস।
এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন সঞ্জয় রাই। সাজা শুনেও অনেকটা ‘নির্বিকার’ ছিলেন তিনি।
তবে রায় শুনে ‘অসন্তোষ’ প্রকাশ করেন নিহত চিকিৎসকের বাবা-মা।
কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা বা সিবিআইয়ের ভূমিকায় যে তারা সন্তুষ্ট নন, সেকথা আগেই জানিয়েছিলেন। সোমবার সাজা ঘোষণা হওয়ার পরেও একই কথা বলতে শোনা যায় তাদের।
আদালতের রায়ের বিষয়ে ‘সন্তুষ্ট’ নন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীও। মালদহ সফরকালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানিয়েছেন, এই মামলায় দোষীর ফাঁসির পক্ষে তিনি।
তার কথায়, “আমাদের হাতে এই মামলা থাকলে আমরা অনেক আগেই ফাঁসির রায় করিয়ে দিতে পারতাম।”
এদিকে সঞ্জয় রায়ের আইনজীবী সেঁজুতি চক্রবর্তী বলেছেন, নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করতে তারা উচ্চ আদালতে যাবেন।
রায়ে যা বলা হলো
ভারতীয় আইনে অন্যতম দণ্ডবিধি বা ন্যায় সংহিতার ৬৪, ৬৬ এবং ১০৩ (১) ধারায় সঞ্জয় রাইকে গত শনিবারই দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। এই তিন ধারা মেনে আসামির সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন বা ফাঁসি।
সিবিআইয়ের আইনজীবীর পক্ষ থেকে ফাঁসি চেয়ে শুনানিতে বলা হয়েছিল, “এই ঘটনা বিরলের মধ্যে বিরলতম”। টানা ৩৬ ঘণ্টা ডিউটি করার পর কর্মক্ষেত্রেই ওই চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুন হতে হয়েছে।
আরও বলা হয়, এই ঘটনা সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সমাজের ‘আস্থা’ ফিরিয়ে আনতে এই মামলায় ফাঁসির সাজা হওয়া উচিত।
অন্যদিকে সঞ্জয় রাইয়ের আইনজীবী আরজি জানান, যেন ফাঁসির পরিবর্তে অন্য যেকোনো সাজা দেওয়া হয়।
ফাঁসির বিপক্ষে তিনি একাধিক পুরানো মামলার প্রসঙ্গ এনে বলেন, যেখানে দোষীর একেবারেই শুধরানোর কোনো সুযোগ নেই, সেখানেই ফাঁসির সাজা শোনানো হয়েছে।
এর আগে বিচারক সঞ্জয় রাইকে তার বক্তব্য পেশের অনুমতি দেন। তখন সঞ্জয় রাই বলেছিলেন, “আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।”
সমস্ত পক্ষের বক্তব্য শেষে সাজা ঘোষণার জন্য সময় স্থির হয় পৌনে তিনটা।
সঞ্জয় রাইয়ের আমৃত্যু কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে । জরিমানার অর্থ দিতে না পারলে আরও পাঁচ মাসের কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কর্মক্ষেত্রে ওই চিকিৎসকের নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের, বিচারক সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সব মিলিয়ে ১৭ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেন। যদিও তা নিতে অস্বীকার করেন নিহত চিকিৎসকের অভিভাবক।
এজলাসে নিহত চিকিৎসকের বাবা উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, “আমরা ওই টাকা নিতে চাই না।”
পরে বিচারক নিহত চিকিৎসকের অভিভাবকদের উদ্দেশে বলেন, তিনি মনে করেন না কোনো কিছু এই ক্ষতিকে পূরণ করতে পারে।
বিচারক বলেন, “আপনি মনে করবেন না টাকা দিয়ে ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। আপনার মেয়ে যেহেতু ডিউটিতে ছিল, তাকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল। এটা (ক্ষতিপূরণ) একটা বিধিবদ্ধ বিধান।”
‘আমরা এখনও বিচার পাইনি’
আদালত থেকে বেরিয়ে এসে নিহত চিকিৎসকের বাবা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “আমরা এখনও বিচার পাইনি। বিচারের প্রথম ধাপ পার করলাম। বিচার পাওয়ার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিলেন বিচারক।”
তিনি আরও বলেন, “এটা বিরল থেকে বিরলতম নয়? আমার মেয়েকে হাসপাতালে ধর্ষণ করা হলো, খুন করা হলো!”
তদন্ত প্রক্রিয়ায় সিবিআইয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নিহত চিকিৎসকের পরিবার।
“আসলে এটা সিবিআইয়ের ব্যর্থতা। ওরাই এই ঘটনাকে বিরলের মধ্যে বিরলতম বলে প্রমাণ করতে পারল না,” যুক্ত করেন তিনি।
নিহত চিকিৎসকের মা বলেছেন, “প্রকৃত দোষী ধরা পড়ুক। তা হলেই আমরা খুশি হব।” “এটাকে আমরা সিবিআইয়ের ব্যর্থতা হিসাবে দেখছি।”
আসামি ‘নির্লিপ্ত’
দুপুরে সাজা ঘোষণা হওয়ার আগে শেষবারের মতো নিজের পক্ষে বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দেওয়া হয় মামলার আসামি সঞ্জয় রাইকে। কড়া নিরাপত্তা বলয়ে মুড়ে তাকে নিয়ে আসা হয় এজলাসে। তার চেহারায় ছিল ‘নির্লিপ্ত’ ভাব।
বিচারক তাকে বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দিলে তিনি বলেন, “আমি খুন বা রেপ কোনো কিছুই করিনি। আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। আমি আগের দিনও বলেছি।”
“যেটা আমি শুনেছি যে এত (প্রমাণ) কিছু নষ্ট হয়েছে। আমি জানতাম না। আগের দিনই বলেছিলাম, আমার গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ছিল। সেটা নষ্ট হয়নি। আমি নির্দোষ।”
এরপর পুলিশ হেফাজতে অত্যাচারের অভিযোগ তোলেন তিনি। বিচারককে সঞ্জয় বলেন, “আপনাকে আগেও বলেছি যে কীভাবে আমাকে মারধর করা হয়েছে, যার যা ইচ্ছে করেছে। যেখানে পেরেছে সেখানে সাইন (সই) করানো হয়েছে।”
বিচারক তাকে জানান, এই বক্তব্য আদালতের সামনে আগেও পেশ করা হয়েছে। তার অন্য কিছু বক্তব্য রয়েছে কি না।
নিজেকে বারবার নির্দোষ বলে দাবি করলেও বিচারক তাকে জানান, আদালতের সামনে যে প্রমাণ রয়েছে তার ভিত্তিতে সঞ্জয় রাইকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
এরপর তার পরিবারে কে কে রয়েছেন সেই বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়।
সঞ্জয় রাই বলেন, “মা আছে।”
পরিবারের কেউ জেলে থাকাকালীন দেখা করতে এসেছিলেন কি না তাও জানতে চাওয়া হয়। উত্তরে সঞ্জয় রাই বলেন, “না কেউ আসেনি।”
কথোপকথনের সময়, সাজা ঘোষণা বা এজলাসের ভিড়ের বিষয়ে তেমন কোনো ‘ভ্রুক্ষেপ’ ছিল না তার।
সাজা ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরও দীর্ঘক্ষণ আদালতে করা নিরাপত্তায় রাখা হয়েছিল সঞ্জয় রাইকে। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা নাগাদ তাকে আদালত থেকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
রায়ে ‘অসন্তোষ’
সোমবার সকাল থেকেই কড়া নিরাপত্তা বলয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল আদালত চত্বর।
তবে সকাল থেকেই আদালত চত্বর ও আশপাশের এলাকায় জড়ো হতে থাকেন সাধারণ মানুষ, নাগরিক সংগঠনের সদস্য এবং আন্দোলনরত চিকিৎসকেরা।
সাজা ঘোষণার পর তাদের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া মিলেছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ যেমন তদন্তকারী সংস্থার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কেউ কেউ আবার জানিয়েছেন সুবিচার না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
বেলেঘাটার বাসিন্দা ৬৮ বছর বয়সী অপু বিশ্বাস। তার কথায়, “একটা আইনি ধাপ তো এগোনো গিয়েছে। আমি মনে করি না যে সঞ্জয় একা এই কাজ করেছে। তবে ওর ফাঁসি হলে বাকিদের কথা কোনোদিন জানা যেত না। এখন একটা সুযোগ রয়েছে।”
চিকিৎসক সুদক্ষিণা দাস জানিয়েছেন, এই রায়ে তিনি সন্তুষ্ট নন। তার কথায়, “এই রায়ে আমরা খুশি নই। কারণ আমরা জানি এই যে নৃশংস ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় একজন নয়, একাধিক ব্যক্তি জড়িত।”
“শুধুমাত্র সঞ্জয় রাইয়ের সাজা ঘোষণা করা হলো। এটা আমরা মানছি না, মানব না। যতদিন না সবার শাস্তি হচ্ছে, আমরা রাজপথে আছি, আমরা রাজপথে থাকব।”
নিহত চিকিৎসকের আইনজীবী অমর্ত্য দে বলেন, “ওকে (সঞ্জয় রাইকে) যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে। আমরা আমাদের আর্গুমেন্টে বারবার বলেছি তদন্তকারী সংস্থার তরফে গাফিলতি ছিল। আগেরবার বিচারক রায় দেওয়ার সময় সমালোচনা করেছেন, এই তদন্ত নিয়ে কিছু ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।”
অন্যদিকে, নিহত চিকিৎসকের জন্য সুবিচার ও দুর্নীতি মুক্ত স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের আর্জি জানিয়ে আন্দোলনে সামিল জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে অন্যতম দেবাসিশ হালদার বলেন, “প্রশ্নটা এটা নয় যে সঞ্জয়ের যাবজ্জীবন সাজা হলো না ফাঁসি। প্রশ্নটা হলো এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা কবে শাস্তি পাবে।”
প্রতিবাদী চিকিৎসকদ আসফাকুল্লা নাইয়াও একই কথা জানিয়েছেন। তার কথায়, “আমরা কোনোভাবেই সন্তুষ্ট নই। জাজমেন্টকে সমালোচনা করার আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে। সেই জায়গা থেকে আমরা সমালোচনা করছি।
আমি মনে করি একজন ব্যক্তি যিনি জীবন বাঁচানোর জন্য (হাসপাতালে )উপস্থিত ছিলেন, তাকে সেখানে প্রাণ দিতে হয়েছে। আমার মনে হয় না একজন ব্যক্তির এই যাবজ্জীবন দিয়ে একে জাস্টিস বলে চালানো যায়।”
মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন
মালদহ সফররত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীকে এই রায়ের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমি সন্তুষ্ট নই। ফাঁসির সাজা হলে অন্তত মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম।”
এরপরই রাজ্য পুলিশের পক্ষে কথা বলেন তিনি। তার কথায়, “আমাদের হাতে এই মামলা থাকলে, আমরা অনেক আগেই ফাঁসির রায় করিয়ে দিতে পারতাম।”
সিবিআইয়ের ভূমিকা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি জানি না, কী ভাবে লড়াই করেছে, কী যুক্তি দিয়েছে। সবটাই সিবিআই করেছে। আমাদের হাত থেকে মামলাটা ইচ্ছা করে কেড়ে নিয়ে চলে গেল।”
“আমরা চেয়েছিলাম নরপিশাচদের, চরমতম শাস্তি হোক।”
একথা বলতে গিয়ে জয়নগর, ফরাক্কা এবং গুড়াপের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন তিনি। তিনটে মামলার তদন্ত করেছে রাজ্য পুলিশ এবং তাদের দেওয়া চার্জশিটের ভিত্তিতে বিচার করে নিম্ন আদালত ফাঁসির সাজা শুনিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “তিনটি কেসেই আমরা ফাঁসির সাজা করিয়ে দিয়েছি। এটা (আরজি কর মামলা) খুব গম্ভীর বিষয়।”