Source : BBC NEWS

অনন্তনাগের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক নারী।

ছবির উৎস, Getty Images

৫২ মিনিট আগে

“আমি ওদের বলেছিলাম, আমাকেও গুলি করো। আমার ছেলেও বলেছিল যে বাবাকে তোমরা মেরে ফেললে, আমাদের দু’জনকেও মারো। কিন্তু হামলাকারীরা বলল, না আমরা তোমাকে মারব না। মোদীকে গিয়ে বল।”

কথাগুলো বলছিলেন পল্লবী রাও। ভারতশাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে মঙ্গলবার বন্দুকধারীদের হামলঅয় তার স্বামী মঞ্জুনাথ রাওয়ের মৃত্যু হয়।

সংবাদমাধ্যম টিভি নাইন কন্নড়ের সঙ্গে কথোপকথনের সময় এই কথাগুলো বলেছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন কীভাবে ছেলে অভিজয় ও তার সামনেই মঞ্জুনাথ রাওকে গুলি করে হামলাকারীরা।

দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের বাসিন্দা মি. রাও পেশায় ছিলেন ব্যবসায়ী। স্ত্রী ও ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কাশ্মীরে বেড়াতে এসেছিলেন। সফরের তৃতীয় দিনে পহেলগামে এসে পৌঁছেছিলেন রাও পরিবার। সেই সময় হামলা চালানো হয়।

মঞ্জুনাথ রাওর বোন রূপা সাংবাদিকদের বলেছেন, “মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে দাদার এক বন্ধু আমাকে ফোন করে বিষয়টা জানিয়েছিল। তাকে হাসপাতালে ভর্তির খবর দিয়েছিল।”

“পরে সংবাদমাধ্যম থেকে (মৃত্যুর বিষয়ে) জানতে পারি। এই প্রথমবার কাশ্মীরে গিয়েছিল ও। এর আগে বাইরে তেমন বেড়াতে যায়নি। আমার ননদ ও ভাইপোর ছুটি ছিল, তাই ওরা বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে।”

পরে বৌদি পল্লবী রাও রূপাকে ফোনে জানিয়েছেন তিনি ও ছেলে অভিজয় নিরাপদে আছেন। আগামী ২৪ এপ্রিল তাদের ফিরে আসার কথা।

পহেলগাম থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত একটা পর্যটন স্পটে মঙ্গলবার এই হামলা চালানো হয়। এই ঘটনায় কমপক্ষে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

আরও পড়তে পারেন
সৈয়দ হুসেন শাহের মা

ছবির উৎস, ANI

“আমরা ন্যায়বিচার চাই”

এই ঘটনায় নিহতদের তালিকায় স্থানীয় একজন বাসিন্দাও রয়েছেন। তার নাম সৈয়দ হুসেন শাহ।

অনন্তনাগের বাসিন্দা এই যুবক পেশায় পোর্টার, ঘোড়ায় সওয়ার হওয়া পর্যটকদের বিভিন্ন দর্শনীয় এলাকা ঘুরিয়ে দেখানোর কাজ করতেন তিনি।

বার্তা সংস্থা এএনআইকে তার মা জানিয়েছেন, হুসেন শাহের আয়েই পরিবারের খরচ চলত।

তার এক আত্মীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “সে পহেলগাম গিয়েছিল কাজে। গতকাল তিনটার দিকে আমরা হামলার খবর পাই। ওকে বারবার ফোন করা সত্ত্বেও ফোনে সাড়া পাইনি। পরে থানায় গিয়ে অভিযোগ দায়ের করি।”

“আমরা ন্যায়বিচার চাই, দোষীদের যেন সাজা হয়।”

বিনয় নারওয়াল

ছবির উৎস, INDIAN NAVY

নিহত ভারতীয় নৌবাহিনীর কর্মকর্তা

পহেলগামে হামলার খবর প্রকাশ্যে আসার পর থেকে সামাজিক মাধ্যমে একাধিক ভিডিও এবং ছবি দেখা গেছে। তারই মধ্যে একটাতে এক নারীকে তার স্বামীর দেহের পাশে শোকস্তব্ধ অবস্থায় বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে।

ওই ছবি সদ্য বিবাহিত বিনয় নারওয়াল এবং তার স্ত্রী হিমাংশীর।

পহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ২৬ বছর বয়সী মি. নারওয়াল। ভারতীয় নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট পদে কর্মরত ছিলেন তিনি।

গত সপ্তাহের ১৬ই এপ্রিল তাদের বিয়ে হয়। রিসেপশন বা বৌভাত ছিল ১৯ তারিখ। কাশ্মীরে মধুচন্দ্রিমায় গিয়েছিলেন এই নবদম্পতি।

তার দাদা (ঠাকুরদা) হাওয়া সিং নারওয়াল সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, “বিয়ের পর সুইজারল্যান্ড যাওয়ার ইচ্ছে ছিল ওর (বিনয় নারওয়ালের)। কিন্তু ভিসা না পাওয়ায় কাশ্মীরে গিয়েছিল।”

ভারত শাসিত কাশ্মীরের ‘মিনি সুইজারল্যান্ড’ হিসেবে পরিচিত পহেলগামের বৈসারণ উপত্যকায় বন্দুকধারীরা মঙ্গলবার হামলা চালায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হামলার সময় বেছে বেছে পুরুষদের নিশানা করা হয়ছিল। বন্দুকধারীদের গুলিতে মি. নারওয়ালের মৃত্যু হয়।

কান্নায় ভেঙে পড়েছেন হিমাংশী নারওয়াল

ছবির উৎস, ANI

ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বছর দুয়েক আগে নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন বিনয় নারওয়াল। বর্তমানে কেরালার কোচিতে তার পোস্টিং ছিল। বিয়ের জন্য ছুটি নিয়ে দিন কয়েক আগে বাড়ি ফিরেছিলেন।

কাশ্মীর থেকে ফিরে আগামী পহেলা মে পরিবারের সঙ্গে নিজের জন্মদিন পালনের পরিকল্পনাও ছিল তার।

হরিয়ানার কার্নালের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। তার এক ছোট বোন রয়েছে। ছেলেকে হারিয়ে শোকস্তব্ধ নারওয়াল পরিবার।

বিনয় নারওয়ালের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে বিবৃতি জারি করা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, “পহেলগামে এই কাপুরুষোচিত হামলায় লেফটেন্যান্ট বিনয় নারওয়ালের মৃত্যুতে নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল দীনেশ ত্রিপাঠি এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর সব কর্মী গভীরভাবে মর্মাহত।”

বুধবার দুপুরে মি. নারওয়ালের দেহ দিল্লি এসে পৌঁছায়। ভারতীয় নৌসেনার পক্ষ থেকে তাকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

নিহত সমীর গুহর শ্যালক

ছবির উৎস, ANI

নিহতদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের তিন জন

এই ঘটনায় নিহতদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের তিনজন রয়েছেন। কলকাতার বৈষ্ণবঘাটার বাসিন্দা বিতান অধিকারী, বেহালার সমীর গুহ এবং পুরুলিয়ার মনীশ রঞ্জনের মৃত্যু হয়েছে বন্দুকদারীদের হামলায়।

বেহালার বাসিন্দা সমীর গুহ স্ত্রী শবরী ও মেয়ের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলেন। স্ত্রী ও মেয়ের সামনেই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সরকারি দফতরে কর্মরত ছিলেন তিনি।

সমীর গুহের শ্যালক সুব্রত ঘোষ সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “গাড়ির চালকের ফোন থেকে আমাকে খবরটা জানিয়েছে দিদি। ওরা আর কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।”

স্ত্রী ও সাড়ে তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে কাশ্মীরে বেড়াতে গিয়েছিলেন বিতান অধিকারী। আগামী ২৪শে এপ্রিল তাদের ফিরে আসার কথা ছিল।

ঘটনার বিষয়ে জানার পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন বিতান অধিকারীর দাদা। সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, “ওরা ১৬ই এপ্রিল কাশ্মীরে গিয়েছিল। বৃহস্পতিবার রাতে ফেরার কথা ছিল। মঙ্গলবারও অনেকবার কথা হয়েছিল ওর সঙ্গে।” কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

নিহতদের মধ্যে রয়েছেন পুরুলিয়ার ঝালদার মণীশ রঞ্জন। পেশায় তিনি আইবি অফিসার (গোয়েন্দা কর্মকর্তা) ছিলেন। পরিবারের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। বন্দুকধারীদের গুলিতে তার মৃত্যু হয়।

হেমন্ত যোশী, সঞ্জয় লেলে এবং অতুল মোনে

“এর চাইতে দুর্ভাগ্যের কিছু নেই”

পহেলগামে হামলায় মহারাষ্ট্রের ছয়জন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। আহতরা চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

থানে জেলার তিন পর্যটক সঞ্জয় লেলে, অতুল মোনে এবং হেমন্ত জোশীর মৃত্যু হয়েছে।

থানের বাসিন্দা সঞ্জয় লেলের বয়স আনুমানিক ৫০ বছর। মুম্বইয়ের একটা ওষুধ সংস্থায় কাজ করতেন তিনি। তার একমাত্র ছেলের বয়স প্রায় ১৮ বছর।

মি. লেলের চাচাতো ভাই কৌশিক লেলে বিবিসি মারাঠিকে বলেন, “আমরা কাল রাতে ঘটনাটা জানতে পারি। কোথাও বেড়াতে গিয়ে যদি এমন ঘটনা ঘটে তাহলে এর চাইতে আর দুর্ভাগ্যের কিছু নেই।”

৪৩ বছর বয়সী অতুল মোনে থাকতেন থানের পশ্চিম ডোম্বিভলি ঠাকুরওয়াড়িতে। দু’দিন আগে তার গোটা পরিবার কাশ্মীরে গিয়েছিল। অতুল মোনে মধ্য রেলের সিনিয়র সেকশন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। স্ত্রী ও ১৮ বছরের মেয়েকে নিয়ে কাশ্মীরে গিয়েছিলেন তিনি।

নিহতদের মধ্যে রয়েছেন পানভেলের বাসিন্দা দিলীপ দেশলে। তার বয়স ৬০ বছর। তার সঙ্গী সুবোধ পাতিলও এই হামলায় আহত হয়েছেন। তিনি আহত অবস্থায় শ্রীনগরের এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

পুনের বাসিন্দা সন্তোষ জাগদলে ও কৌস্তুভ গানবোটের মৃত্যু হয়েছে। মি. জগদালের স্ত্রীর চিকিৎসা চলছে।

হামলার সময় নাগপুরের অন্য এক পরিবারও উপস্থিত ছিল। গুলির শব্দ শুনে তারা পাহাড় থেকে লাফিয়ে পালাতে চেষ্টা করে। ওই পরিবারের সদস্য সিমরণ রূপচন্দানি পড়ে গিয়ে আহত হন। তার পায়ে ফ্র্যাকচার হয়েছে। তার পরিবারের অন্যান্যরা নিরাপদে আছেন।

ঘটনার পর থমথমে পরিবেশ

ছবির উৎস, Getty Images

বিবিসি বাংলায় অন্যান্য খবর

প্রত্যক্ষদর্শীরা যা জানিয়েছেন

পহেলগামে ট্যুরিস্ট পুলিশ হিসেবে কর্মরত স্থানীয় এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, হামলার সময় তিনি ঘটনাস্থল থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে ছিলেন।

সংবাদ সংস্থা এএনআইকে তিনি বলেন, “দুপুর ২.৪০ নাগাদ আমি পর্যটনস্থল থেকে ১০০ মিটার নিচে ওজু করতে আসি। সেই সময় দুই দফা গুলির শব্দ শুনতে পাই এবং এরপর গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়।”

“দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আহত তিনজনকে নিরাপদে জেএমসি হাসপাতালে নিয়ে যাই। এটা পাহাড়ি এলাকা এবং যতক্ষণে সরকারি কর্মীরা এসে পৌঁছন, ততক্ষণে উদ্ধার কাজ শেষ হয়ে গেছে।”

ঘটনাস্থলে উপস্থিত আরেক স্থানীয় বাসিন্দা গুলজার আহমেদ বার্তা সংস্থা পিটিআইকে বলেন, “আমরা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পর্যটকরা ওপরে মিনি সুইজারল্যান্ড-এর দিকে চলে যান। দুপুর ২.৪৫ নাগাদ হঠাৎ হুড়োহুড়ি পরে যায়।”

“লোকজন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি শুরু করে। খোঁজ নিয়ে আমরা জানতে পারি গুলি চলছে। লোকজন খালি পায়ে ছোটাছুটি করছিল। যারা নিচে ছিলেন, তারা সেখান থেকেই ফিরে যেতে শুরু করেন। ঘটনার সময় নিচে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ লোক উপস্থিত ছিল।”

“আতঙ্কের পরিবেশ ছিল। নিচে পার্ক করা গাড়িগুলোয় চেপে মানুষ সেখান থেকে পালাতে থাকেন।”

এই ঘটনায় পর্যটন শিল্প ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। তার কথায়, “এই আক্রমণ অবশ্যই এখানকার পর্যটনকে প্রভাবিত করবে। কারণ এর পরে আমরা যাই করি না কেন, আমরা কখনোই মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পারব না,” তিনি বলেছিলেন।