Source : BBC NEWS

শুক্রবার শেষ রাতে আগুন দেওয়া হয় লক্ষ্মীপুর জেলা নির্বাচন অফিসে

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই একজন সম্ভাব্য প্রার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। একই দিনে গভীর রাতে দেশের দুইটি জেলার উপজেলা নির্বাচন অফিসে আগুনের দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

একই রাতে ঢাকার বাড্ডা এলাকার একটি চলন্ত বাসে আগুনের ঘটনা ঘটে। ঢাকার আগারগাঁওয়ের পাসপোর্ট অফিসেও ঘটেছে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা।

গত বছরের অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরই সারাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে প্রায় দেড় বছর।

এই সময়ের মধ্যেই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার না হওয়া, দলবদ্ধ সহিংসতা বা মবসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নানা দিক নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগও তৈরি হয়।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেই গত ১১ই ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।

তফসিল ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধের ঘটনা কিংবা কয়েকটি জায়গায় অগ্নিসংযোগ ও ককটেলের ঘটনায় আগামী নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকে।

এমন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত বা বানচাল করার যে কোনো ধরনের অপচেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকার “কঠোর হস্তে দমন করবে”।

নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার পরই তা প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়ে ফেসবুক পেজে পোস্ট করেছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ। এদিকে, ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগের কারো কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না তা খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ।

তবে নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানের মাছউদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “প্রতিকূলতা ও চ্যালেঞ্জ আসবে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে যা করার তা আমরা করবো। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন আয়োজন করতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ”।

এ নিয়ে আরো পড়তে পারেন
নির্বাচন কমিশনের বাইরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন পুলিশের কিছু সদস্য

দুইটি জেলায় নির্বাচন অফিসে আগুন

শুক্রবার দুপুরে ঢাকায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। তার সংগঠনের কর্মীরা জানান, তিনি নির্বাচনী প্রচারের কাজ করছিলেন ওইদিনও।

একই দিন রাতে লক্ষ্মীপুর ও পিরোজপুরের দুটি নির্বাচন অফিসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

শুক্রবার রাতে লক্ষ্মীপুর জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে নিচতলার একজন ব্যক্তি আগুন দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে।

ওই সময়কার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, শুক্রবার রাত ৩টা ৫৫ মিনিটের দিকে মাস্ক পরা এক ব্যক্তি কার্যালয়ের দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকছেন। কিছুক্ষণ পর কার্যালয়ের একটি কক্ষে আগুন জ্বলে উঠতে দেখা যায়।

সেই ব্যক্তিও দেয়াল টপকে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্যও ধরা পড়েছে ফুটেজে।

জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ফারুক হোসাইন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “পুরো ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে মাত্র তিন মিনিটে। আমরা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে নিশ্চিত হয়েছি একজন ব্যক্তি মুখে মাস্ক পড়ে এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে”।

মি. হোসাইন জানান, নিচতলার যে কক্ষটি পুড়েছে সেখানে কিছু নথিপত্র পুড়েছে। জানালার গ্লাস ও পর্দা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আগামী নির্বাচন জন্য প্রস্তুতকৃত কোনো নথিপত্রের ক্ষতি হয়নি।

এই ঘটনায় একটি নাশকতার মামলা হয়েছে বলেও জানান এই নির্বাচন কর্মকর্তা।

একই রাতে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়েও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে তাতে খুব সামান্য ক্ষতি হয়েছে বলে জানান উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বাসুদেব সরকার।

মি. সরকার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “শুক্রবার গভীর রাতে মঠবাড়িয়া উপজেলা নির্বাচন অফিসের দুই তলার একটি অফিস কক্ষের জানালার থাই গ্লাস খুলে একটি লাঠির মাথায় একটি কাপড়ে কেরোসিন দিয়ে আগুন দেওয়া হয়। তবে শেষ পর্যন্ত সেই আগুন দ্রুতই নিভে যায়। এ কারণে খুব বেশি ক্ষতি হয়নি।

একই রাতে দুইটি নির্বাচন অফিসে আগুনের ঘটনার পর সারাদেশের নির্বাচন অফিসগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তা ও পুলিশ মোতায়েনের কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আহ্বান জানাই যেন দ্রুত এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়। আমরা দৃঢ়ভবে বলছি গুটিকয়েক নাশকতাকারী বা সন্ত্রাসী এই ধরনের কর্মকাণ্ডের করে নির্বাচনে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারবে না”।

লক্ষ্মীপুর জেলা নির্বাচন অফিসে আগুনের ঘটনায় বেশ কিছু নথিপত্র পুড়ে যায়

ঢাকায় পাসপোর্ট অফিস ও বাসে আগুন

শুক্রবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে ঢাকার আগারগাঁওয়ের পাসপোর্ট অফিসে একটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

পুলিশ জানিয়েছে, একটি মোটরসাইকেলে করে আসা দুর্বৃত্তরা পাসপোর্ট অফিসের মেইন গেটের ভেতরে একটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।

কারা এই ঘটনার সাথে জড়িত সেটি খুঁজতে তৎপরতা শুরু করেছে পুলিশ।

শেরে বাংলা নগর থানার ওসি মো. মনিরুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রাতের বেলায় মোটরসাইকেলে এসে এই ঘটনা ঘটিয়ে তারা পালিয়ে গেছে। তবে এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। আমরা অপরাধীদের শনাক্তে কাজ করছি”।

একই দিন রাতে বাড্ডা লিংক রোডে দেওয়ান পরিবহনের একটি চলন্ত বাসে আগুনের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই নিয়ন্ত্রণে আসে আগুন।

তবে এই ঘটনাটি নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা সেটি এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ।

বাড্ডা থানার ওসি তদন্ত মো. ইয়াসিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা এই ঘটনাটি জানার পর এ নিয়ে তদন্তে নেমেছি। তদন্ত শেষে এ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য আমরা জানাতে পারবো”।

তফসিল ঘোষণার পর আগুন-ককটেল বা বাসে আগুনের মতো ঘটনাগুলো নিয়ে পুলিশ কাজ করছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. বাহারুল আলম।

মি. আলম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বিভিন্ন জায়গায় এই ধরনের ঘটনাগুলো করা হচ্ছে। এটা আমরা দেখছি। পুলিশ এগুলো নিয়ে কাজ করছে”।

তিনি বলেন, “ধরেন ওই জায়গায় আগুন দেওয়া, বাসে আগুন দেওয়া এই জিনিসগুলো শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার পর থেকেই ঘটছে। আমরা অচিরেই মনে হয় এগুলো পুরোপুরি দমিয়ে ফেলতে পারবো”।

“আমরা অলআউট অ্যাফোর্ট দিচ্ছি এগুলোকে দমন করার জন্য। কিছু অপচেষ্টা হচ্ছে, কিছু হবে। তবে আমাদের বিশ্বাস তারা বড় কোনো প্রভাব তৈরি করতে পারবে না”।

বিবিসি বাংলার অন্যান্য খবর
ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনাস্থল ক্রাইমসিন লেখা ফিতা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে

‘অপারেশন ডেভিল হান্ট-ফেইজ-টু’

তফসিল ঘোষণার পরই আইনশৃঙ্খলার এমন পরিস্থিতিতে শনিবার অন্তর্বর্তী সরকার বৈঠক করেছে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সাথে, যেখানে প্রধান উপদেষ্টা দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

প্রায় একই সময় শনিবার আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় সচিবালয়ে। এই সভায় ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণকারীদের গ্রেফতারসহ আগামী নির্বাচনের নিরাপত্তা বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “লুট হওয়া ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলমান রয়েছে। এটিকে আরো জোরদার ও বেগবান করার জন্য এবং ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসীদের দমনের উদ্দেশ্যে কোর কমিটি ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেইজ-২’ অবিলম্বে চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে”।

এর আগে চলতি বছরের আটই ফেব্রুয়ারি থেকে সন্ত্রাস দমন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু করেছিল সরকার।

ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর, গত বছরের জুলাই আন্দোলনের সম্মুখসারিতে যারা ছিলেন তাদের নিরাপত্তা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ওই বৈঠকে। এ জন্য একটি আলাদা কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

এছাড়া আগামী নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করবে তাদের আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নিয়েও নতুন একটি সিদ্ধান্ত হয় এই বৈঠকে।

বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মি. চৌধুরী বলেন, “যারা নির্বাচনে অংশ নেবেন, তারা যদি আগ্নেয়াস্ত্র চান, তাদের লাইসেন্স দেওয়া হবে। এ ছাড়া নির্বাচনে অংশ নিতে যাওয়া যাদের আগ্নেয়াস্ত্র সরকারের কাছে জমা থাকে, সেগুলো ফেরত দেওয়া হবে”।

আগামী ২৫শে ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরার কথা রয়েছে। এমন অবস্থায় তার নিরাপত্তায়ও সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সরকার তারেক রহমানের নিরাপত্তায় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে এবং তার সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে”।