Source : BBC NEWS

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

ছবির উৎস, Getty Images

২ মিনিট আগে

উপহার হিসেবে কাতার ৪০০ মিলিয়ন ডলারের যে বিমান দিতে চাচ্ছে, তা গ্রহণ করতে কতটা উদগ্রীব সে কথা এরইমধ্যে প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

যুক্তরাষ্ট্রে তীব্র রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যেও এ বিষয়ে নিজের পক্ষে অনেককে যুক্ত করতে পেরেছেন তিনি যেটাকে তার জন্য বড় অর্জন হিসেবেই দেখা হচ্ছে। তবে, হোয়াইট হাউজের জন্য অস্বস্তির বিষয় হলো, বিপক্ষেও বড় ঐক্য তৈরি হয়েছে।

কাতারের রাজপরিবারের কাছ থেকে বিলাসবহুল বিমান নেয়ার ইঙ্গিত দেয়ার পর ডেমোক্রেটিক পার্টির অনেকেই ট্রাম্পের সমালোচনা করেছেন। এমনকি চুক্তিটি কার্যকর হওয়ার আগেই এ নিয়ে সমালোচনা করছেন তার অনেক কট্টর সমর্থকও।

বড় মাপের ইনফ্লুয়েন্সাররা (যারা বিভিন্ন ইস্যুতে জনমত গঠন করেন) এই পদক্ষেপকে ‘ঘুষ’, দুর্নীতি কিংবা উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতির উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করছেন, যেখানে অতীতে ট্রাম্প নিজেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার বার্তা দিয়েছেন বহুবার।

কাতারের রাজপরিবার ৪০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বিলাসবহুল বিমান, বোয়িং ৭৪৭-৮ মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগকে দেয়ার পরিকল্পনা করেছে, যা প্রেসিডেন্টের বিমান ভ্রমণের আনুষ্ঠানিক মাধ্যম হিসেবে পরিচিত ‘এয়ার ফোর্স ওয়ান’ বহরের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

বর্তমানে এই বহরে ১৯৯০ সাল থেকে ব্যবহৃত দুটি ৭৪৭-২০০ জেট এর পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ছোট এবং অপেক্ষাকৃত গোপনীয় ৭৫৭ বিমানও রয়েছে।

হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, নতুন বিমানটি- সংস্কার ও আপগ্রেড করতে বছরের পর বছর সময় লাগতে পারে এবং লাখ লাখ ডলার খরচ হতে পারে। তাই ট্র্রাম্পের মেয়াদ শেষে তা প্রেসিডেন্টের সংরক্ষণাগারে স্থানান্তর করা হবে।

কাতারের আমিরের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প

ছবির উৎস, Reuters

রবিবার খবরটি সামনে আসতেই এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেয়া যায়।

রক্ষণশীল ডেইলি ওয়্যারের বক্তা বেন সাপিরো তার পডকাস্টে বলেন, “আমি মনে করি, বিষয়টি ‘ন্যক্কারজনক’। কাতার কেবল নিজেদের মনের খুশির জন্যই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বিমানটি দিচ্ছে না, দ্বিপাক্ষিক উপায়ে নিজেদের পকেটে অর্থ ঢোকানোর চেষ্টাও রয়েছে তাদের।”

তিনি এবং অন্য অনেকে, কাতারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পেছনে অর্থ ঢালার পুরানো অভিযোগ তুলে ধরেন এবং কাতারিদের “আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সন্ত্রাসবাদের বৃহৎ সমর্থক” বলেও অভিহিত করেছেন, যেসব অভিযোগ দেশটি অস্বীকার করে আসছে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রভাবশালী আলোচক লরা লুমার, যিনি কিনা হোয়াইট হাউজের অপেক্ষাকৃত কম অনুগত শীর্ষ কর্মকর্তাদের বরখাস্তের দাবিতে আন্দোলন করছেন, তিনিও এই পদক্ষেপের সমালোচনা করার জন্য ট্রাম্প-পন্থি বার্তাগুলির উন্মুক্ত প্রবাহকে দায়ী করেছেন।

প্রেসিডেন্টকে এখনো সমর্থন করার কথা বললেও বিমান চুক্তিকে তিনি ‘একটি দাগ’ হিসেবেই উল্লেখ করছেন। তিনি সশস্ত্র ইসলামপন্থি জঙ্গিদের দ্বারা পূর্ণ একটি বিমানের কার্টুন পোস্ট করেছেন যেটিকে ‘ট্রোজান হর্স’ বলে বোঝানো হচ্ছে।

আরো পড়তে পারেন:
এয়ারফোর্স ওয়ানের একটি বিমান

ছবির উৎস, Getty Images

বিমান উপহার নেওয়ার পরিকল্পনার জন্য মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছ থেকেও খুব কম সমর্থন পেয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

নিউ ইয়র্ক পোস্ট, যাদেরকে আড়ালে ট্রাম্পের সমর্থক হিসেবে বিবেচনা করেন অনেকে, তারাও স্পষ্ট সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে, “কাতারের জেট ‘বিনামূল্যের উপহার’ নয় – এবং ট্রাম্পেরও উচিত হবে না এটিকে উপহার হিসেবে গ্রহণ করা”।

এছাড়া, ফক্স নিউজ এবং নিজের আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্টের ধারাবাহিক প্রশংসাকারী হিসেব পরিচিত মার্ক লেভিন- এক্স এ দেয়া এক বার্তায় কাতারকে “সন্ত্রাসী রাষ্ট্র” হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন।

তিনি লেখেন, “বিমান ও অন্যান্য জিনিস যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনার মাধ্যমে যে সমর্থন তারা খুঁজছে, তা তারা পাবে না।”

নিজের প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প নিজেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলিকে অর্থায়নের জন্য কাতারকে অভিযুক্ত করেছিলেন।

ওয়াশিংটনের কাতার দূতাবাসে বিবিসি যোগাযোগ করলে, বিমান সম্পর্কে সিএনএনকে দেওয়া কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান বিন জসিম আল-থানির একটি সাক্ষাৎকারের দিকে ইঙ্গিত করা হয়।

যেখানে তিনি বলেন, “এটি দুই দেশের সরকারের মধ্যে হওয়া লেনদেন। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা কাতার কোনো পক্ষেরই ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোনো যোগসূত্র নেই”। এর পুরোটাই দুই দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বলেও জানান তিনি।

তার মতে, “কাতার সবসময়ই একটি নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বস্ত অংশীদার। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কিনে নেওয়ার মতো কোনো কারণ নেই। কারণ এটি একমুখী সম্পর্ক নয়।”

বিমান চুক্তির এসব সমালোচনার জবাবে হোয়াইট হাউসও দ্বিগুণ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ট্রাম্পের প্রেস সচিব ক্যারোলিন লিভিট এক বিবৃতিতে বলেছেন, প্রশাসন “পূর্ণ স্বচ্ছতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ”।

তিনি বলেন, “বিদেশি সরকারের কাছ থেকে যেকোনো উপহার সব সময় প্রয়োজনীয় সব আইন মেনেই গ্রহণ করা হয়।”

যদিও বিমানের বিনিময়ে কোনো কিছুই লেনদেনের বিষয়টি সামনে আসেনি, তবুও অনেকে বলেছেন, কোনো শর্ত বা আশা ছাড়াই কাতারের রাজপরিবার এত বিশাল উপহার দেবে এমনটা আশা করা বোকামি হবে।

আরো পড়তে পারেন:
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি

ছবির উৎস, Getty Images

রাজনৈতিক কৌশলবিদ ও রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির সাবেক যোগাযোগ পরিচালক ডগ হেই বিবিসিকে বলছেন, “স্পষ্টতই দেখা গেছে, আপনি যদি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে উপহার দিয়ে পুরস্কৃত করেন, তাহলে তা ভবিষ্যতে লাভজনক হতে পারে। চাটুকারিতার মাধ্যমে আপনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের দৃষ্টিতে একটি পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবেন এবং এর উদাহরণ বারবার দেখা গেছে।”

মার্কিন সংবিধানে একটি ধারা রয়েছে যা দেশটির কর্মকর্তাদের “যেকোনো দেশের রাজা, যুবরাজ বা বিদেশি রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনো ধরনের উপহার, বেতন, খেতাব” গ্রহণে বাধা দেয়।

কিন্তু হোয়াইট হাউস উল্লেখ করছে- “বিমানটি উপহার দেওয়া হচ্ছে মার্কিন সরকারকে”।

এই চুক্তির বৈধতা নিয়ে তদন্ত করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি। তার মতে, কোনো স্পষ্ট শর্ত জুড়ে না দেয়ায় এটি ঘুষ হিসেবে গণ্য করা ঠিক হবে না।

যদিও এরপর রক্ষণশীল এবং অন্যান্যরা অভিযোগ করেন, ট্রাম্পের মন্ত্রিসভায় যোগদানের আগে বন্ডি কাতারের লবিস্ট হিসেবে নিবন্ধিত ছিলেন এবং কিছু ক্ষেত্রে কাতারি সরকারের হয়ে কাজ করে মাসে এক লাখ ১৫ হাজার ডলার পর্যন্ত আয় করতেন।

ট্রাম্প অর্গানাইজেশনও কাতারের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং গেল মাসে দেশটিতে একটি বিলাসবহুল গল্ফ রিসোর্ট নির্মাণের জন্য একটি চুক্তিও ঘোষণা করেছিল।

গেল মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে, এই লেনদেনের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে রাষ্ট্রপতির তিরস্কারের শিকার হন সাংবাদিক। এবিসির প্রতিবেদক র‍্যাচেল স্কট প্রশ্ন করেছিলেন, “যারা বিলাসবহুল বিমানটিকে আপনার জন্য ব্যক্তিগত উপহার হিসেবে দেখেন, তাদেরকে আপনি কী বলবেন?”

বিষয়টিকে “ভুয়া খবর” বলে ব্যঙ্গ করে ট্রাম্প উত্তর দেন, “এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে আপনার লজ্জা হওয়া উচিত”।

ট্রাম্প বলেন, “তারা আমাদেরকে বিনামূল্যে বিমানটি দিচ্ছে। আমি বলতে পারি না- আমাদের দেবেন না, আমি আপনাকে এক বিলিয়ন বা ৪০ কোটি ডলার দিতে চাই’… অথবা আমি বলতে পারি ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ’।”

পরবর্তীতে ট্রুথ সোশ্যালে, বেশ কয়েকটি বার্তা পুনরায় পোস্ট করেন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প। যেখানে তিনি, স্ট্যাচু অব লিবার্টি ফ্রান্সের একটি উপহার বলেও উল্লেখ করেন।

এরপর মঙ্গলবার গভীর রাতে তিনি লেখেন, “বোয়িং ৭৪৭ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী/প্রতিরক্ষা বিভাগকে দেওয়া হচ্ছে, আমাকে নয়!”

ট্রাম্প লিখেছেন, “দেশের পক্ষ থেকে কেবল একজন বোকাই এই উপহার গ্রহণ অস্বীকার করবে”।

যদিও ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির অনেকেই বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

কেন্টাকির রিপাবলিকান সিনেটর র‍্যান্ড পল ফক্স নিউজকে বলেছেন “এটি যথার্থ হবে না, কারণ এখানে অসঙ্গতি রয়েছে। এই বিশাল উপহারের কারণে কাতারের মানবাধিকারের নথি বিচার করতে আমাদের ক্ষমতা ম্লান হবে কিনা তা নিয়ে ভাবছি।”

টেক্সাসের আরেক রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ বলেছেন, উপহার গ্রহণ করলে “গুরুত্বপূর্ণ গুপ্তচরবৃত্তি এবং নজরদারি সমস্যা” তৈরি হবে।

অবশ্য ট্রাম্প তার দলের মধ্যে কিছু সমর্থনও পেয়েছেন। সেন টমি টিউবারভিল সিএনএনকে বলেন” এই ধরনের জিনিস কেনার জন্য আমাদের কাছে এখন খুব বেশি টাকা নেই”।

এই চুক্তি দীর্ঘমেয়াদে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার ক্ষতি করবে না বলেই মন্তব্য করেছেন, রিপাবলিকান কৌশলবিদ ডগ হেই।

তিনি বলছেন, “ট্রাম্প বছরের পর বছর এমন কেলেঙ্কারি এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন, যার অনেকগুলো মানুষ ভুলেই গেছে। কিন্তু এটি অন্য রাজনীতিবিদদের জন্য ক্ষতির কারণ হতো। তিনি এক্ষেত্রে খুবই দক্ষ।”