Source : BBC NEWS

ছবির উৎস, Getty Images
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনের সড়ক আটকে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান কর্মসূচির পরই দলটির কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের ঘােষণা আসে এ সপ্তাহেই। তার পর থেকে রাজধানী ঢাকার সড়কজুড়ে নানা দাবিতে বিক্ষােভের সংখ্যা বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন অনেকে।
গতকাল বুধবার ঢাকার অন্তত দুটি জায়গায় সড়ক আটকে বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষােভ চলেছে।যমুনার সামনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং শাহবাগে নার্সিং শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচিতে অনেকটাই অচল হয়ে পড়ে ঢাকা।
আজ বৃহস্পতিবারও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কাকরাইল মোড়ে আর ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়রের দায়িত্ব দেওয়ার দাবিতে নগর ভবনের সামনে সড়ক অবরোধ করে রাখা হয়।
এর আগে, সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের দেশ ছাড়ার খবর আসার পর আটই মে রাতে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেন এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ।
পরে এনসিপিসহ ইসলামপন্থি বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীরা এতে যোগ দেন। পরে অবস্থান কর্মসূচি শাহবাগে নিয়ে আসা হয়।
এর পরপরই, গত ১০ই মে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা, বাংলাদেশ সচিবালয় এবং আশপাশের এলাকায় সব ধরনের সভা-সমাবেশ, গণজমায়েত, মিছিল ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে গণবিজ্ঞপ্তি দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশ-ডিএমপি। তবে এতে নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত রাখা হয় শাহবাগকে।

ছবির উৎস, Getty Images
তবে সেই আদেশ না মেনে দাবি আদায়ে বুধবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা অভিমুখে লংমার্চ শুরু করলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়।
আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে একপর্যায়ে ব্যবহার করা হয় কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান।
এই ঘটনায় বুধবার রাতে কাকরাইলে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলতে এলে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে লক্ষ্য করে একটি পানির বোতল ছুড়ে মারার ঘটনা ঘটে, যা নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা।
পরে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে উপদেষ্টা জানান, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার পাশে আন্দোলন করতে দেয়া হবে না এবং এবিষয়ে সরকার কঠোর ভূমিকায় যাবে।
এরপর থেকেই আন্দোলনের পক্ষভেদে সরকারের পৃথক অবস্থান নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
কারণ এর আগে প্রজ্ঞাপন থাকা সত্ত্বেও অর্থাৎ সরকারি সিদ্ধান্ত না মেনে এনসিপি নেতাদের অবস্থান কর্মসূচিতে বাধা দেয়ার পরিবর্তে সমাবেশে ওয়াসাকে খাবার পানি বিতরণ করতে এবং গরম আবহাওয়ায় পরিবেশ শীতল করতে সিটি করপোরেশনের গাড়ি দিয়ে পানি ছিটাতে দেখা যায়।
ফলে কোনো আন্দোলনে কেন সরকারের ‘সদয় আচরণ’ আর কোনো আন্দোলনে কেন বলপ্রয়োগ, উঠছে এমন প্রশ্নও।

ছবির উৎস, SRS ALI
উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের মাথায় বােতল নিক্ষেপ
মঙ্গলবার বেশ কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধি দল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বা ইউজিসিতে যায়।
কিন্তু সেখান থেকে আশানুরূপ কোনো ঘোষণা না আসায় তিন দফা দাবিতে পরদিন ‘লংমার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা।
বৃহস্পতিবার লংমার্চ শুরু করলে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে তাতে বাধা দেয়। পরে ব্যারিকেড ভেঙে শিক্ষার্থীরা এগোতে চাইলে তাদের ওপর পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান ব্যবহার করলে এতে প্রায় অর্ধশত শিক্ষক-শিক্ষার্থী আহত হন বলে জানান আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
পরে দাবি আদায়ে কাকরাইল মোড়েই অবস্থান নেন তারা। রাত ১০টার দিকে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন।
এসময় আন্দোলনকারীরা “ভুয়া ভুয়া” বলে স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে উপদেষ্টাকে লক্ষ্য করে একটি পানির বোতল ছুড়ে মারা হয়।
এসময় কথা বলবেন না জানিয়ে সেই জায়গা থেকে তিনি চলে যান। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
এসময় তিনি বলেন, “আপনাদের ন্যায্য দাবি সরকার শুনতে রাজি। আমি গতকাল রাতেও মিটিংয়ের জন্য রাজি ছিলাম। আজকে রাতে ৯টার সময় আমার সাথে মিটিং হওয়ার কথা ছিল। আগামীকাল সকালে মিটিং হওয়ার কথা ছিল। কীভাবে হুট করে এই মিছিলটা সেই পুরান ঢাকা থেকে কাকরাইল পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে আমরা জানি না।”
“আমরা শুধু এটুকু বলতে চাই, আজ থেকে ‘চল চল যমুনায় যাই’ – এই রাজনীতি, এই মুভমেন্ট আমরা আর হতে দেবো না। আমরা এই ক্ষেত্রে স্ট্রিক্ট (কঠোর) ভূমিকায় অবতীর্ণ হবো। যথেষ্ট হয়েছে,” বলেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।

ছবির উৎস, Getty Images
প্রশ্ন উঠছে সরকারের অবস্থান নিয়ে
১০ই মে’র আগে গত ১৩ই মার্চ সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের আশপাশের এলাকায় সব ধরনের গণজমায়েত, মিছিল ও সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। তারপরও এসব এলাকায় জমায়েত করতে দেখা গেছে।
এরমধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল গত আটই মে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে এনসিপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের অবস্থান।
সেসময়ও সরকারের আদেশ অমান্য করে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। বরং সরকারের পক্ষ থেকেই আন্দোলনকারীদের জন্য নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। ফলে অনেকেই সরকারের এই অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
এনিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. সাব্বির আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এনসিপির প্রতি সরকারের সদয় আচরণের কারণ খুব স্পষ্ট। এনসিপি তাদের আশীর্বাদপুষ্ট কিংস পার্টি- এটা বললে ভুল হবে না। কিন্তু জগন্নাথের আন্দোলন তো সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট না।”
ফলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আইন লঙ্ঘন করলে সরকার তাদের প্রতি সদয় আচরণ না করাটাই স্বাভাবিক–– বলে মন্তব্য করেন এই বিশ্লেষক।
“এই যে একেক সময়ে একেক আচরণ, এই যে দ্বিচারিতা – এটা আসলে এই সরকারও শিখে গেছে পূর্বের সরকারের মতো,” বলেন অধ্যাপক আহমেদ।
তবে এক্ষেত্রে আন্দোলনের যৌক্তিকতার দিকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন।
তিনি বলেন, “এনসিপির দাবির সাথে আমরা সবাই একমত। আমরা তো এটা চাচ্ছিলামই। সুতরাং ওটা যৌক্তিক একটা আন্দোলন ছিল।”
অন্যদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আগে থেকেই প্রশাসন অবগত। ফলে “যেটা প্রসেসে আছে সেটার জন্য একদিন হুট করে আন্দোলন করা ঠিক না” বলেই মনে করেন তিনি।
যদিও অধ্যাপক আহমেদের বলছেন, মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি ছেলের জন্য ঢাকায় বাড়ি ভাড়া করে থাকার মতো অবস্থা নেই। ফলে “এটাকে আরও যৌক্তিক দাবি” উল্লেখ করে আরও সহানুভূতির সাথে দেখা দরকার ছিল” বলেই মত তার।
এবিষয়ে সরকারের অবস্থান জানতে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

এনসিপির আন্দোলনের পর সড়ক অবরোধ করে দাবি আদায়ের প্রবণতা বেড়েছে?
গত বছর অগাস্টে সরকার পতনের পরপরই দাবি-দাওয়া আদায়ে সড়ক অবরোধের প্রবণতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে যায়।
নানা দাবিতে পেশাজীবীসহ বিভিন্ন সংগঠনকে সড়কে নেমে আন্দোলন করতে দেখা যায়।
এসময় টিয়ার গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেয়ার নানা ঘটনাও আসে গণমাধ্যমে।
তবে সময়ের সঙ্গে বিষয়গুলো কিছুটা কমে আসতে দেখা যায়। বিশেষ করে দাবি আদায়ে নানা ধরনের আন্দোলন চলমান থাকলেও সড়ক অবরোধের প্রবণতা কমে আসে।
তবে এবার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে এনসিপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথমে যমুনা আর তারপর শাহবাগের অবরোধের পর থেকে এই প্রবণতা আবারও বাড়তে দেখা গেছে।
বিশেষ করে গত ৯ই মে শুক্রবার বিকেল থেকে পরদিন শনিবার সারাদিন শাহবাগ অবরোধ করে রাখে এনসিপি।
পরদিন রোববার তিন দফা দাবিতে প্রায় ১৭ ঘণ্টা একই মোড় অবরোধ করে রাখে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে আহতরা।
গতকালও (১৪ই মে) প্রায় ছয় ঘণ্টা শাহবাগ মোড় অবরোধ করে আন্দোলনরত নার্সিং শিক্ষার্থীরা। আর যমুনা অভিমুখে যাওয়ার চেষ্টা করলেও পুলিশের বাধার মুখে কাকরাইলেই অবস্থান নেয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
এ নিয়ে অধ্যাপক আহমেদ বলেন, “এনসিপি তো এই মডেল শিখিয়ে দিয়েছে যে যমুনার সামনে যদি অবরোধ করা যায় তাহলে দাবি আদায় করা সহজ। স্বাভাবিকভাবেই অন্যরা এটা ফলো করবে। সুতরাং মানুষের মধ্যে যে এই পারসেপশন তৈরি হয়েছে, এটা তো ভিত্তিহীন না। এটার বাস্তব ভিত্তিতো আছেই।”
একইসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনা আগে দেখা যায়নি বলেও মন্তব্য করেন অধ্যাপক আহমেদ। বরং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে।
কিন্তু বলপ্রয়োগের বর্তমান প্রেক্ষাপটের সঙ্গে আগের সরকারের ‘কায়দা’ মিলে যাচ্ছে এবং “একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে” বলেই মনে করছেন এই বিশ্লেষক।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “আগের সরকার যেভাবে ফ্যাসিস্ট কায়দায় আচরণ করেছে, এই সরকারও যদি একই কায়দায় আচরণ করে তাহলে তাদের (আওয়ামী লীগ সরকার) সঙ্গে এদের তো (অন্তর্বর্তী সরকার) আচরণগত পার্থক্য থাকে না।”

ছবির উৎস, RIAZ RAIHAN
সমাধান কী?
এই পুরো ঘটনার কারণ হিসেবে “চরম সমন্বয়হীনতাকেই” দেখছেন অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ, যা তার মতে এই সরকারের “স্থায়ী বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে”।
“আপনি যত ভিজিবল (দৃশ্যমান) থাকবেন, যত অ্যাক্টিভ (সক্রিয়) থাকবেন, আপনার গুরুত্ব তত বেশি বাড়বে। কিন্তু এটা কোনো স্থায়ী সমাধান না,” বলেন তিনি।
ফলে পুরো বিষয়টিকে প্রক্রিয়ার মধ্যে আনতে হবে বলেই মত এই বিশ্লেষকের। আর সেক্ষেত্রে নির্বাচনকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে দেখছেন তিনি।
“আল্টিমেট সমাধান হলো একটা নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে দিলেন,” বলেন অধ্যাপক আহমেদ।
একইসঙ্গে শিক্ষাঙ্গনে প্রতিনিধিত্বমূলক ছাত্র সংসদ করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন অধ্যাপক আহমেদ।
তিনি বলেন, “তাহলে এই ধরনের জমায়েত করার প্রবণতা কমে আসবে”।