Source : BBC NEWS
তিন দশক আগে, বিশ্ব এক পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল, কিন্তু জিমি কার্টারের উত্তর কোরিয়া সফর সবকিছু বদলে দেয়।
১৯৯৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার, উত্তর কোরিয়ার তৎকালীন নেতা কিম ইল সাং এর সঙ্গে আলোচনার জন্য পিয়ংইয়াংয়ে পৌঁছান।
এটি ছিল এক নজিরবিহীন ঘটনা, কারণ ওইবারই প্রথমবার কোনো বর্তমান বা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট উত্তর কোরিয়া সফর করেছিলেন।
এই সফর ছিল কার্টারের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপের একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। অনেকের মতে, এটি অল্পের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ এড়াতে সাহায্য করেছিল, যা লাখ লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নিতে পারত।
এছাড়া, এটি পিয়ংইয়াং ও পশ্চিমাদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের একটি যুগের সূচনা করেছিল। এর কোন কিছুই হতো না যদি না মি. কার্টার, তার কূটনৈতিক চালগুলো চালতেন।
জিমি কার্টার ২০২৪ সালের ২৯শে ডিসেম্বর ১০০ বছর বয়সে মারা যান।
উত্তর কোরিয়া বিশেষজ্ঞ জন ডেলুরি বিবিসিকে বলেন, “কিম ইল-সাং এবং বিল ক্লিনটন একটি সম্ভাব্য সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন এবং কার্টার সেই ফাঁকা স্থানটি পূরণ করেন। সঠিক সময় এগিয়ে এসে সফলভাবে একটি আলোচনার পথ খুঁজে বের করেন তিনি” ।
১৯৯৪ সালের শুরুর দিকে, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করা নিয়ে দুই দেশের আলোচনা চলাকালীন ওয়াশিংটন ও পিয়ংইয়াং- এর মধ্যে উত্তেজনা চরমে ওঠে।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সন্দেহ ছিল যে চলমান আলোচনা সত্ত্বেও, উত্তর কোরিয়া গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছিল।
এর মধ্যেই উত্তর কোরিয়া ঘোষণা করে যে তারা ইয়ংবিয়ন পারমাণবিক চুল্লি থেকে হাজার হাজার জ্বালানি রড পুনঃপ্রক্রিয়ার জন্য সরিয়ে নিতে শুরু করেছে।
এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার আগে হওয়া একটি চুক্তির লঙ্ঘন, যেখানে এমন পদক্ষেপের জন্য আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) পরিদর্শকদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক ছিল।
এছাড়াও, উত্তর কোরিয়া আইএইএ থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়।
এতে ওয়াশিংটনের সন্দেহ বেড়ে যায়, তাদের ধারণা ছিল যে পিয়ংইয়াং সম্ভবত একটি অস্ত্র তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। এতে মার্কিন কর্মকর্তারা পিয়ংইয়াং এর সঙ্গে আলোচনা বন্ধ করে দেন।
ওয়াশিংটন প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিতেও শুরু করে, যার মধ্যে ছিল জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি।
পরবর্তীতে কিছু সাক্ষাৎকারে, মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন যে তারা ইয়ংবিয়নে বোমা ফেলা বা একটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার কথাও ভেবেছিলেন।
যা কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধ বাধানোর পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সওল ধ্বংস করে দিতে পারতো বলে তাদের ধারণা। এই উত্তেজনাকর পরিবেশেই কার্টার তার পদক্ষেপ নেন।
কিম ইল-সাং বহু বছর ধরে ব্যক্তিগতভাবে কার্টারকে উত্তর কোরিয়ায় আমন্ত্রণ জানিয়ে আসছিলেন।
১৯৯৪ সালের জুন মাসে, যখন কার্টার ওয়াশিংটনের সামরিক পরিকল্পনার কথা শুনলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও চীনের (উত্তর কোরিয়ার প্রধান মিত্র) সঙ্গে আলোচনা করলেন, তখন তিনি অবশেষে কিমের আমন্ত্রণ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন।
কার্টার বিবিসিকে বলেন, “আমরা যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ছিলাম”।
তিনি পরবর্তীতে মার্কিন সংবাদ মাধ্যম পিবিএসকে বলেন, “এটি দ্বিতীয় কোরীয় যুদ্ধে পরিণত হতে পারত, যেখানে দশ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারত। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষতিকর পদার্থের উৎপাদন চলতে থাকত, যদি আমাদের যুদ্ধ না হত।”
কার্টারের সফরটি ছিল কূটনৈতিক কৌশল এবং ঝুঁকি নেওয়ার একটি চমৎকার উদাহরণ। ওই সফরের সময় কার্টার তার কূটনৈতিক দক্ষতা ও সাহসিকতার পরিচয় দেন।
কার্টার প্রথমে কিম ইল সাং এর আন্তরিকতা যাচাই করতে একাধিক শর্ত দিয়েছিলেন, যার মধ্যে শেষটা ছাড়া সব দাবিই মেনে নেন কিম।
কার্টারের শর্তের মধ্যে ছিল তিনি দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ডিমিলিটারাইজড জোন (ডিএমজেড) পাড়ি দিয়ে পিয়ংইয়াং যাবেন।
ডিএমজেড এমন এক ভূখণ্ড, যা দুই কোরিয়ার মধ্যে একটি বাফার জোন হিসেবে কাজ করে।
কার্টার সে সময় বলেছিলেন, “তাদের (পিয়ংইয়াং) প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল যে গত ৪৩ বছর কেউ এমনটা করেনি, এমনকি জাতিসংঘের মহাসচিবকেও পিয়ংইয়াংয়ে যেতে বেইজিংয়ের মাধ্যমে যেতে হয়েছিল। আমি বললাম, ঠিক আছে, ‘তাহলে আমি যাব না’,”
কিম প্রথমে এতে রাজি না হলেও এক সপ্তাহ পর তার শর্ত মেনে নেন।
কার্টারের পরবর্তী পদক্ষেপটি ছিল আরও কঠিন – তার উত্তর কোরিয়ায় যাওয়ার ব্যাপারে নিজের সরকারকে রাজি করানো।
উত্তর কোরিয়া বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মধ্যস্থতাকারী রবার্ট গ্যালুচি পরে বলেছিলেন, যে “একজন সাবেক প্রেসিডেন্টের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ছেড়ে দেওয়া নিয়ে সবাই অস্বস্তি বোধ করছিল”।
প্রথমে কার্টার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি চাইলে, তারা তাকে কোন সাড়া দেয়নি। কিন্তু তিনি দমে না গিয়ে, সরাসরি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে জানিয়ে দিলেন যে তিনি যাচ্ছেন, তা যা-ই হোক না কেন।
ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর তার সহায়ক হিসেবে সামনে আসেন, যিনি ক্লিনটনের কাছে পাঠানো কার্টারের বার্তা গ্রহণ করেন।
“[আল গোর] আমাকে ফোন করে বলেছিলেন যে আমি যদি ‘আমি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি’ বাক্যটি পরিবর্তন করে ‘আমি যাওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছি’ করি, তবে তিনি ক্লিনটন থেকে সরাসরি অনুমতি নিয়ে আসবেন… তিনি পরের দিন সকালে আমাকে ফোন করে জানান যে আমি যেতে পারব।”
অবশেষে সফরের অনুমতি মেলে।
গভীর সংশয়
১৯৯৪ সালের ১৫ই জুন, কার্টার তার স্ত্রী রোজালিন, একটি ছোট দল ও টিভি ক্রু নিয়ে উত্তর কোরিয়া পাড়ি জমান।
কিমের সঙ্গে দেখা করা ছিল কার্টারের জন্য একটি নৈতিক দোলাচল।
“আমি ৫০ বছর ধরে কিম ইল সাংকে ঘৃণা করতাম। আমি কোরীয় যুদ্ধের সময় প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি সাবমেরিনে ছিলাম, এবং আমার অনেক সহকর্মী সেই যুদ্ধে মারা গিয়েছিল, আমি মনে করি এটা তার অযথা উস্কানির কারণে হয়েছিল,” তিনি পিবিএসকে বলেছিলেন।
“তার ব্যাপারে আমার অনেক সন্দেহ ছিল। কিন্তু যখন আমি সেখানে পৌঁছালাম, তিনি আমাকে অত্যন্ত সম্মানজনকভাবে অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি বেশ কৃতজ্ঞ ছিলেন যে আমি এসেছি।”
তার পরের কয়েকদিন, কার্টার এবং তার প্রতিনিধিরা কিমের সঙ্গে বৈঠক করেন, পিয়ংইয়াংয়ের একটি দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করেন এবং কিমের ছেলে কিম জং ইলের মালিকানাধীন একটি বিলাসবহুল প্রমোদতরীতে (ইয়ট) সফর করেন।
কার্টার বুঝতে পারেন, তার ধারণাই ঠিক ছিল: উত্তর কোরিয়া ইয়ংবিয়ন পারমাণবিক স্থাপনার ওপর মার্কিন সামরিক আক্রমণের ভয় পাচ্ছিল না, বরং তারা যুদ্ধের জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
“আমি কিমের উপদেষ্টাদের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চেয়েছিলাম তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন কিনা। তারা খুব স্পষ্টভাবে জানিয়েছিল, ‘হ্যাঁ, আমরা তা করছিলাম’,” তিনি বলেন।
“উত্তর কোরিয়া তাদের দেশকে নিন্দিত হতে এবং তাদের নেতার অপমানিত হওয়া নিতে পারছিল না এবং তারা এর জবাব দিতে প্রস্তুত ছিল।”
“আমি মনে করি, এই ছোট এবং আত্মত্যাগী দেশটির মানুষেরা তাদের দেশের নিন্দা এবং তাদের সম্মানিত নেতা যাকে তারা ‘গ্রেট লিডার’ হিসেবে ডাকে তার অপমান সহ্য করতে পারছিল না”।
“নিজেদের সম্মান এবং অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য যে উত্তর কোরিয়ার মানুষ মৃত্যুসহ যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিল, যা আমার মতে এক ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারত,” তিনি বলেন।
কার্টার ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে কিছু দাবি এবং নিজের কিছু প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। এর মধ্যে ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা পুনরায় শুরু করা, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সরাসরি শান্তি আলোচনা শুরু করা, একে অপরের দেশ থেকে সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করা এবং উত্তর কোরিয়ার ভূখণ্ডে সমাহিত মার্কিন সেনাদের দেহাবশেষ উদ্ধার করার উদ্যোগ নেয়া।
“কিম সব শর্ত মেনে নেন তাই, তাকে আমার খুব সহযোগিতাপূর্ণ বলে মনে হয়েছে,” কার্টার বলেন। “যতদূর আমি জানি তখন এবং এখন, তিনি আমার সঙ্গে পুরোপুরি সৎ ছিলেন।”
কার্টার একটি চুক্তির প্রস্তাব করেন, যেখানে উত্তর কোরিয়া তার পারমাণবিক কার্যক্রম বন্ধ করবে এবং আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) পরিদর্শকদের তাদের রিঅ্যাকটরগুলো দেখতে দেবে। সেইসাথে ইয়ংবিয়নের পারমাণবিক সুবিধাগুলো ভেঙে ফেলবে।
তার বদলে, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা উত্তর কোরিয়ায় লাইট-ওয়াটার রিয়্যাক্টর নির্মাণ করবে, যা পারমাণবিক শক্তি উৎপন্ন করতে পারবে, কিন্তু অস্ত্র তৈরির কোনো উপকরণ তৈরি করতে পারবে না।
পিয়ংইয়াং চুক্তিটিকে উত্সাহের সঙ্গে গ্রহণ করলেও এটি মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে তেমন উদ্দীপনা জাগাতে পারেনি। কার্টার টেলিফোনে চুক্তিটির বিস্তারিত মার্কিন কর্মকর্তাদের জানানোর পর তারা সংশয়ের মধ্যে ছিলেন।
এরপর, তিনি ক্লিনটন প্রশাসনকে জানিয়ে দেন যে তিনি সিএনএন-এ গিয়ে চুক্তির বিস্তারিত ঘোষণা করবেন – – যা ক্লিনটন প্রশাসনকে চুক্তি মেনে নিতে বাধ্য করেছিল।
পরে কার্টার এই সিদ্ধান্তকে ন্যায্যতা দিয়ে বলেন, তিনি “অত্যন্ত গুরুতর সংকট সমাধান করতে বাধ্য হয়েছেন।” তবে তার দেশ এটি ভালোভাবে গ্রহণ করেনি – মার্কিন কর্মকর্তারা কার্টারের “স্বেচ্ছাচারী” আচরণ এবং ক্লিনটনকে “জোর করার চেষ্টা” করার জন্য বিরক্ত হয়েছিলেন, গ্যালুচি বলেছিলেন।
সফরের শেষ দিকে, কর্মকর্তারা তাকে উত্তর কোরীয়দের কাছে একটি বার্তা পৌঁছানোর জন্য বলেছিলেন।
বার্তায় জানাতে হবে যে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রাখার জন্য আগ্রহী। যাতে জনসাধারণের সামনে ক্লিনটনের অবস্থান পুনরুদ্ধার করা যায়। কিন্তু কার্টার এতে রাজি হননি, তখনকার রিপোর্টগুলো এমনটাই জানায়।
এর কয়েক ঘণ্টা পর, কার্টার কিমের সঙ্গে একটি নৌকা সফরে বের হন এবং কথা বলার সময় পূর্বনির্ধারিত বক্তব্য থেকে সরে যান।
টিভি ক্যামেরার সামনে, তিনি কিমকে বলেন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার খসড়া তৈরির কাজ বন্ধ করে দিয়েছে – যা ক্লিনটনের অবস্থানের পুরো বিপরীত।
হোয়াইট হাউস এতে ক্ষুব্ধ হয়ে কার্টার থেকে নিজেদের আলাদা করে নেয়। কয়েকজন কর্মকর্তা প্রকাশ্যে বিরক্তি প্রকাশ করেন এবং প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের “অবাধ কর্মকাণ্ড” নিয়ে সমালোচনা করেন।
এক সিনিয়র কর্মকর্তা তখন ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, “কার্টার যা শুনতে চেয়েছিলেন তা-ই শুনেছেন… তিনি নিজের বাস্তবতা তৈরি করছেন,”
যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই চুক্তিটি নিয়ে কার্টারকে সমালোচনা করেন। তাদের মতে, উত্তর কোরিয়া কার্টারকে তাদের কাজে ব্যবহার করেছে।
তবে কার্টার কৌশলী উপায়ে, সংবাদমাধ্যম ব্যবহার করে ক্লিনটন প্রশাসনকে চাপে ফেলতে সফল হয়েছিলেন।
উত্তর কোরীয় নেতার সঙ্গে আলোচনার খবর তাৎক্ষণিকভাবে সম্প্রচার করার মাধ্যমে তিনি মার্কিন সরকারের প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ কমিয়ে দেন।
তার সফরের পরপরই সিএনএন-এর প্রতিবেদক মাইক চিনোই লেখেন, “উত্তর কোরিয়ার বিষয়ে মার্কিন নীতিতে প্রায় প্রতি ঘণ্টায় পরিবর্তন আসা শুরু হয়েছিল।”
যদিও পরে কার্টার স্বীকার করেন যে তিনি নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে ভুল বলেছেন, তবুও তিনি স্বভাবসুলভ একগুঁয়েমির মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন।
“যখন আমি সওলে ফিরে এলাম, হোয়াইট হাউসের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখে আমি হতবাক ও অস্বস্তি বোধ করছিলাম। তারা আমাকে ওয়াশিংটনে ব্রিফিং দিতে নিষেধ করেছিল এবং সরাসরি আমার বাড়িতে যেতে বলেছিল,” তিনি বলেন।
কিন্তু কার্টার তাদের কথা শোনেননি।
তিনি বলেন, “আমি মনে করেছিলাম, আমার যা বলার আছে, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ, এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তাই আমি চুপ থাকতে পারিনি।”
এই সফরের এক মাস পরে একটি চূড়ান্ত নাটকীয় ঘটনা ঘটে।
১৯৯৪ সালের ৯ই জুলাই, যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার কর্মকর্তারা জেনেভায় বসেছিলেন আলোচনা করতে। একই দিনে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে ঘোষণা আসে: কিম ইল সাং হৃদরোগে মারা গেছেন।
কার্টারের চুক্তি তখনই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তবে আলোচকরা তাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যান এবং কয়েক সপ্তাহ পর “এগ্রিড ফ্রেমওয়ার্ক” নামে একটি আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা করতে সক্ষম হন।
যদিও এই চুক্তি ২০০৩ সালে ভেঙে যায়, এটি প্রায় ১০ বছর ধরে পিয়ংইয়াংয়ের পারমাণবিক কার্যক্রম বন্ধ রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
‘কার্টারের সাহস’
রবার্ট কারলিন, যিনি সিআইএ এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা এবং উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি বলেছেন যে কার্টারের আসল কৃতিত্ব ছিল মার্কিন সরকারকে সহযোগিতায় বাধ্য করা।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “কার্টার মূলত উত্তর কোরিয়ায় খোলা দরজায় ধাক্কা দিয়েছিলেন। আসল চ্যালেঞ্জ ছিল ওয়াশিংটনে। কার্টারের হস্তক্ষেপ ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ট্রেনটি থামাতে সাহায্য করেছিল তার বিপদজনক প্রান্ত ধরে চলছিল”।
সহজ করে বললে কার্টারের হস্তক্ষেপ মার্কিন নীতির ভুল পথে যাওয়াটা থামিয়েছিল।
কার্টারের এই সফর উত্তর কোরিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নতির পথ খুলে দেয়ার ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এর ফলেই পরবর্তী সময়ে আরও কয়েকটি সফর সম্ভব হয়, যেমন ২০০৯ সালে কার্টার এবং ক্লিনটন একসঙ্গে উত্তর কোরিয়া যান। যেখানে তারা আটক মার্কিন সাংবাদিকদের ফিরিয়ে আনেন।
এছাড়া, ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কিম জং আনের সাথে সাক্ষাতের পথ সুগম করতেও কার্টারকে কৃতিত্ব দেওয়া হয় – কারণ “কার্টার এটা সম্ভব করে দিয়েছিলেন” যে একজন বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট উত্তর কোরিয়ার নেতা সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারে, ড. ডেলুরি বলেন।
যদিও সেই শীর্ষ বৈঠক ব্যর্থ হয়েছিল, এবং দীর্ঘমেয়াদে কার্টারের সফর পরমাণু যুদ্ধের শঙ্কা পুরোপুরি দূর করতে পারেনি। বরং তা বেড়েছে।
আজকের দিনে উত্তর কোরিয়ার এমন ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম বলে মনে করা হয়।
তবুও কার্টার রাজনৈতিক সাহসিকতার জন্য প্রশংসিত হয়েছিলেন। তবে প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তিনি এতোটা প্রশংসিত হননি।
বরং সে সময় পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে খুব বেশি নীরব থাকার জন্য তিনি সমালোচিত হয়েছিলেন, বিশেষ করে ইরান বন্দী সঙ্কট পরিচালনায় তার ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছিল।
ড. ডেলুরি বলেন, “কার্টারের উত্তর কোরিয়া সফর ছিল একজন সাবেক নেতার অসাধারণ কূটনৈতিক কাজ।”
তার কার্টারের এই পদক্ষেপ বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। সমালোচকেরা বলেন, তিনি একাই ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সিএনএন-এর প্রতিবেদক মাইক চিনোই বলেন, কার্টার নিজেই একটি পারমাণবিক চুক্তি তৈরির চেষ্টা করেছিলেন, কারণ তিনি মার্কিন নীতিকে ভুল মনে করেছিলেন।
তবুও, অনেকেই বিশ্বাস করেন, সেই সময়ে কার্টারই ছিলেন সঠিক ব্যক্তি।
১৯৯৪ সালের সফরটি চূড়ান্ত করতে কার্টারকে সহায়তা করেছিলেন হান এস পার্ক। তিনি বলেন, “কার্টার ‘খুব দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির মানুষ’ ছিলেন, কিন্তু একই সঙ্গে তিনি “মনে প্রাণে শান্তির মানুষ” ছিলেন।
যদিও কাটার তার একগুঁয়েমি স্বভাবের কারণে অনেকের সঙ্গেই সহজে মানিয়ে নিতে পারতেন না, অনেকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে পারেননি। তবুও এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে, আরেকটি কোরিয়ান যুদ্ধ ঠেকাতে তিনিই ছিলেন সঠিক ব্যক্তি”, বলেন অধ্যাপক পার্ক।
সবচেয়ে বড় কথা, কার্টার নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি সঠিক কাজটি করছেন।
রবার্ট কারলিন বলেন, “মার্কিন সরকারের উদ্বেগ, সংশয় তাকে থামাতে পারেনি। কার্টারের সাহস ছিল।”