Source : BBC NEWS

আওয়ামী লীগের পতাকা

ছবির উৎস, Getty Images

এক ঘন্টা আগে

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে’ আওয়ামী লীগ ও তাদের দলটির নেতাদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত সন্ত্রাস বিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেসসহ দলটির ‘সব ধরনের কার্যক্রম’ নিষিদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে।

দল হিসাবে আওয়ামী লীগ কী করতে পারবে আর কী করতে পারবে না কিংবা আইনটির ব্যাপ্তি কতটা হবে- তা নিয়েই বেশি কৌতূহল দেখা যাচ্ছে।

সোমবার বিকালে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. জাহেদ ইকবাল বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, আইনটিতে সবশেষ যে পরিবর্তন অন্তর্বর্তী সরকার এনেছে তাতে এ আইনের আওতায় নিষিদ্ধ করার পর দলটির পক্ষে যায় এমন কোন প্রচার প্রচারণাও করা যাবে না।

শনিবার সন্ত্রাস বিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ।

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে ওই আইন ও সন্ত্রাস বিরোধী আইনে ২০০৯- এই দুই আইনের আলোকে।

প্রজ্ঞাপনে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম বা কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার ফলে এখন থেকে দলীয় কোনো কার্যক্রম ছাড়াও অনলাইন, অফলাইন বা অন্য কোনো মাধ্যমে দলটির পক্ষে যায় এমন কোনো কিছুই কেউ করতে পারবে না বলে মনে করছেন আইনজীবী মি. ইকবাল।

তবে দলকে নিষিদ্ধ না করে দলীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিষয়টি নিয়ে বিতর্কও তৈরি হয়েছে।

কারণ দল বৈধ হলে রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানো তার আইনি অধিকার থাকে বলে আইনজীবীরা অনেকে মনে করেন।

আবার আওয়ামী লীগকে লক্ষ্য করে আইনে যেসব সংশোধনী আনা হচ্ছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কারণ ‘আইনের ভূতাপেক্ষা’ প্রয়োগের সুযোগ নেই বলে মনে করেন অনেক আইনজীবী।

বিবিসি বাংলায় আরও পড়ুন:
আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনের পতনে শেখ হাসিনাসহ সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য বা দলটির নেতৃত্বের একটা বড় অংশ দেশ ছেড়ে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেন, ফাইল ছবি

ছবির উৎস, Getty Images

নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে আইনি তথ্য

পলিটিক্যাল পার্টি অধ্যাদেশ- ১৯৭৮ এবং সন্ত্রাস বিরোধী আইন- ২০০৯, এই দুটি আইনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল বরখাস্ত, সাময়িক অথবা আজীবন নিষিদ্ধের সুযোগ রয়েছে। যদিও এখানে অনেক কিছু বিবেচনার বিষয় থাকে।

সরকার এবার আওয়ামী লীগকে বা আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার কথা বলছে সন্ত্রাসী বিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ ও সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯ এর প্রয়োগ করে।

সন্ত্রাসী বিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ এর অনুমোদনের পর সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ শনিবার তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় লিখেছিলেন, ‘বর্তমান আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বা সত্ত্বা সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত থাকলে সরকার প্রজ্ঞাপন দিয়ে ওই ব্যক্তিকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করতে পারে বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। কিন্তু কোন সত্তার কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিধান ছিলো না। এখন সেটি করা যাবে’।

সোমবার জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ”বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন কর্তৃক যে কোনো ধরনের প্রকাশনা, গণমাধ্যম, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে কোনো ধরনের প্রচারণা, মিছিল, সভা-সমাবেশ, সম্মেলন আয়োজনসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।”

বাংলাদেশে সন্ত্রাস বিরোধী আইনটি হয়েছিলো ২০০৯ সালে। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে আইনটির গেজেট হলেও আইন অনুযায়ী এটি কার্যকর ধরা হয়েছে ১১ই জুন ২০০৮ সাল থেকে।

এ আইন দ্বারাই ক্ষমতা হারানোর কয়েকদিন আগে জামায়াত ও শিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিলো বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। আবার এর মাধ্যমে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।

মূলত এ আইনের আওতায় এসব দল ও সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিলো।

আইনটির ১৮ ধারার প্রয়োগ করে দল হিসাবে আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন ও সন্ত্রাসী কার্যে জড়িত হিসাবে তালিকাভূক্ত করেছে সরকার।

আইনের এ ধারায় বলা হয়েছে কোন সংগঠনকে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত আছে এমন যুক্তিসঙ্গত কারণে নিষিদ্ধ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। সরকার যে কোনো সংগঠনকে এ তালিকায় আনতে কিংবা বাদ দিতে পারবে।

এই আইনের আওতায় প্রজ্ঞাপন জারি করে কোনো দলকে নিষিদ্ধ করা হলে তখন কী কী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে তা আইনটির ২০ ধারা অনুযায়ী উল্লেখ রয়েছে।

এই ধারায় বলা হয়েছে – কোন সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হলে সরকার তার কার্যালয় বন্ধ করে দিবে, ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করবে ও অন্যান্য হিসাব আটক করিবে, সকল প্রকারের প্রচারপত্র , পোস্টার, ব্যানার, বা মুদ্রিত, ইলেক্ট্রনিক, ডিজিটাল বা অন্যান্য উপকরণ বাজেয়াপ্ত করবে, নিষিদ্ধ সংগঠন বা উহার পক্ষে বা সমর্থনে যে কোন প্রেস বিবৃতির প্রকাশনা, মুদ্রণ বা প্রচারণা, সংবাদ সম্মেলন বা জনসম্মুখে বক্তৃতা দেয়া নিষিদ্ধ করবে।

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে সমাবেশ

ছবির উৎস, Getty Images

এছাড়া আইনে আরও বলা হয়েছে- যদি দেখা যায় নিষিদ্ধ সংগঠনের তহবিল এবং পরিসম্পদ (অ্যাসেট) অবৈধভাবে অর্জিত হয়েছে বা এই আইনের অধীনে কোন অপরাধ সংগঠনে ব্যবহৃত হয়েছে তা হলে ওই তহবিল এবং অ্যাসেট রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হবে।

পাশাপাশি এ আইনের আওতায় নিষিদ্ধ হওয়া সংগঠনের কেউ সদস্য হলে বা সদস্য বলে দাবি করলে সেটি অপরাধ হবে এবং এজন্য ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড কিংবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

কেউ যদি নিষিদ্ধ সংগঠনকে সমর্থন করার জন্য কাউকে অনুরোধ বা আহবান করেন বা ওই সংগঠনকে সমর্থন বা তার কর্মকাণ্ডকে গতিশীল ও উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে কোন সভা আয়োজন, পরিচালনা বা পরিচালনায় সহায়তা করেন বা বক্তৃতা প্রদান করেন তাহলে সেটিও সন্ত্রাস দমন আইন অনুযায়ী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

আবার এ ধরনের সংগঠনকে সমর্থন বা সক্রিয় করার উদ্দেশ্যে কেউ বক্তৃতা করলে বা রেডিও, টেলিভিশন বা কোন মুদ্রণ বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কোন তথ্য সম্প্রচার করলে সেটিও অপরাধ হবে।

আইনটিতে বলা হয়েছে, এসব অপরাধে কেউ দোষী হলে তার অনধিক সাত বছর ও কমপক্ষে দুই বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের কারাদণ্ড হবে এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ড আরোপ করতে পারবে আদালত।

কিন্তু এ আইনে নিষিদ্ধ হওয়া সংগঠনের বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে কেউ প্রচার করলেও অপরাধ হবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় লিখেছেন: সন্ত্রাস বিরোধী আইনের ১৮ (১) ধারা অনুযায়ী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হলে, এটি একটি নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসেবে বিবেচিত হবে।

আর ৯ ধারার ২ ও ৩ উপধারা অনুযায়ী নিষিদ্ধ সত্ত্বাকে সমর্থন করে কোনো বক্তব্য দিলে এবং সেটি মুদ্রণ ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশ/প্রচার করা হলে সেটিও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। সেক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি সর্বনিম্ন ২ বছর ও সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড ভোগ করতে পারেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থ দণ্ডও পেতে পারেন।

আইনজীবীরা বলছেন, ফেসবুকে ছবি ও লেখা প্রকাশ কিংবা শেয়ার করার দায়ে গত সরকারের আমলেই অনেকে এই আইনের আওতায় করা মামলায় কারাভোগ করেছেন। ফলে এখন ওই আইন আওয়ামী লীগের জন্যও প্রযোজ্য হবে।

অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে

ছবির উৎস, CHIEF ADVISER GOB FACEBOOK

আগে যাদের নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরোধিতা করা জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের’ কারণে। পরে জিয়াউর রহমান সরকারের সময় তাদের রাজনীতির অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হয়।

স্বাধীনতার পর জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও মুসলিম লীগের তিনটি অংশ, পিডিপিসহ স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী এবং সব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিলো সরকার।

এরপর ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি (পিবিএসপি) ও পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (পিবিসিপি)কে নিষিদ্ধ করা হয়। এ দুটি বামপন্থি মাওবাদী সংগঠনের সেই নিষেধাজ্ঞা এখনো বহাল আছে বলেই জানা গেছে।

২০০৫ সালে জেএমবিসহ চারটি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে সরকার। বাকীগুলো হলো- জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ(হুজি)ও শাহাদাৎ-ই আল-হিকমা।

এরপর ২০০৯ সালের ২২ই অক্টোবর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রেসনোট জারি করে হিযবুত তাহ্‌রীরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ওই প্রেসনোটে সংগঠনটিকে ‘শান্তি শৃঙ্খলা এবং জননিরাপত্তার জন্য হুমকি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাদের ঢাকায় প্রকাশ্যে মিছিল করতে দেখা গেছে। ডিএমপি অবশ্য গত মাসে জানিয়েছে সংগঠনটি এখনো নিষিদ্ধই আছে।

২০১৫ সালের মে মাসে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারি করে।

পাঁচই অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর নেতাকর্মীশূন্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়

এই দলটির নেতা হিসেবে পরিচিত জসীমউদ্দিন রাহমানী ব্লগার হত্যা মামলায় আটক ছিলেন।

সম্প্রতি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে হওয়া সমাবেশে তার উপস্থিতির ছবি সামাজিক মাধ্যমে প্রচার পেয়েছে।

গত বছর শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে সেই সময় ২০২৪ সালের পহেলা অগাস্ট সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ এর ধারা ১৮(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ সব অঙ্গ সংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার।

তখন প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিলো, “এবং উক্ত আইনের তফসিল-২ এ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসাবে তালিকাভুক্ত করিল।”

পরে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২৮শে অগাস্ট জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণার এই আদেশ প্রত্যাহার করে নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

প্রত্যাহারের সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জামায়াতে ইসলামী, এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির বা এর কোনো অঙ্গ সংগঠনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও সহিংসতায় সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য প্রমাণ সরকার পায়নি।

শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনকারীদের চাপের মুখে সবশেষ গত বছরের ২৩শে অক্টোবর আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ করে বর্তমান সরকার।