Source : BBC NEWS

বৈসরনে এখন সেনা সদস্যদের ছড়াছড়ি, তবে হামলার সময়ে সেখানে নিরাপত্তারক্ষীরা ছিলেন না

ছবির উৎস, Getty Images

ভারতশাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহতদের তালিকায় চোখ রাখলে দেখা যাবে, কাশ্মীর থেকে কেরালা, গুজরাত থেকে পশ্চিমবঙ্গ আর আসাম – বহু রাজ্যেরই মানুষের নাম আছে সেখানে।

পর্যটকদের ওপরে এই হামলায় ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মতোই ক্ষেপে উঠেছেন কাশ্মীরিরাও – কারণ এই পর্যটকরাই যে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশের রুজি-রুটির অংশ!

সামাজিক মাধ্যমে ভারতের মানুষের ক্ষোভের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে, তবে একই সঙ্গে অনেকেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন যে হামলার সময়ে নিরাপত্তা বাহিনী কোথায় ছিল!

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে প্রায় ২০ মিনিট হামলা চলার পরে যখন নিরাপত্তা বাহিনী সেখানে পৌঁছায়, ততক্ষণে বন্দুকধারীরা পালিয়ে গেছে।

ওই হামলায় বেঁচে যাওয়া একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় এই একই তথ্য উঠে এসেছে।

বিবিসি বাংলায় আরও পড়তে পারেন
হামলায় নিহতদের পরিবারগুলো বলছে হামলার ২০ মিনিট পরে সেনাবাহিনী পৌঁছায় সেখানে

ছবির উৎস, Getty Images

‘সেখানে নিরাপত্তা বাহিনী থাকা উচিত ছিল’

মহারাষ্ট্রের পুণের বাসিন্দা মিজ. আশাবরী সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে জানিয়েছেন, হামলার সময় তিনি তার বাবা-মা ও আত্মীয়দের সঙ্গে ছিলেন। ওই হামলায় তার বাবা ও এক আত্মীয় নিহত হয়েছেন।

পিটিআই মিজ আশাবরীকে উদ্ধৃত করে লিখেছে, “আমাদের সাহায্য করার জন্য সেখানে কেউ ছিল না। আমাদের যে খচ্চর-চালকরা আমাদের ওখানে নিয়ে গিয়েছিল, তারাই একমাত্র আমাদের সাহায্য করেছিলেন।”

তিনি দাবি করেন, হামলার ২০ মিনিট পর নিরাপত্তা বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।

অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল কেজেএস ধিলোঁ ভারতীয় সেনাবাহিনীর শ্রীনগর-ভিত্তিক ১৫ কোরের প্রাক্তন কম্যান্ডার।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আপাতত আমি এটাই বলব, হ্যাঁ, কাশ্মীরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গতিশীল বা ডায়নামিক পদ্ধতিতে কাজ করে। সেটার নিয়মিত পর্যালোচনা করা হয়। সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট থেকে দেখেছি, বৈসরন উপত্যকায় নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো উপস্থিতি ছিল না। যে এলাকায় এত পর্যটকদের ভিড়, সেখানে নিরাপত্তা বাহিনী থাকা উচিত ছিল।”

যশোবর্ধন আজাদ একজন অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার। তিনি ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোতে বিশেষ পরিচালক হিসাবে কাজ করেছেন এবং জম্মু ও কাশ্মীরের সঙ্গে পরিচিত।

বিবিসিকে তিনি বলেন, “এই ভাবে, এত বড় হামলা – তাও বিশেষ করে পর্যটকদের ওপরে…এটা আমরা আশঙ্কাই করিনি। আক্রমণের জন্য পহেলগামকে বেছে নেওয়াও ছিল কৌশলগত সিদ্ধান্ত। ওই এলাকা তো শান্তিপূর্ণ ছিল। সেখানকার মানুষ পর্যটনের সঙ্গে এতটাই জড়িয়ে আছে যে তারা কখনোই এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করবে না।”

তিনি বলেন, “আমরা যে তথ্য পাচ্ছি, এই সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য ছিল। তারপরও সন্ত্রাসীরা তারা তাদের কার্যসিদ্ধি করে ফেলতে পারল – এটা এমন একটা বিষয়, যার সঠিক বিশ্লেষণ করা দরকার এবং এর থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার।”

“আমাদের এটাও ভাবতে হবে যে, ওই চরমপন্থিদের কোনো ধরনের স্থানীয় সমর্থন ছিল কিনা। তাহলে কি এটা গোয়েন্দা ব্যর্থতা? আপনি হয়তো বলতে পারেন, কিন্তু এটাও মনে রাখবেন যে একটি জায়গায় লক্ষ লক্ষ নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা যেতে পারে, তা সত্ত্বেও কিছু ফাঁকফোকর থাকবেই,” বলছিলেন মি. আজাদ।

মানুষ প্রশ্ন তুলছে যে ভারত সরকার এবং জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন কি কোনো জবাব দেবে?

কাশ্মীরে সহিংসতা কি আদৌ বন্ধ হয়েছিল? - প্রতীকী ছবি

ছবির উৎস, Getty Images

সহিংসতা কি আদৌ কমেছিল?

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ৩৪ লাখেরও বেশি পর্যটক জম্মু ও কাশ্মীর ভ্রমণ করেছেন। আবার ২০২৩ সালের শেষে এই সংখ্যা দুই কোটি ১১ লাখ ছাড়িয়ে যায়। আর ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল এক কোটি আট লাখের ওপরে।

জম্মু-কাশ্মীরের জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদনে ২০১৯-২০ সালে পর্যটনের অবদান ছিল সাত দশমিক ৮৪ শতাংশ, যা ২০২২-২৩ সালে বেড়ে হয়েছে আট দশমিক ৪৭ শতাংশ। জম্মু-কাশ্মীরে পর্যটন ক্ষেত্রের বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার ২০২১ সাল থেকেই ছিল ১৫.১৩ শতাংশ।

আবার গত বছর যে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন হয়েছিল, তাতেও মানুষ উৎসাহের সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন।

সরকারি ভাষ্যতে জম্মু-কাশ্মীরের প্রসঙ্গে ‘জিরো টেরর’, অর্থাৎ ‘সন্ত্রাস-মুক্ত’-এর মতো শব্দও উঠে আসছিল, অর্থাৎ “জম্মু-কাশ্মীর থেকে সন্ত্রাসবাদের বাস্তুতন্ত্রটাই প্রায় নির্মূল করা গেছে।”

সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে জম্মু- কাশ্মীরে ‘চরমপন্থি সহিংসতায়’ ১৯ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিলেন। সেবছর ১৮ জন নিরাপত্তাকর্মী ও ৮৪ জন ‘চরমপন্থি’ নিহত হয়।

পরবর্তীতে সহিংসতা বাড়ে, যেমন ২০১৮ সালে ৮৬ জন বেসামরিক নাগরিক, ৯৫ জন নিরাপত্তাকর্মী এবং ২৭১ ‘চরমপন্থি’ নিহত হয়।

তুলনামূলকভাবে ২০২৩ সালে ১২ জন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়, ৩৩ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মারা যান ও ৮৭ জন ‘চরমপন্থি’কে হত্যা করা হয়।

গত বছর, ২০২৪-এ ৩১ জন বেসামরিক নাগরিক, ২৬ জন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হন এবং ৬৯ জন ‘চরমপন্থি’কে মারা হয়।

অর্থাৎ, সহিংসতা কিন্তু পুরোপুরি কমেনি। তাহলে কি বড় কোনো ঘোষণার আগে পরিস্থিতি আরও নিয়ন্ত্রণ করা উচিত ছিল প্রশাসনের?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিশ্লেষক বলেন, জম্মু-কাশ্মীরে সরকারের কৌশল পুনর্বিবেচনা করা দরকার।

'পর্যটকরাই আমাদের প্রাণ' - এই পোস্টার নিয়ে কাশ্মীরীদের মিছিলে সামিল এই শিশুকন্যাও

ছবির উৎস, Getty Images

‘পর্যটকদের সুরক্ষায় দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে’

সেনাবাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশনস (ডিজিএমও) ছিলেন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পহেলগামে হামলার পরে পর্যটন নিয়ে সরকারকে কিছু দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।

তিনি বলেন, “পর্যটকরা বরাবরই সফট টার্গেট। যেহেতু আগে তাদের ওপর এ ধরনের কোনো হামলা হয়নি, তাই ধারণা করা হচ্ছিল ভবিষ্যতেও হামলা হবে না। আমরা প্রতি বছর অমরনাথ যাত্রা পরিচালনা করি – ওই এলাকাতেই। তাই আমি মনে করি, একইভাবে সরকারকেও পর্যটন নিয়ে ভাবতে হবে। পর্যটনের অনুমতি দেওয়া হোক, তবে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে। নিরাপত্তা বাহিনী যেসব জায়গায় তল্লাশি চালিয়েছে শুধু সেইসব জায়গায় পর্যটকদের যেতে দেওয়া যেতে পারে।”

অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ধিলোঁ বলছিলেন, “বিশেষ করে পর্যটকদের যা সংখ্যা, তাতে কারও অসুবিধা না করে প্রত্যেকের ওপরে নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষে নজর রাখা সত্যিই কঠিন। দেশি-বিদেশি পর্যটক ছাড়াও স্থানীয়রাও এসব জায়গায় ভিড় করেন। যেমন টুরিস্ট গাইড, অস্থায়ী ধাবা ও রেস্তোরাঁ কর্মীরা, ট্যাক্সিচালক এবং ঘোড়া চালকরা। দুই-তিন জন সন্ত্রাসবাদীর পক্ষে এরকম একটা ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়া বা ধরা না পড়া খুবই সহজ।”

ইনস্টিটিউট ফর কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অজয় সাহনি বলছিলেন, “সাময়িকভাবে হলেও এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না করা হলে পর্যটকদের মধ্যে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে তা জম্মু-কাশ্মীরের পর্যটনকে ধ্বংস করে দিতে পারে।”

জম্মু-কাশ্মীর থেকে ২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা অপসারণের পর থেকে পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করতে সরকার উৎসাহিত করেছে।

এসব বিষয়ে সরকারের অবস্থান বদলাবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

কাশ্মীরের পথে প্রহরায় সেনা সদস্যরা

ছবির উৎস, Getty Images

এর পরে কোন পথে এগোনো উচিত?

প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বুধবার তার বিবৃতিতে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, এই হামলার পেছনে যারা রয়েছে, তাদের শিগগিরই পাল্টা জবাব দেওয়া হবে। তবে কী ধরনের আর কবে এই জবাব দেওয়া হবে, তা স্পষ্ট নয়।

জম্মু-কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা বাড়িয়ে কী কোনো লাভ হবে? গোয়েন্দা তথ্য জোগাড় করার দিকে ভারতকে কি আরও নজর দিতে হবে?

যশোবর্ধন আজাদ ব্যাখ্যা করেছেন, “আমার মতে, এই হামলার পেছনে পাকিস্তানের হাত রয়েছে। এখন বিপুল সংখ্যক ভারতীয় ও বিদেশি পর্যটক জম্মু-কাশ্মীরে আসছেন। সেখানে ‘জি-টোয়েন্টি’-র মতো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এত কিছুর পরেও আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের ক্ষতি করার লক্ষ্যেই সরাসরি ভারতে এভাবে আক্রমণ চালানো হয়েছে। এই ধরনের চিন্তাভাবনা একমাত্র পাকিস্তানই করতে পারে।”

তার মতে, “ভারতের এই সুযোগটা কাজে লাগানো উচিত। আশা করি দোষীদের জীবিত ধরা যাবে। তাদের নিজেদের এবং পাকিস্তানের কী ভূমিকা ছিল, তার নথি থাকা দরকার। এরপর ভারত যা উপযুক্ত মনে করবে সেই পদক্ষেপ নিক যাতে পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদের পরিকাঠামোটাই পুরোপুরি ভেঙে দেওয়া যায়।”

“আমি সবসময়ই পাকিস্তানের সঙ্গে সংলাপের পক্ষে। একই সঙ্গে আমি এটাও মনে করি যে, লাইন অব কন্ট্রোলে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চালিয়ে যাওয়া যথার্থ কি না, তা পর্যালোচনা করার সময় এসেছে। আমার মনে হয়, এই যুদ্ধবিরতিতে ভারতের থেকে পাকিস্তানই বেশি লাভবান হচ্ছে,” বলছিলেন মি. আজাদ।

যদিও পাকিস্তান এই অভিযোগ করে থাকে যে ভারত বিনা কারণেই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে থাকে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক অজয় সাহনি মনে করেন যে ভারত জম্মু-কাশ্মীরে অনেকটাই সাফল্য অর্জন করেছে এবং এই পথেই এগিয়ে যাওয়া উচিত ভারতের।

তার কথায়, “জম্মু-কাশ্মীরে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সন্ত্রাসবাদ চলছে। পরিসংখ্যানের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয় এই সন্ত্রাসবাদ এখন শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আরও বেশি করে নিরাপত্তা বাহিনী পাঠানো দরকার। এই প্রশ্নে বলব, পাহাড় ও জঙ্গলে ভরা এলাকার ভূগোলটা যদি দেখেন, তাহলে একটানা কত সংখ্যক বাহিনী মোতায়েন করতে পারবেন?”

“এই মুহূর্তে যেটা দরকার তা হলো পুরো দেশের থেকে স্থানীয় মানুষরা যাতে নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে না করেন, সেটা ভারতকে সুনিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য আমাদের রাজনীতিবিদদের বিভেদমূলক বক্তব্য বন্ধ করতে হবে। আমরা যদি নিশ্চিত করতে চাই যে আমাদের গোয়েন্দা ব্যবস্থা আরও ভালো হয়ে উঠবে, আমাদের পুলিশ বাহিনী শক্তিশালী হবে এবং সন্ত্রাসবাদীদের জন্য কোনো সমর্থন থাকবে না, তাহলে স্থানীয় জনগণকে নিজেদের পক্ষে আনতে হবে।”