Source : BBC NEWS

ফেব্রুয়ারি মাসে বিয়ে হয়েছিল শুভম দ্বিবেদী ও ঐশান্যার

ছবির উৎস, ANI

সতর্কীকরণ: এই প্রতিবেদনে প্রকাশিত কিছু বর্ণনা পাঠকদের বিচলিত করতে পারে।

ঐশান্যা দ্বিবেদীর চোখের সামনেই তার স্বামীকে গত সপ্তাহে হত্যা করা হয়। ভারতশাসিত কাশ্মীরের পহেলগামের সেই ঘটনার কথা মনে করে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। কথা বলতে গিয়ে বার বার গলা ধরে আসছিল তার।

বাড়িভর্তি মানুষের মাঝে এক কোণে চুপচাপ বসে ছিলেন ঐশান্যা, কোনো দিকেই মনোযোগ নেই তার।

পহেলগামের হামলায় নিহত ৩১ বছরের শুভম দ্বিবেদীর স্ত্রী ঐশান্যার মতোই অবস্থা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের। পরিবারের একমাত্র ছেলেকে হারিয়েছে এই পরিবার।

গত ২২শে এপ্রিল পহেলগামের বৈসারণ উপত্যকায় সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ২৬ জনের একজন কানপুরের শুভম দ্বিবেদী।

তার স্ত্রী ২৯- বছরের ঐশান্যা বিবিসির সঙ্গে কথোপকথনের সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

তিনি বলছিলেন, “আমাদের দেশ, আমাদের সরকার আমাদের ওখানে (পহেলগামে) অনাথের মতো ছেড়ে দিয়েছিল। যাদের ওপর ভরসা করে আমরা ওখানে ঘুরতে গিয়েছিলাম, তারা সেই সময় ওখানে উপস্থিত ছিল না।”

“কোনো নিরাপত্তারক্ষী ছিল না, কোনো জওয়ান ছিল না। ঘরের ভেতরে বাবা-মা আমাদের রক্ষা করতে পারেন, কিন্তু ঘরের বাইরে আমাদের রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের,” ঘটনার সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি এ কথা বলেছেন।

আরও পড়তে পারেন
সপরিবারে বেড়াতে গিয়েছিলেন শুভম দ্বিবেদী

‘ধীরে ধীরে লোকে শুভমকে ভুলে যাবে’

সেলফের ওপর রাখা প্রয়াত স্বামীর ছবির দিকে তাকিয়ে ঐশান্যার গলা ধরে আসে। এক দৃষ্টিতে ওই ছবির দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি।

“আমার নিজের চোখের সামনে আমার ভালোবাসা, আমার স্বামী, আমার পৃথিবীকে শেষ হয়ে যেতে দেখেছি। ঈশ্বর করুন, কাউকে যেন এমন দিন না দেখতে হয়,” বলছিলেন তিনি।

কথা বলার সময় ক্রমাগত তার চোখ বেয়ে জল পড়ছিল। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন তিনি।

তারপর সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে ঐশান্যা দ্বিবেদী বলেন, “এই দেশের ভুলের কারণে, সরকারের ফেইলিওরের (ব্যর্থতা) জন্য আমার স্বামী শহীদ হয়েছেন। তাই শুভমকে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হোক।”

“আর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রথম গুলিটা শুভমের লেগেছিল। তাই সেই সময় উপস্থিত অনেকে ওখান থেকে পালানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। যারা সেখান থেকে নিরাপদে নিজেদের বাড়িতে পৌঁছতে পেরেছেন, যারা এটা বলতে পারছেন যে আমরা বেঁচে গেছি, সেটা একমাত্র শুভমের জন্যই সম্ভব হয়েছে।”

ঐশান্যা দ্বিবেদীসহ গোটা পরিবার দাবি করেছেন, ঘটনার দিন শুভম দ্বিবেদীকেই প্রথমে গুলি করা হয়েছিল।

ঘটনার কথা বলতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, “ভারতে যদি কাউকে হিন্দু বলার (পরিচয় দেওয়ার) কারণে হত্যা করা হয়, তাহলে আমি তাকে শহীদ বলে গণ্য করি। সরকারকেও এটা মানতে হবে। আর সরকারের ব্যর্থতার কারণে কারও হত্যা হলে তাকে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে।”

দেশের সব নাগরিকের কাছে আবেদন জানিয়েছেন তিনি যাতে তার প্রয়াত স্বামীকে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়। তার কথায়, “শুভমের জন্য অনেক জীবন রক্ষা পেয়েছে, তাই তাকে শহীদের মর্যাদা দেওয়ার এই দাবিতে সবাই যাতে আমাদের পাশে দাঁড়ান, সেই অনুরোধ জানাচ্ছি। শুভম শহীদের মর্যাদা না পেলে ওকে কিছুদিনের মধ্যেই সবাই ভুলে যাবে।”

তিনি বলেছেন, “শুভম ভোলার মতো নয়। কেউ যেন তাকে ভুলে না যায়। আমি জানি না ওর কথা মনে রাখার জন্য সরকার কী করবে, কিন্তু এটুকু অন্তত করুক যাতে আমি শহীদের স্ত্রীর পরিচয় পাই। এই পরিচয় নিয়েই আমি ওকে ছাড়া আমার বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব।”

শুভম দ্বিবেদীর বাবা সঞ্জয় কুমার দ্বিবেদী

‘আমার ছেলের বেড়াতে যাওয়ার শখ ছিল’

শুভমের বাবা সঞ্জয় কুমার দ্বিবেদী বিবিসিকে বলেন, “আমাদের ছেলে ঘুরতে খুব ভালোবাসত। বিশ্বের বহু দেশ ঘুরেছে। সব জায়গা থেকেই নিরাপদে ঘরে ফিরে এসেছে।”

“এটা তো আমাদের দেশ ছিল। নিজের দেশেই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো কারণ ও একজন হিন্দু।”

দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে নিরাপত্তার বিষয়ে আবেদন জানিয়েছেন তিনি।

বলেছেন, “শীর্ষে বসে থাকা ব্যক্তিদের এটা অবশ্যই ভাবতে হবে ভারতে হিন্দু হওয়ার কারণে যে কাউকে হত্যা করা যেতে পারে। আমার ছেলে তো চলে গেছে, কিন্তু অন্য কাউকে যাতে তাদের সন্তানকে না হারাতে হয়। তাই সরকারকে সন্ত্রান্সীদের সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে।”

শুভম দ্বিবেদীর মা অন্য একটা ঘরে একা বসেছিলেন। কারও সঙ্গে কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না তিনি।

ছেলের মৃত্যুর পর থেকে সঞ্জয় কুমার দ্বিবেদীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। কারও সঙ্গেই খুব একটা কথা বলেন না তিনি।

তিন-চার বছর আগে বাবার সিমেন্টের ব্যবসার পুরো দায়িত্ব নিয়েছিলেন শুভম। তিনি এমবিএ করেছেন। বিয়েও করেছিলেন কয়েক মাস আগেই। গত ১২ ফেব্রুয়ারি ঐশান্যার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মধ্যপ্রদেশের ওরছায় ‘ডেসটিনেশন ওয়েডিং’ করেন তারা।

এই নববিবাহিত যুগলের বিয়ের বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা হয়েছে। পরিবারের সকলে যে কতটা খুশি ছিলেন তা ওই সমস্ত ছবি ও ভিডিওতে স্পষ্ট।

একটা ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে শুভমের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ঐশান্যার। প্রথমবার দেখা হয়েছিল ২০২৪ সালের পহেলা অক্টোবর।

সেই সময় দিনের কথা স্মরণ করে ঐশান্যা দ্বিবেদী বলেন, “গত ছয়-সাত মাসে শুভম আমাকে অনেক ভালোবাসা দিয়েছে। সেই সব স্মৃতি আঁকড়ে আমি আমার বাকি জীবনটা এই বাড়িতেই কাটিয়ে দেব।”

“আমাকে এই বাড়ির মেয়ে বলেই ভেবে এসেছে সবাই। শ্বশুর-শাশুড়ি আর বাবা-মায়ের মধ্যে পার্থক্য বুঝিনি কখনো।”

কথা বলতে বলতে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন ঐশান্যা

ছবির উৎস, ANI

‘রাগ ছিল সরকারের ওপর, মারা হয়েছে নিরীহ মানুষকে’

ঐশান্যা জানান, শুভম দ্বিবেদীর পছন্দের খাবারের তালিকায় ছিল ‘ইনস্ট্যান্ট নুডলস’।

গত ১৭ই এপ্রিল প্রথমবার পুরো পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে ভারতশাসিত কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। বাড়ি ফেরার কথা ছিল ২৩শে এপ্রিল।

ফিরে আসার আগের দিন, অর্থাৎ ২২শে এপ্রিল পহেলগামে ঘুরতে যান তারা। যেদিন শুভম দ্বিবেদীকে হত্যা করা হয়, সেদিনই ছিল কাশ্মীরে দ্বিবেদী পরিবারের শেষ দিন।

ভ্রমণের প্রস্তুতির কথা মনে করে তার স্ত্রী বলেছেন, “বিয়ের পর শুভম এক বছরে দু’টো ফ্যামিলি ট্রিপ (পারিবারিক ভ্রমণের) প্ল্যান করেছিল। এটাই ছিল আমাদের প্রথম ফ্যামিলি ট্রিপ।”

“কোথায় বেড়াতে যাওয়া হবে সেটা বাছতে সবার ভোট নেওয়া হয়েছিল। সবাই মিলে কাশ্মীরকে বেছে নিয়েছিলাম। আমরা জানতাম না কাশ্মীর আমাদের জন্য এতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে।”

তিনি বলেন, “সরকার তো বলে কাশ্মীর এখন নিরাপদ। সেখানে ৩৭০ ধারা বিলোপ করা হয়েছে। কোনোরকম দুশ্চিন্তা ছাড়াই আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। জানতাম না যে আমাদের পৃথিবী সেখানে শেষ হয়ে যাবে।”

কাশ্মীর সফরে মি দ্বিবেদীর স্ত্রী, বাবা-মা, বোন, তার শ্বশুর-শাশুড়ি, ঐশান্যার বাবা-মা, বোন-সহ মোট ১১ জন ছিলেন।

যে সময় ঘটনাটা ঘটে, তখন মি. দ্বিবেদীর সঙ্গে সেখানে উপস্থিত ছিলেন তার স্ত্রী ঐশান্যা, ঐশান্যার ছোট বোন সম্ভাবী এবং তাদের দুই জনের বাবা-মা-সহ মোট পাঁচজন। পরিবারের বাকি ছয় সদস্য মাঝপথ থেকে বৈসারণ উপত্যকায় ফিরে এসেছিলেন।

শুভমের ছোট বোন আরতি, যার বিয়ে হয়েছিল দুই বছর আগে, তিনি ঘোড়ায় সওয়ার হওয়া নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাই আর ওপরে উঠতে চাননি। তিনি যেতে না চাওয়ায় পরিবারের অন্য পাঁচজন সদস্যও সেখানে যাননি।

ঐশান্যা বলেছেন, “বিমানবন্দরে এসে পৌঁছানোর পর আমাদের এমন অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে যারা সন্ত্রাসীদের বলেছিল, আমাদেরও গুলি করো যেভাবে আমাদের স্বামীকে মেরে ফেলেছ। কিন্তু তারা বলেছে–– যাও আর তোমার সরকারকে বলো আমরা তোমার স্বামীর সঙ্গে কী করেছি।”

“সন্ত্রাসীদের ওই কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছিল তাদের রাগ সরকারের ওপর, কিন্তু মারা হয়েছে নিরীহ মানুষগুলোকে।”

কাশ্মীর ঘুরতে যাওয়া নিয়ে কতটা উৎফুল্ল ছিলেন তারা জানিয়েছেন ঐশান্যা

‘আমরা ভেবেছিলাম কেউ মজা করছে’

আপনাকে ওরা (হামলাকারীরা) কিছু বলেছিল?

এই প্রশ্নের উত্তরে ঐশান্যা দ্বিবেদী বলেন, “না। কিছু বলার বা শোনারই সময় পাইনি। উপরে পৌঁছানোর পর মাত্র ১০ মিনিট হয়েছে। আমরা ম্যাগি আর কফির অর্ডার দিই।”

“তখন ঘড়িতে দুপুর ২টা ২৫ মিনিট বাজে। হাওয়ায় গুলি চলেছিল, আমরা সেই শব্দটা শুনেছি। কফি বিক্রেতা চলে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ড পরই একজন আমাদের কাছে এসে শুভমকে জিজ্ঞেস করল- হিন্দু না মুসলমান?”

“ভেবেছিলাম কেউ আমাদের সঙ্গে প্র্যাঙ্ক (মশকরা) করছে। আমি হেসে জিজ্ঞাসা করলাম কী হয়েছে? লোকটা আবার জানতে চাইল- হিন্দু না মুসলমান? বলল, যদি মুসলমান হও তাহলে কলমা পড়। আমরা তখনও ভাবছি যে কেউ মজা করছে।”

“আমাদের আর শুভমের মুখ থেকে হিন্দু বেরিয়ে এসেছে। আমরা আমাদের বাক্য শেষও করতে পারিনি, (হামলাকারী) শুভমের মাথার বাঁ দিকে গুলি চালিয়ে দিল।”

কথাগুলো বলতে বলতে অঝোরে কেঁদে চলেছিলেন ঐশান্যা। শব্দ হারিয়ে ফেলছিলেন।

কোনোমতে তিনি বলেন, “গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে ও পড়ে গিয়েছিল। আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম। তার চেহারার কিছুই দেখা যাচ্ছিল না প্রায়। খালি মাংসপিণ্ড আর রক্ত ছিল। তারপর কী হয়েছিল আমার আর মনে নেই।”

শোকস্তদ্ধ পরিবারের সদস্যরা

শুভম যখন গুলিবিদ্ধ হন, তখন তার শ্বশুর শৌচাগারে গিয়েছিলেন, আর শাশুড়ি দূরে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। আর কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন ঐশান্যার বোন সম্ভাবী।

তিনি (সম্ভাবী) বলেন, “আমি দিদির থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে ছিলাম। ওপরে আসার পর মাত্র ১০ মিনিট হয়েছে তখন।”

“বাতাসে গুলির শব্দও আমরা শুনেছি। একটা লোককে জামাইবাবুর (শুভম) কাছে যেতে দেখলাম। তার পরনে ছিল গাঢ় রঙের একটা পোশাক, কালো বা ধূসর রঙের। তার হাতে একটা বন্দুক ছিল। তার মুখে কোনো মাস্ক ছিল না।”

“আমি ভেবেছিলাম হয়ত সেনাবাহিনীর কেউ। কিন্তু সে সেনাবাহিনীর ইউনিফর্মে ছিল না। আমিও ভেবেছিলাম হয়ত (পর্যটকদের) কোনো গেম খেলানোর জন্য কেউ এসেছে। মাত্র পাঁচ সেকেন্ডের খেলা ছিল। আমার চোখের সামনেই সব কিছু হয়েছে।”

কথাগুলো বলার সময় তার ভঙ্গীতে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট ছিল, ক্রমে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

সম্ভাবী বলেন, “আমি তখনও ভেবেছিলাম পুরোটাই শ্যুটিং (ভিডিও ক্যামেরাবন্দি করা হচ্ছে)-এর জন্য হচ্ছে। এখনি হয়ত জামাইবাবু উঠে বসবে। কিন্তু তেমনটা হয়নি। তার ব্রেন ছিল প্রশংসনীয়, যেটা গুলি করে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছিল।”

উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ

ছবির উৎস, ANI

‘সরকারের উচিত প্রত্যেক ভারতীয়র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা’

এই দৃশ্য দেখে বোনের দিকে দ্রুত দৌড়ে যান সম্ভাবী। ততক্ষণে গুলির শব্দ বাড়তে শুরু করেছে।

তিনি বলেছেন, “আমি জোর করে দিদিকে গেটের বাইরে টেনে নিয়ে আসি। বাবা-মাকে খুঁজতে থাকি। বাবা ওয়াশরুমে না গেলে তারও কিছু একটা হতে পারত।”

“সবাইকে টেনে বের করে তাড়াতাড়ি দৌড়াতে বলি, নাহলে সবাইকে মেরে ফেলবে।”

সম্ভাবী জানিয়েছেন, নামার পথ খুব কঠিন ছিল।

“নামার রাস্তাটা খুব পাথুরে ছিল। ঘোড়ায় চেপে উপরে আসতে ভয় লাগছিল। পায়ে হেঁটে আসা সম্ভব ছিল না। কিন্তু কেউ আমাদের সাহায্য করেনি।”

“আমরা ঘোড়াওয়ালাদের অনুরোধ করেছিলাম যে আমার বাবা-মা নিচে হেঁটে নামতে পারবেন না, দিদির অবস্থাও তখন খুব খারাপ ছিল। কিন্তু যখন কেউ সাহায্য করল না তখন আমরা নিজেরাই অনেক কষ্টে নিচে নেমে আসি। ২০-২৫ মিনিট ধরে গুলির শব্দ আসছিল। আর তারপর সব শেষ।”

যে সময় শুভম দ্বিবেদীর গুলি লাগে সেই সময়কার ঘটনার কথা বর্ণনা করেছেন সম্ভাবী। তার কথায়, “আমার জামাইবাবুর গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশে থাকা ১০০-১৫০ জন এদিক ওদিক ছোটাছুটি শুরু করে। প্রথমে অন্য কেউ গুলিবিদ্ধ হলে হয়তো আমরা পালিয়ে বাঁচতে পারতাম।”

শুধু ধর্মের কারণে শুভম দ্বিবেদীকে মেরে ফেলা হয় এই অভিযোগকে ঘিরেই ব্যাপক ক্ষুব্ধ তিনি।

ঘটনার আগে কাশ্মীর সফরের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, “কাশ্মীরে আমরা সবাই অনেক মজা করেছি। আমার দিদির বিয়ে হয়েছে মাত্র দুই মাস। কিন্তু এই দুই মাসে উনি (শুভম) আমার দিদিকে অনেক জায়গায় ঘুরিয়ে এনেছে।”

“কাশ্মীর সফরে এসে এরপর দ্বিতীয় ট্রিপে প্যারিস যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল (শুভম)। দিদিকে বলেছিল বিয়ের ষষ্ঠ মাস উদযাপন করতে প্যারিস নিয়ে যাবে।”

ঐশান্যা দ্বিবেদী বিকম পাশ করেছেন। তিনি নাচ করেন, অনেক অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করেছেন। কিছুদিনের মধ্যেই নাচের ক্লাস শুরু করারও কথা ছিল।

শুভম দ্বিবেদীর আদি গ্রাম রুমায়, কানপুর জেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রাম। এই মুহূর্তে তাদের বাড়িতে গেলে দরজা দিয়ে প্রবেশ করেই পরিবারের অনেককে বসে থাকতে দেখা যাবে।

দরজা দিয়ে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়বে একটা সাদা চাদর বিছানো টেবিল। তার ওপরে রাখা আছে মালা পড়ানো প্রয়াত শুভম দ্বিবেদীর ছবি।

শুভমের চাচাতো ভাই সৌরভ বিবিসিকে বলছিলেন, “সরকারকে সন্ত্রাসবাদকে গোড়া থেকে নির্মূল করতে হবে এবং ভারতের প্রত্যেক নাগরিককে আশ্বস্ত করতে হবে যে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত যেখানেই থাকুন না কেন আপনি নিরাপদ।”

তিনি বলেন, “দাদার শেষকৃত্যের দিন মুখ্যমন্ত্রী এসেছিলেন। তিনি বৌদিকে বলেছেন, তুমি আমার মেয়ের মতো। তুমি যা করতে বলবে, আমরা তাই করব।”

ঐশান্যার দ্বিবেদী

‘ওরা মানুষ হতে পারে না’

শুভম দ্বিবেদীর শেষকৃত্যের দিন পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। দোষীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

শুভমের বোন আরতি বলেন, “দুই-চার দিন এই নিয়ে খবর হবে। তারপর সবাই আমার দাদাকে ভুলে যাবে। ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলা নিয়ে এখন কটা কথা হয়।”

“কারও কিছু যায় আসে না। আমার দাদার জন্য অবশ্যই এমন কিছু একটা করা উচিত যাতে অন্তত আমাদের শহর তাকে স্মরণ করতে পারে।”

পরিবারের একমাত্র ছেলের স্মরণে তার বাড়িতে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় পুজো হয়। সেই সময় পুরো পরিবার একসঙ্গে দেড় ঘণ্টা বসে। তার ছবিতে ফুল রেখে শ্রদ্ধা জানায়, তার সম্পর্কে পুরানো কথা বলে।

ঐশান্যা দ্বিবেদীর বোন বলেন, “ওর (শুভমের) কপাল ছাড়া অন্য কোথাও গুলি করা হলে হয়তো আমরা ওকে বাঁচাতে পারতাম। গুলি লাগার পর আমরা ওকে ততক্ষণ ধাক্কা দিয়ে সাড়া পাওয়ার চেষ্টা করেছি যতক্ষণ না বুঝতে পেরেছি যে ও আর বেঁচে নেই। বাকি শহীদের পরিবারের সকলে তাদের (নিহতদের) মুখ অন্তত দেখতে পেয়েছে। কিন্তু আমার জামাইবাবুর মুখটুকুও রক্ষা পায়নি।”

বাবা সঞ্জয় কুমার দ্বিবেদী বলেন, “সন্ত্রাসবাদীরা বশিরভাগ যুবকদেরকেই মেরেছে। ওরা নির্মমভাবে দেশের ভবিষ্যতকে হত্যা করেছে। কোনোমূল্যে সরকারকে চুপ করে বসে থাকলে চলবে না।”

আপনি কি মনে করেন শুধু হিন্দু বলে আপনার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে ঐশান্যা দ্বিবেদী বলেন, “আপনার মনে হয় সন্ত্রাসবাদের কোনো জাত আছে, ধর্ম আছে? তারা শুধুই সন্ত্রাসী। ওরা শুধু মানুষ হতে পারে না। ওরা দানব।”