Source : BBC NEWS

ধসে পড়ার পর রানা প্লাজা

ছবির উৎস, Getty Images

এক ঘন্টা আগে

বাংলাদেশের সাভারে নয় তলা ভবন রানা প্লাজা ধসের পর ১২ বছর পূর্ণ হচ্ছে। ওই ধসের ঘটনায় এগারোশোর বেশি শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছিলেন, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক।

বিশ্বের ভয়াবহতম শিল্প দুর্যোগের একটি হিসেবে এরই মধ্যে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে ওই ভবন-ধসের ঘটনা।

যেদিন রানা প্লাজা ভেঙ্গে পড়ে তার আগের দিনই ভবনটিতে ফাটল দেখা দিয়েছিল।

আর সেই ফাটল অগ্রাহ্য করেই পরের দিন ভবনটির পাঁচটি পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের কাজে ফিরতে বাধ্য করা হয়।

কী ঘটেছিল, ভবন-ধসের আগের দিন, অর্থাৎ ২৩শে এপ্রিল?

আরো পড়তে পারেন:
রানা প্লাজা ভবন ধসে এগারাে শাের বেশি মানুষ নিহত হন

ছবির উৎস, Getty Images

২৩শে এপ্রিল ২০১৩, মঙ্গলবার, সকাল আটটা

বাংলাদেশে ঘণ্টা দুয়েক আগেই শুরু হয়েছে বিরোধী জোটের টানা দুইদিনের হরতাল।

হরতালের আওতামুক্ত শিল্প হিসেবে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের পদচারণা শুরু হয়েছে সাভারে।

ব্যস্ত ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে নয় তলা ভবন রানা প্লাজা।

এই ভবনটিতেও দলে দলে ঢুকছে শত-শত নারী পুরুষ।

ভবনটির তিন তলা থেকে শুরু হয়ে নয়-তলা পর্যন্ত রয়েছে পাঁচটি তৈরি পোশাক কারখানা।

নিচতলা ও দোতলায় শপিং মল, সেখানে রয়েছে মােট ২৭০টি দোকান।

সেই সাথে ভবনে আছে বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের একটি শাখা।

এটি রানা প্লাজা ধসের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী ছবিগুলোর একটি

ছবির উৎস, Getty Images

তিন তলায় নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেড।

আর সবার মতোই সেদিন এই ফ্লোরের কাটিং সেকশনে এসে কাজ শুরু করেছিলেন সুপারভাইজার নুরুল ইসলাম খান।

এই কারখানাটিতে তখন তৈরি হচ্ছিল ইউরোপীয় ক্রেতাদের জন্য বাচ্চাদের প্যান্ট।

ঘটনার শুরু হয়েছিল এই তিন তলা থেকেই।

সকাল পৌনে ১০টা

তিন তলার একটি পিলারে হঠাৎ চড়চড় করে শব্দ হলো।

একটি সেলাই মেশিনের উপর সশব্দে খসে পড়লো দেয়ালের প্লাস্টার। আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করলেন শ্রমিকেরা।

এভাবেই ফাটল আবিষ্কারের ঘটনা বর্ণনা করছিলেন নুরুল ইসলাম খান।

“আমরা তখন কাউকে কিছু না বলে চেয়ারম্যানকে ফোন করি। তিনি আমাদের কারখানা ছুটি দিয়ে দিতে বলেন এবং তার সাথে দেখা করতে বলেন।”

মি. খান আরও বলেন, “পরে ম্যানেজার এসে আমাদের বলেন, এরকম দু-একটা পিলার না থাকলে কিছু হবে নাকি ব্যাটা! এখন কাজের যা চাপ!

আমরা নাইট করে কুলাতে পারছি না। ম্যানেজারের সাথে যখন কথা বলছিলাম তখনও আমি পিলারের ভেতর চড়চড় শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।”

ভবন ধসের পরের প্রায় এক মাস জুড়ে উদ্ধার কার্যক্রম চলেছে

ছবির উৎস, Getty Images

কিন্তু ফাটলের খবর চাপা থাকেনি।

বাংলাদেশের বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল একুশে টেলিভিশনের সাভার সংবাদদাতা নাজমুল হুদা কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার ক্যামেরা নিয়ে পৌঁছে যান ঘটনাস্থল রানা প্লাজায়।

রানা প্লাজার ফাটলের সংবাদ সংগ্রহ ও চিত্রধারণ কিন্তু সেদিন সহজ ছিল না মি. হুদার জন্য।

ওই সময় তাকে বারবারই বাধা দেয় রানা প্লাজা নামে ভবনটির মালিক ও সাভার যুবলীগের নেতা সোহেল রানার সঙ্গী-সাথীরা।

এমনকি এক পর্যায়ে মি. হুদাকে বের করে দিয়ে ভবনের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয় তারা।

এসময় তিনি কৌশলে সোহেল রানার একটা সাক্ষাৎকার নেন।

বেলা সাড়ে ১২টা

রানা প্লাজার ভেতরে নিজের কার্যালয়ে বসেই একুশে টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকার দেন সোহেল রানা।

তার বক্তব্য ছিল, “পিলারের ওখান থেকে চুল পরিমাণ প্লাস্টার খুলে পড়েছে। মানুষ তিলকে তাল বানাচ্ছে।”

”আমরা ইঞ্জিনিয়ার সাথে নিয়ে দেখে এসেছি। ইঞ্জিনিয়ার বলেছে এটা ঝুঁকিপূর্ণ না। দুয়েকদিনের মধ্যেই প্লাস্টার ঠিক করে ফেলা হবে।”

সাক্ষাৎকারে যে প্রকৌশলীর কথা উল্লেখ করেন মি. রানা, সংবাদদাতা নাজমুল হুদা জানান, ওই প্রকৌশলী ভবনটির কোনও কর্তৃপক্ষ নন।

তিনি মূলত রানা প্লাজা ভবন নির্মাণকালে সোহেল রানার নিয়োগ করা একজন বেসরকারি প্রকৌশলী, তার নাম আব্দুর রাজ্জাক।

আরো পড়তে পারেন:
ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে অনেক কম মানুষ জীবিত বের হতে পেরেছেন

ছবির উৎস, Getty Images

বেলা তিনটা

রানা প্লাজা পরিদর্শন করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবির হোসেন সরদার।

প্রকৌশলী আব্দুর রাজ্জাকের বরাত দিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, “অস্বাভাবিক কিছু না। একটা পিলারে কিছুটা ফাটল দেখা দিয়েছে। বিশাল আশংকার কোনও সম্ভাবনা নেই।”

২৪শে এপ্রিল ২০১৩, বুধবার, সকাল আটটা

বাংলাদেশে দ্বিতীয় দিনের মতো হরতাল চলছে সেদিন।

রানা প্লাজার শপিং মলের সব দোকান বন্ধ। বন্ধ ব্র্যাক ব্যাংকের শাখাটিও।

শুধু পাঁচটি পোশাক কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরা ভবনের সামনে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছেন।

আশপাশে মাইকে ঘোষণা দিয়ে বলা হচ্ছে, শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে।

সকাল সাড়ে আটটা

শ্রমিকেরা ঢুকে পড়েছে রানা প্লাজায়।

তিন তলা থেকে নয়-তলা, সবগুলো ফ্লোরেই শুরু হয়ে গেছে কাজ।

তিনতলায় কাজ শুরু করেছেন নিউ ওয়েভ বটমসের কাটিং সুপারভাইজার নুরুল ইসলাম খান।

“ফ্লোরে মাইকিং করে বলা হচ্ছে, ভবনটি ১৩ তলা ফাউন্ডেশন। কেবল নয় তলা হয়েছে।আতঙ্কিত হবার কারণ নাই কোনও।

আর যদি কোনও দুর্ঘটনা দেখা দেয়, আমাদের কমপ্লায়েন্সের লোক আছে চারিদিকে, তোমাদের দ্রুত বের হয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হবে,” বিবিসিকে বলছিলেন মি. খান।

১৭তম দিনে ধ্বংসস্তুপ থেকে জীবিত এবং অক্ষত অবস্থায় বের করে আনা হয় রেশমা বেগমকে

ছবির উৎস, Getty Images

সকাল আটটা চল্লিশ

মি. খান হঠাৎ দেখতে পান, চারদিকে কিছু লোক আতঙ্কিত-ভাবে দৌড়াতে শুরু করেছে।

“পনেরো বিশ-জন দৌড়ে বাইরে চলে গেল। লাইনের মেয়েগুলা সব দেখলাম দাঁড়িয়ে গেল। আমিও দাঁড়িয়ে আছি।

তখন অন্যরা আবার বলল, কিছু হয়নি, বসো বসো। তখন সব মেয়েরা আবার বসে পড়ল,” বলেন তিনি।

২৪শে এপ্রিল ২০১৩, বুধবার, সকাল আটটা ৪৭

ভেতরে থাকা কয়েক হাজার শ্রমিক নিয়ে ধসে পড়লো সাভারের রানা প্লাজা নামের নয় তলা ভবনটি।

এসময় সামনের মহাসড়ক পুরোটাই ধুলোয় ঢাকা পড়ে যায়।

শুরু হয় ভেতর থেকে প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে আসা শ্রমিকদের আর্ত চিৎকার।

ওই সময় মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় সেই চিত্র ধারণ করেন একজন পথচারী।

ভিডিওটি পরবর্তীতে বাংলাদেশের বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল সময় টেলিভিশনে প্রচারিত হয়।

স্বজন হারানাের বেদনায় কাতর মানুষের আর্তনাদ

ছবির উৎস, Getty Images

মাত্র কয়েক সেকেন্ডের সেই শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনা বাইরে থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন রানা প্লাজার ঠিক সামনেরই এক টি-স্টলের মালিক আব্দুল হামিদ ব্যাপারী।

“নয়টা বাজার ১৩ মিনিট বাকী আছে। বিল্ডিংটা একটা মোচড় খেয়ে ফট করে তিন সেকেন্ডের মধ্যে পড়ে গেল। তারপর ধুলায় অন্ধকার হয়ে গেল। কিছুই আর দেখি না।

আমার দুই হাত, চোখ-মুখ ধুলায় মেখে গেছে। পাঁচ মিনিট পরে আমি দৌড়ে পাশের চারতলা ভবনে ছাদে উঠে যাই, সেখানে আমার ছেলে ছিল।”

“ছেলেটা আমার মারা গেছে,” বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন মি. ব্যাপারী।

২৪ এপ্রিল ২০১৩, বুধবার, বাংলাদেশ সময় সকাল আটটা ৪৭ মিনিটে ঢাকার অদূরে সাভারে ঘটে গেল বিশ্বের ইতিহাসে ভয়াবহতম শিল্প-দুর্যোগগুলোর একটি।

এর পরের ঘটনাগুলো দ্রুতই ঘটতে থাকে।

উদ্ধার কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হওয়ার পর দুর্ঘটনাস্থল

ছবির উৎস, Getty Images

উদ্ধার অভিযানের নেতৃত্বে চলে আসে সেনাবাহিনী। তাদের সাথে দমকল, পুলিশ এবং বহু অপেশাদার স্বেচ্ছাসেবক যােগ দেন।

একের পর এক বের হতে থাকে মৃতদেহ।

প্রাথমিকভাবে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় সাভার অধরচন্দ্র মডেল হাই স্কুলের বারান্দা, মেঝেতে আর খেলার মাঠে।

আহতদের জায়গা হতে থাকে রানা প্লাজার অদূরের বেসরকারি হাসপাতাল এনাম মেডিকেল কলেজে।

প্রতিদিনই বাড়তে থাকে লাশের স্তুপ। আর কমতে থাকে জীবিতদের উদ্ধার করবার আশা।

১০ই মে ২০১৩, শুক্রবার

রানা প্লাজা ধসে পড়বার ১৭তম এই দিনটিতে ঘটে যায় এক বিস্ময়কর ঘটনা।

এদিন বিকেলে ধ্বংসস্তুপ থেকে বিস্ময়কর-ভাবে জীবিত এবং অক্ষত অবস্থায় বের করে আনা হয় রেশমা বেগম নামে এক গার্মেন্টস শ্রমিককে।

রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সাথে উদ্ধারকাজে যােগ দেন বহু সাধারণ মানুষ

ছবির উৎস, Getty Images

১৩ই মে ২০১৩, সোমবার

রেশমা বেগমকে উদ্ধারের তিনদিন পর সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে রানা প্লাজায় উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করে।

কুড়ি দিনের উদ্ধার তৎপরতায় রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপ থেকে বের করে আনা হয় এক হাজার একশ সাতাশটি মৃতদেহ।

জীবিত উদ্ধার করা হয় আড়াই হাজারের মতো মানুষ।

যাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করে।

এই প্রতিবেদনটি রানা প্লাজা ভবন ধসের ছয় মাস পূর্তির সময় ২০১৩ সালের অক্টােবরে প্রকাশ করা হয়েছিল।

দুর্ঘটনাস্থলে নির্মিত হয়েছে শ্রমিক আন্দােলনের প্রতীক কাস্তে-হাতুড়ি ভাস্কর্য

ছবির উৎস, Getty Images