Source : BBC NEWS

ছবির উৎস, Social Media
খালি পড়ে থাকা একটা সোফা, তার সামনে সুটকেসে জিনিসপত্র ভরে রাখা আছে। জানালাগুলোর পর্দা নামানো আর তার পাশেই রাখা ঘরোয়া গাছের টব, কিছু ঘর সাজানোর জিনিস আর সোফার কুশন যত্ন করে সাজিয়ে রাখা।
সামাজিক মাধ্যমে ফারসি ভাষাভাষী মানুষদের মধ্যে একটা ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে যেখানে তারা কিছু মন খারাপ করা ছবি দিচ্ছেন। শিরোনামে লেখা থাকছে, ‘দ্য লাস্ট ফটো অফ হোম’, অর্থাৎ বাড়ির শেষ ছবি।
যেসব মানুষ নিজেদের বাড়িতে তালা লাগিয়ে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তারাই এ ধরনের ছবি শেয়ার করছেন।
ইরানের ওপর সমানে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণের মধ্যেই রাজধানী তেহরানের অনেক বাসিন্দা যানজট আর পেট্রল পাম্পে লম্বা লাইন উপেক্ষা করেই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তারা নিশ্চিত নন যে ঘরে ফিরে এসে নিজেদের বাড়িঘর অক্ষত পাবেন কি না।

ছবির উৎস, Getty Images
‘নীরবে বিদায় জানালাম’
একজন লিখেছেন: “প্রিয়জনদের কাছ থেকে পাওয়া ছোটখাটো উপহার আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছি। গাছগুলোতে জল দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্ট সহ্য করাটা খুব কঠিন, বিশেষ করে আপনি যখন নিশ্চিত নন যে কখনো ফিরতে পারবেন কি না।”
আরেকজনের কথায়, ‘কখনো এত দুঃখ হয়নি। জানি না আর কোনো দিন ফিরতে পারব কি না।”
আরেকজন সামাজিক মাধ্যমে তার কাজ করার টেবিল, কম্পিউটার আর একজোড়া হেড-ফোনের ছবি দিয়ে লিখেছেন, “যেসব জিনিসগুলো পেতে এত পরিশ্রম করেছি, সেগুলোকে বিদায় জানালাম। এগুলো পেতে কত রাত জাগতে হয়েছে, মাথার চুল সাদা হয়ে গেছে। আশা করি যখন আমি ফিরে আসব, এগুলো এখানেই থাকবে।”
প্রায় এক কোটি মানুষের শহরটির আরেক বাসিন্দা লিখেছেন যে “বিশ্ববিদ্যালয় আর কাজ করার” অনেক স্বপ্ন নিয়ে তিনি রাজধানী শহরটায় এসেছিলেন।
অনেকে লিখছেন, “কত স্নেহ দিয়ে আর পরিশ্রম করে বাড়ির জন্য কত কিছু কিনে ঘরটা সাজিয়ে তুলেছিলাম। একদিনে আমার এই সুন্দর নিরাপদ আশ্রয়টায় ফিরে আসব, এই আশা নিয়েই আমি নীরবে বিদায় জানালাম।”

ছবির উৎস, Getty Images
বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক
ইসরায়েল সোমবার শহর খালি করার নির্দেশ জারি করার অনেক আগেই এই মানুষেরা সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন।
তেহরানের উত্তরাঞ্চলের একটা বড় এলাকার মানচিত্রে জায়গা চিহ্নিত করে দিয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে যে সেখানকার বাসিন্দাদের উচিত ‘অবিলম্বে’ এলাকা ত্যাগ করা।
ইসরায়েলের বিমান হামলার প্রথম চারদিনেই ইরানে অন্তত ২২৮ জন মারা গেছেন। আবার ইসরায়েলি শহরগুলোতে তেহরানের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় অন্তত ২৪ জন নিহত হয়েছেন।
প্রাথমিকভাবে পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাগুলো এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাই ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্য ছিল।
কিন্তু সংঘর্ষ যত বিস্তৃত হয়েছে, ততই আবাসিক এলাকাসহ রাজধানী তেহরানের ওপরে বহুবার হামলা চালানো হয়েছে। এর ফলে বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
দেশটির সরকারের আরোপ করা বিধিনিষেধের কারণে বিবিসির সাংবাদিকরা ইরানের অভ্যন্তর থেকে প্রতিবেদন পাঠাতে পারছেন না, তবে কয়েকজন ইরানি বিবিসি ফার্সি বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন।

ছবির উৎস, Getty Images
‘আমি কোথায় যাব?’
কয়েকজন বাসিন্দা যেমন জানিয়েছেন যে তারা থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তাদের কারও বৃদ্ধ বাবা-মা বা ছোট শিশুরা আছেন, কারও আবার চিকিৎসার প্রয়োজন আছে অথবা কারও হয়ত বিকল্প কিছুই নেই।
একজন নারী বিবিসি ফার্সিকে বলেন যে তিনি গর্ভবতী আর তার একটি ছোট কন্যা শিশু আছে, “যানজটের এই অবস্থার মধ্যে আমি কি বাঁচতে পারব? যা কিছু গড়েছি আমি, সবই তো এখানে… আমি কোথায় যাব?”
আরেক নারী বলেন যে তিনি অবিবাহিত এবং একা একা প্রায় আটশো কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে শিরাজে তার পরিবারের কাছে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে চান না।
“যদিও আমার একটা গাড়ি আছে, তবে তেহরান ছাড়ার ব্যাপারে আমার সব থেকে বড় ভয় হলো এতটা লম্বা রাস্তা, আর জ্বালানি পাওয়ার সমস্যা। তারপরে যদি গাড়ি খারাপ হয়ে যায়, তখন কী করব?” বলছিলেন ওই নারী।
তিনি আরও বলছিলেন যে তার যেসব বন্ধুরা তেহরান ছেড়ে চলে গেছে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে আছে।
তার কথায়, “সাধারণত যেখানে ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগে, সেখানে ওদের ২০ ঘণ্টা লেগে গেছে। এমনকি বাসের টিকিটও পাওয়া যাচ্ছে না।”
দুই সন্তানের মা, ৪০ বছর বয়সী এক নারী বিবিসিকে বলছিলেন তিনি “কোথাও যাচ্ছেন না”।
“সত্যি বলতে, এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি যে আমি ভাবতেই পারছি না যে চলে যাওয়ার পরে ফিরে এসে যদি দেখি যে আমার জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেছে। করোনা, মুদ্রাস্ফীতি সব কিছুর মধ্যেও এত বছর ধরে পরিশ্রম করেছি। যে জায়গায় পৌঁছিয়েছি, তার জন্য কঠিন লড়াই করতে হয়েছে। যদি সত্যিই সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে বরং সন্তানদের নিয়ে আমি আর আমার বাড়িও শেষ হয়ে যাক। কারণ আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করার শক্তি আমার আর নেই।”

ছবির উৎস, Getty Images
উদ্বেগে প্রবাসীরা
দেশের বাইরে বসবাসরত লক্ষ লক্ষ ইরানিও এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের যন্ত্রণাটা ভালো রকম টের পাচ্ছেন।
প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য উদ্বিগ্ন হয়েও তাদের একমাত্র ভরসা এমন ইন্টারনেট সংযোগ, যেটা আবার মাঝে মাঝেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
একজন ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী লিখেছেন, “আমরা ভাবতাম অভিবাসনের সবচেয়ে কঠিন দিকটা হলো বাড়ির জন্য মন খারাপ করা। তবে এই যুদ্ধের মধ্যে আমাদের এই শিক্ষাটা হলো যে বাড়ি থেকে দূরে থাকার উদ্বেগটা আসলে কীরকম।
কয়েকজন প্রবাসী ইরানি জানিয়েছেন যে তাদের অনুরোধ সত্ত্বেও দেশে থাকা তাদের আত্মীয়রা সরে যেতে রাজি হননি।
রাজধানী তেহরানে থাকা এক আত্মীয়কে এরকম অনুরোধ করে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন এক প্রবাসী। জবাব এসেছে, “কারও অর্থ নেই, কারও অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাই আমাদের শহর ছেড়ে সরে যেতে উপদেশ দিও না।”