Source : BBC NEWS
শূন্যরেখার কাছাকাছি কাঁটাতারের বেড়া দেয়াকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের যেসব স্থানে উত্তেজনা দেখা গেছে তার অন্যতম লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম ইউনিয়ন।
৫ই অগাস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার অন্যান্য জায়গার চেয়ে ভৌগলিক কারণে দহগ্রামের বাংলাদেশি নাগরিকদের দুশ্চিন্তা অনেক বেশি কারণ পুরো ইউনিয়নটি ভারতের ভেতরে অবস্থিত।
২২ বর্গকিলোমিটারের এই ভূখণ্ডে প্রায় হাজার বিশেক বাংলাদেশি নাগরিকের বসবাস। ভারতে অভ্যন্তরে তিন বিঘা করিডোর ব্যবহার করে বাংলাদেশের দহগ্রাম ইউনিয়নে প্রবেশ করতে হয়।
সরেজমিন দহগ্রামে গিয়ে বিবিসি বাংলা জানার চেষ্টা করেছে যে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ সেখানে কী ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে, আর সীমান্ত এলাকার মানুষের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ঠিক কী কারণে।
দহগ্রামে গিয়ে দেখা যায় সীমান্তের শূন্যরেখার পিলারের কাছ দিয়ে চারফুট উচ্চতায় লোহার অ্যাঙ্গেল বসিয়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে বিএসএফ। বুধবার এই বেড়ায় কাঁটাতারের সঙ্গে নির্দিষ্ট দূরত্বে কাচের বোতল বেঁধে দেয়া হয়েছে। সীমানা বেড়ার পাশ দিয়ে বিএসএসফ সদস্যদের সশস্ত্র অবস্থায় টহল দিতেও দেখা গেছে।
দহগ্রাম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান কামাল হোসেন প্রধান বিবিসি বাংলাকে বলেন, এরকম বেড়া নতুন করে দেয়া শুরু করেছে ভারত।
“আগেতো এরকম বেড়া দেয়নি। কিছু কিছু জায়গায় যেখানে বেশি একটু সমস্যা হয় সেখানে দিছে। কিন্তু ইদানিং ওরা কোনো জায়গা বাদ দিতেছে না। ওরা (বিএসএফ) বুঝাচ্ছে যে ক্যাটেল বেড়া। কাঁটাতারের বেড়া না ক্যাটেল বেড়া দিচ্ছি যাতে এদিকের গরু ছাগল ওদিকে না যায় ওদের জমিতে না যায়। এরকম দেখাচ্ছে।”
নতুন করে বেড়া দেয়ার পর গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে অনেকের মধ্যেই আতঙ্ক এবং উৎকণ্ঠা দেখা গেছে। দহগ্রামের সরকার পাড়া গ্রামের এক কিলোমিটারের বেশি এলাকায় সীমানা বেড়া স্থাপন করা হয়েছে। রাতের বেলায় সীমানা জুড়ে উচ্চ ক্ষমতার লাইট দিয়ে আলোকিত করা হয় যেটি নিয়েও আপত্তি দেখা গেছে।
দহগ্রামের সরকার পাড়ায় সীমান্তের পর বাংলাদেশে প্রথম বাড়িটি ফজলুল ইসলামের। সীমান্ত এলাকায় বসবাসের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ৫ই অগাস্টে সরকার পতনের পর থেকে পরিস্থিতি নানা কারণে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে। তার বাড়ির সামনেই তারকাঁটার বেড়া দেয়া হয়েছে। বুধবার তারকাঁটায় কাচের বোতল ঝুলিয়ে দিয়েছে বিএসএফ।
ফজলুল ইসলাম বিবিসিকে বলেন, বাংলাদেশে সরকার পতনের পর ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কে যে পরিবর্তন হয়েছে তার প্রভাব পড়েছে সীমান্তবর্তী দহগ্রামে মানুষের জীবনযাত্রায়।
“যখন থেকে মনে করেন সরকার পালায় গেল তখন থেকে আমরা খুব কষ্টতে আছি। সমস্যা মনে করেন- বেড়াকাঁটা যে দিলো এইটা একটা আতঙ্ক। শান্তিভাবে মনে করে তিনবিঘা করিডোর দিয়া হাটবাজার করতে পারতিছি না। এই বেড়াকাঁটা দেয়ার আগে মহিলা মানুষ ভাত নিয়ে যাইতেছে মাঠে, আমরা কাজ করতেছি ওরা (বিএসএফ) দিতেছে পিটেন।”
দহগ্রাম থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ বাহিরের জন্য একমাত্র পথ হলো তিনবিঘা করিডোর। তিনবিঘা করিডোর চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকলেও ৫ই অগাস্টের আগের তুলনায় কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন মি. ইসলাম।
“ট্রাক আসতি দেয় না বাস আসতি দেয় না। মনে করেন কলেজের একটা পিকনিক আসলো ওইখানে ঢুকতে দেয় না। হাটি আইসা ঘুরে যাইতেছে। আমরা বেরুবাড়ি দিয়ে এই তিনবিঘা করিডোর নিছি এটাতো স্বাধীন হওয়া চাই।”
নিয়ম অনুযায়ী সীমান্তে শূন্যরেখার দেড়শ গজের মধ্যে বেড়া দেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু ২০১০ সালে ভারত বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী দহগ্রামে শূন্যরেখা বরাবর বেড়া দেয়ার অনুমোদন পায় ভারত। এতদিন সেই বেড়া না দিলেও ৫ই অগাস্টের পর এই বেড়া দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে ভারত।
বাংলাদেশ সীমানা বেড়ার কাছে কৃষি কাজ, ক্ষেত খামারে কাজ করতে গিয়ে সমস্যা এবং বাধার মধ্যে পড়তে হয় বলে জানান স্থানীরা।
সীমান্তের পাশে বাংলাদেশ অংশে চাষাবাদ করেন মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন এখন সন্ধ্যার আগেই তাদের ক্ষেত-খামার থেকে বাড়ি ফিরতে হয়।
“জিরো লাইনে বেড়া দেয়ার কারণে আমরা মনে করেন ক্ষেতে-খামারে কাজ করতে খুব অসুবিধা হয়। বিএসএফ টাওয়ার থেকে এসে মাঝে মাঝে হুমকি মারে। ছোটরাও আসতে পারে না।”
সীমান্তে নিরাপত্তা এবং নজরদারির জন্য বিএসএফ রাতের আঁধারে সীমানাজুড়ে আলোকিত করতে উচ্চ ক্ষমতার বাতি জ্বালায়। এছাড়া ক্যামেরা দিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের নজরদারি করা হচ্ছে বলেও দহগ্রামের বাসিন্দারা উল্লেখ করেন। ভারতের বিএসএফ কর্তৃক ব্যবহৃত বাতি এবং ক্যামেরা নিয়েও আপত্তি আছে স্থানীয়দের।
“ওদের যে লাইটগুলো দিছে ওগুলো আমাদের দিকে। ক্ষেতে লাইট পড়ার কারণে আমাদের ফসলেরও অনেক ক্ষতি হচ্ছে। ওরা যে ক্যামেরা দিছে আমাদের সব তথ্য ওরা নিয়ে যাচ্ছে,” বলছিলেন আশরাফুল ইসলাম।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে গরু চোরাচালান একটা বড় সমস্যা। বিভিন্ন সময় চোরাচালানের অভিযোগে বিএসএফ পাচারকারী লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। গবাদি পশু পালনে দহগ্রামে সব সময় বিশেষ নিয়ম-কানুন ও ব্যবস্থা রয়েছে। তিনবিঘা করিডোর দিয়ে কতগুলো গরু বাংলাদেশে ভেতরে নিতে পারবে সেগুলোর নির্ধারিত এবং মালিকানার নিশ্চয়তা থাকতে হয়। গরুর মালিকানা ও নিবন্ধনের মাধ্যমে কার কয়টা গরু আছে সেটার হিসেব রাখার নিয়ম রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান এখন আগের তুলনায় কম গরু তিনবিঘা করিডোর দিয়ে একসঙ্গে পার করতে পারছেন। এছাড়া গরু মাঠে আনা-নেয়াতেও অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি সমস্যা হচ্ছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা হাবিবুর রহমান।
“আমাদের গরু আমরা বান্দি নিয়ে যাবো। আমাদের মাঠ আছে সেখানে। আমাদের গরু আনা নেয়া করতে গেলেও বিএসএফ’র বাধার মুখে পড়তে হয়। অনেক সময় নির্যাতন করে। বলে না গরু ভারত থেকে নিয়ে আসছে। এরকম করে বন্দুক উঠায়। বলে গুলি করে দেব। গরু নিয়ে যাইতে পারবেন না। আমাদের গরু কি আমরা ঘরে পুষবো?”
২০১১ সাল থেকে তিন বিঘা করিডোর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। অতীতে বড় বাস ও ট্রাক চলাচল করতো। স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং কৃষকরা জানান তাদের কৃষিপণ্য বা মালামাল পরিবহনে বাড়তি খরচ লাগছে দহগ্রামে ট্রাক না ঢুকতে দেয়ার কারণে।
প্রায় বছরখানেক ধরে ট্রাক প্রবেশ বন্ধ থাকলেও জরুরি প্রয়োজনে ট্রাক ঢোকার অনুমতি পেত বলে জানান স্থানীয়রা। তবে ৫ই অগাস্টের পর থেকে তিনবিঘা করিডোর দিয়ে দহগ্রামে মালবাহী বড় ট্রাক চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া পর্যটকবাহী বড় বাসও ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।
অতীতের তুলনায় এ বিষয়ে কড়াকড়ির কথা জানান দহগ্রাম বাজারের ব্যবসায়ী মো. ওহিদুল ইসলাম।
“বড় কোনও যানবাহন ঢুকতে দিচ্ছে না। এদিকে মালপত্র আনতে গেলে অনেক চাপ। মনে করেন একটা বস্তা আনতেছি ওটাও দেখা যাচ্ছে খুব চেকিং হচ্ছে। উল্টা-পাল্টা করতেছে। খুব সমস্যা,” বলছিলেন মি. ইসলাম।
আগে পরীক্ষানিরীক্ষা করতো কি না এ প্রশ্নে ওহিদুল ইসলাম বলেন, “আগে করতো হালকা- কোনওদিন করতো, কোনওদিন করতো না। এখন দেখা যাচ্ছে একবস্তা মাল আনতে গেলেও অনেক জবাবদিহিতা করতে হয়। একটু সন্ধ্যার সময় আসতে গেলে তাও বলে যে কার্ড দেখাও এখানকার তুমি নাগরিক কি না। কী নিচ্ছ না নিচ্ছ? এগুলা বলে। বাংলাদেশের বিজিবি দেখতে চায় না, ওরা (বিএসএফ) সমস্যা করে।”
গত সপ্তাহে দহগ্রামসহ সীমান্তে বেড়া দেয়াকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় তারপর বিভিন্ন স্থানে বেড়া দেয়া বন্ধ করা হয়েছে। তবে দহগ্রামে বিএসএফ যে জায়গায় বেড়া দিতে এসেছিল সেখানে কাজ শেষ করেই ফিরেছে। এছাড়া বুধবার কাঁটাতারে কাচের বোতল ঝুলিয়ে দিয়েছে বিএসএসফ। স্থানীয়রা এসব বোতল ঝোলানে নিয়ে নতুন করে উৎকণ্ঠা বোধ করছে। কেন এই বোতল সে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
বিষয়টি নিয়ে বিজিবির কর্মকর্তারা স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে বেড়া প্রটেকশনের জন্য এই বোতল ঝুলিয়েছে বিএসএফ।
সীমান্ত পরিস্থিতির এই উত্তেজনার মাঝে তিনবিঘা করিডোর এলাকায় মঙ্গলবার বিজিবি বিএসএফ এর মধ্যে পতাকা বৈঠক ও সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে। তবে সেখানে উপস্থিত কর্মকর্তারা বিবিসি বাংলার সাথে সীমান্ত এলাকার মানুষের উদ্বেগ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
সীমান্তে উত্তেজনা নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে।
এ বিষয়ে ভারতের হাইকমিশনার বলেন, “নিরাপত্তার জন্য সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া রয়েছে। এ ব্যাপারে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ও বিজিবির মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে। আমরা আশা করি, সীমান্তে অপরাধ দমনের বিষয়ে সহযোগিতার মাধ্যমে সেই বোঝাপড়ার বাস্তবায়ন হবে।”
সীমান্তে উত্তেজনা নিয়ে রোববার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী যে ব্রিফিং করেন সেখানে দহগ্রামের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন।
“২০১০ সালে একটা চুক্তি করা হয়, বলা হয় তিন বিঘা করিডোর চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকবে আমরা ইউজ করতে পারবো কিন্তু এইটার পরিবর্তে একটা বিরাট ঝামেলা করছে, জিরো লাইনের থেকে যে একশ পঞ্চাশ গজ দূরে যে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার কথা, দহগ্রামের ক্ষেত্রে বলছে যে জিরো লাইনের উপরে তারা ফেন্স করতে পারবে। লিগ্যালি এইখানে আমাদের বাধা দেয়ার ইয়ে নাই যেহেতু আমরা এইখানে সাইন করছি।”
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে তিনবিঘা করিডোরের ভিতরে যে দহগ্রাম আঙ্গরপোতা ওইটা হলো ভারতের পেটের ভিতরে। চারিদিকে ওরা, আমরা মাঝখানে। তো এইগুলি একটু আমাদের ট্যাক্টফুলি ইয়ে করতে হয়।”