Source : BBC NEWS
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণার পর বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদের অবস্থান জানা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া দল আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না সেটি নিয়ে রাজনীতির মাঠে নানা আলোচনা আছে। নির্বাচন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ কী ভাবছে দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের সাথে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছে বিবিসি বাংলা।
বাংলাদেশে গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ও নতুন দল গঠনের দ্বারপ্রান্তে থাকা ছাত্ররা বিভিন্ন সংস্কার করে অনুষ্ঠিতব্য আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সুযোগ না দেয়ার কথা বলছে।
ছাত্র নেতাদের দাবি, জুলাই হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত পতিত আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করার সুযোগ যেন না দেয়া হয়।
এদিকে, নির্বাচনে অংশ নেয়া, না নেয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের দুজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে দলটির অবস্থান জানতে চাওয়া হলে দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ.ফ.ম. বাহাউদ্দিন নাছিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, তারা নির্বাচনকে স্বাগত জানায় এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে নির্বাচনে অংশ নিতে চায়।
তবে, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বলছেন ভিন্ন কথা। তার ভাষায় এই অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কার্যক্রমকে তারা বৈধতা দিচ্ছে না। নির্বাচন নিয়ে এখনও কোনো উৎসাহ বা উদ্বেগ কিছুই নেই আওয়ামী লীগে।
কী বলছেন আওয়ামী লীগ নেতারা?
নির্বাচন বিষয়ে আওয়ামী লীগের ভাবনা জানতে চাইলে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নির্বাচনে সকল গণতান্ত্রিক শক্তি সকল রাজনৈতিক দল, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি যাতে অংশগ্রহণ করতে পারে। যেখানে সুনির্দিষ্ট কাউকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে অন্তবর্তী সরকার কোনো সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে কাজ করবে না অর্থাৎ সকলকে সমান অধিকার দিতে হবে। জনগণ তার ভোট দেবে। জনগণের ভোট দেয়ার অবাধ সুযোগ থাকতে হবে।”
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের একটা ভোটব্যাংক আছে উল্লেখ করে মি. নাছিম বলেন, অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ এবং সবদলের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
“আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার উপযুক্ত পরিবেশ আমরা চাই। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যেকোনও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য আমাদের দৃঢ় সংকল্প আছে এবং সবসময়ের জন্য আমাদের প্রস্তুতি থাকবে।”
তবে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমানের কথায় এই ইঙ্গিত স্পষ্ট যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া, না দেয়া নিয়ে নানা আলোচনা থাকলেও এখনো দলটি এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো অবস্থায় নেই।
মি. রহমান বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, এই অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কার্যক্রমকে তারা বৈধতা দিচ্ছে না। নির্বাচন নিয়ে এখনও কোনো উৎসাহ বা উদ্বেগ কিছুই নেই আওয়ামী লীগে।
“তারা একটা নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে এবং সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আদৌ যাবে কি যাবে না। সেই ব্যাপারে আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও হয় নাই।”
মি. রহমান জানান, এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবেন দলের দলীয় প্রধান।
“এই সিদ্ধান্ত আমাদের যিনি দলের নেতা দলীয় প্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তিনি নিশ্চয় যাদের যাদের সঙ্গে মনে করেন আলোচনা করে ঠিক করবেন। তিনিই সিদ্ধান্ত জানাবেন।”
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দেয়ার যে অবস্থান সে বিষয়ে মি. রহমান প্রশ্ন তুলেছেন।
“আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে তাদের মধ্যে এত ভীতি কেন। আওয়ামী লীগতো তাদের ভাষায় ফ্যাসিবাদ, তাদের ভাষায় গণধিকৃত; বাংলাদেশের মানুষই ঠিক করবে কোন দল রাজনীতিতে থাকবে কোন দল থাকবে না। কোন দল মানুষ গ্রহণ করবে কোন দল করবে না। যারা ভোটবিহীন, মানুষবিহীন, নির্বাচনবিহীন নেতা হতে চায়, ক্ষমতা দখলে রাখতে চায় তারা আওয়ামী লীগকে ভয় পায়।”
আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দিলে সেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে বলে উল্লেখ করেন নেতা বাহাউদ্দিন নাছিম।
“আওয়ামী লীগকে যে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে দেয়া হবে না সেটাতো কোনো নির্বাচন বাংলাদেশে হবে না। বাংলাদেশের মানুষও গ্রহণ করবে না, বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর কারোকাছেই এটা গ্রহণযোগ্য হবে না।”
‘আত্মগোপনে’ আওয়ামী লীগ নেতারা
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ এখন বাংলাদেশে রাজনীতি করারই সুযোগ পাচ্ছে না। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে অবস্থান নিয়েছেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও পর্যায়ক্রমে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গেছেন। সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নেতারা ঘরছাড়া হয়েছেন।
আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত গোপালগঞ্জ জেলায় সরেজমিন গিয়েও দলটির পদধারী কোনো নেতাকে কথা খুঁজে পাওয়া যায়নি। দলীয় দিকনির্দেশনা কিংবা ভবিষ্যৎ নির্বাচন নিয়ে তৃণমূলের নেতারাও কথা বলতে রাজি হননি।
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলের এ অবস্থা গোপালগঞ্জের মানুষের কাছে ‘কল্পনাকেও হার মানিয়েছে’।
শুধু গোপালগঞ্জ নয় সারাদেশেই আওয়ামী লীগ নেতাদের একই রকম অবস্থা। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো কেউ দেশে নেই।
নেতাশূন্য এই পরিস্থিতি নিয়ে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মি. নাছিম বলেন, মামলা, হামলা এবং নির্যাতনের কারণেই এ পরিস্থিতি।
রাজনীতি এবং কর্মসূচি দূরে থাক, বাড়িতে অবস্থান করাও এখন আওয়ামী লীগের নেতাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিলেও আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে।
“আমরাতো আত্মগোপনে আছি। আমরা স্বাভাবিক জীবনে স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি। আওয়ামী লীগকে তার সমস্ত কর্মকাণ্ড থেকে তারা নিষিদ্ধ করেছে অলিখিতভাবে।”
গত পনের বছর কতৃত্ববাদী শাসন, দুর্নীতি, ভোটে অনিয়ম, গুম-খুন এবং জুলাই আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের দায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থান যে পর্যায়ে নামিয়েছে সেখান থেকে উত্তরণ খুব সহজ নয় বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
কারণ ‘স্বৈরাচার’, ‘ফ্যাসিস্ট’ তকমা আর গণহত্যায় দায়ে অভিযুক্ত শীর্ষ নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের সামনে বড় সংকট হিসেবেই থাকবে।
আওয়ামী লীগ নেতা বাহাউদ্দিন নাছিম বলছেন ভবিষ্যতে ভুল ত্রুটি সামনে এনেই রাজনীতিতে এবং জনগণের কাছে ফিরতে চায় দলটি।
“আমরা যদি ভুল করি মানুষ খারাপ বললে সেই সমালোচনা মেনে নিয়ে আমরা শোধরাবার চেষ্টা করবো। অভিজ্ঞতা নিয়ে আরো সমৃদ্ধ কাজ করার চেষ্টা করবো। আমরা খারাপটাকে বর্জন করবো। খারাপ যদি করে থাকি সেটার জন্য অবশ্যই উপযুক্ত পরিবেশ পেলে আমরা দলীয় মূল্যায়ন করে দেশের মানুষের কাছে গিয়ে তুলে ধরবো।”
সুষ্ঠু ভোটের মধ্যে দিয়ে জনগণ যাকে চাইবে আওয়ামী লীগ মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত আছে বলেও উল্লেখ করেন মি. নাছিম।
“একটি নিরপেক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনে মানুষ যাদেরকে ভোট দেবে তাদেরকে মেনে নেয়ার মতো সৎসাহস আওয়ামী লীগের আছে। বাংলাদেশের গণমানুষ, তরুণ প্রজন্মকে সাথে নিয়েই আমরা গণ-আন্দোলন করেই এই সরকারের সকল অশুভ পরিকল্পনাকে মোকাবেলা করবো প্রতিহত করবো।”