Source : BBC NEWS

গত ১৫ দিনে ভারত ও পাকিস্তান এক অপরের বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থার ঘোষণা দিয়েছে

ছবির উৎস, Getty Images

এক ঘন্টা আগে

ভারত শাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে পর্যটকদের ওপরে বন্দুকধারীদের হামলা হয়েছিল এপ্রিলের ২২ তারিখ। ওই হামলার জন্য পাকিস্তানের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছিল ভারত। তার ঠিক ১৫ দিন পরে বুধবার মাঝরাতের কিছু পরে ২৫ মিনিট ধরে পাকিস্তানের নির্দিষ্ট কিছু স্থাপনা লক্ষ্য করে আকাশ পথে হামলা চালিয়েছে ভারত।

ভারত তাদের এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলার নাম দিয়েছে ‘অপারেশন সিন্দুর’।

বিগত ১৫ দিনে ভারত আর পাকিস্তান – দুই দেশই পাল্টা-পাল্টি বিবৃতি দিয়েছে, ঘোষণা করেছে বেশ কিছু কড়া ব্যবস্থারও।

গত ১৫ দিনের ঘটনাক্রম ঠিক কীরকম ছিল, সেটাই ফিরে দেখা:

  • ২২শে এপ্রিল:

ভারত শাসিত কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র পহেলগামের বৈসরণ উপত্যকায় বন্দুকধারীদের হামলায় ২৫ জন পর্যটক এবং একজন স্থানীয় ঘোড়াচালক নিহত হন। পর্যটকদের মধ্যে একজন নেপালের নাগরিকও ছিলেন। হামলাকারীদের ধরার জন্য ব্যাপক তল্লাশি অভিযান চালায় ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলি। কিন্তু এখনও তাদের ধরা যায় নি।

সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ছিলেন সৌদি আরব সফরে। মি. মোদী ওই সফর কাটছাঁট করে দেশে ফিরে আসেন। আবার তখনই ভারত সফর করছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স। হামলার পরেই কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে পৌঁছন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ।

  • ২৩শে এপ্রিল:

পহেলগামের হামলার জন্য পাকিস্তানের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে ভারত প্রথমেই ঘোষণা করে যে ১৯৬০ সালের সিন্ধু জল চুক্তি তারা স্থগিত করছে। একই সঙ্গে সীমান্ত চৌকি আটারি বন্ধ করে দেওয়া হয়, ‘সার্ক দেশগুলোর জন্য ভিসা ছাড়’ প্রকল্পের আওতায় যে পাকিস্তানীরা বিশেষ ভিসা পেয়েছিলেন, তা বাতিল করে ভারত। এক সপ্তাহের মধ্যে দিল্লি ছাড়তে নির্দেশ দেওয়া হয় পাকিস্তানের সামরিক পরামর্শদাতাদের এবং পাকিস্তানের দূতাবাসের কর্মী সংখ্যাও কমিয়ে দেওয়া হয়।

এদিনই বিকেলে ভুল করে পাঞ্জাবের ফিরোজপুর সেক্টরের সীমান্ত পেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে যান পিকে সিং নামে বিএসএফের এক প্রহরী। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে আটক পাক রেঞ্জার্স। মি. সিংয়ের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলায়। এখনও তাকে ছাড়ে নি পাকিস্তানি বাহিনী।

বিবিসি বাংলায় আরও পড়তে পারেন
ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্রের হামলায় পাকিস্তানে ধ্বংস হওয়া দুটি ভবন
  • ২৪শে এপ্রিল:

ভারতের একগুচ্ছ ঘোষণার পরের দিন পাকিস্তানও ভারতের বিরুদ্ধে একই ধরণের ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা করে। পাকিস্তান সিমলা চুক্তি সহ সমস্ত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্থগিত করার কথা জানায়। তাদের দিকের সীমান্ত চৌকি ওয়াঘা বন্ধ করে দেয় পাকিস্তান এবং ভারতের দূতাবাসে সামরিক পরামর্শদাতাদের দেশ ছাড়তে বলে দেয়।

এদিন আবার ভারত পাকিস্তানের সব নাগরিকেরই ভিসা বাতিল করে তাদের দেশ ছাড়তে বলে।

ওই দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিহারে এক নির্বাচনী সভায় ঘোষণা করেন যে “ভারত এই সন্ত্রাসীদের প্রত্যেককে এবং তাদের মদতদাতাদের চিহ্নিত করে খুঁজে করবে আর শাস্তি দেবে।” তিনি এও বলেছিলেন যে এদের এমন “শাস্তি দেওয়া হবে যা তারা কল্পনাও করতে পারছে না।”

ওদিকে ২৪ তারিখেই উধমপুরে তল্লাশি চালানোর সময়ে বন্দুকধারীদের সঙ্গে সেনার গুলির লড়াই শুরু হয়। এই সংঘর্ষে মারা যান পশ্চিমবঙ্গের এক সেনা সদস্য ঝন্টু আলি শেখ। তিনি ৬ প্যারা স্পেশাল ফোর্সে কর্মরত ছিলেন।

  • ২৫শে এপ্রিল:

ভারত সরকার এদিন একটি সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে পহেলগামের হামলার পরে ভারত কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সে সম্পর্কে ১৫টি রাজনৈতিক দলকে অবহিত করে। লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী এবং কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে সহ দলমত নির্বিশেষে নেতারা পহেলগাম হামলার বদলা নেওয়ার জন্য যে কোনও পদক্ষেপে সরকারকে পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস দিন।

এদিনই পাকিস্তান জানায় যে সিন্ধু নদের জল চুক্তি স্থগিতের যে সিদ্ধান্ত ভারত নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে মধ্যস্থতার জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে যাবে তারা। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “ভারত যদি সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তি নিয়ে এখনই কোনও পদক্ষেপ নেয়, তাহলে তা যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে গণ্য হবে।

একই দিনে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেয় ইরান।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি দুই দেশের মধ্যে মধ্যস্থতা করে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন।

নিজের এক্স হ্যান্ডেলে তিনি লেখেন, “ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের শত বছরের সাংস্কৃতিক ও সভ্যতার সম্পর্ক এবং ভ্রাতৃত্ব-বোধ রয়েছে। আমরা তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছি। এই কঠিন সময়ে দিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যে সুসম্পর্কের মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত তেহরান।

পহেলগামে পর্যটকদের ওপরে হামলার ঠিক ১৫ দিন পরে ভারত পাকিস্তানে 'অপারেশন সিন্দুর' নামের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় বুধবার

ছবির উৎস, Getty Images

  • ২৮শে এপ্রিল:

চিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এবং পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের মধ্যে পহেলগামের হামলা নিয়ে ফোনালাপ হয়। ওই কথোপকথনের পর চীন পাকিস্তানের ‘নিরপেক্ষ তদন্তের’ দাবিকে সমর্থন জানায়। চীনের সরকারি সংবাদমাধ্যম জানায় যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে চীন।

এদিন থেকেই পহেলগামের হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে অনেক কথিত সন্ত্রাসীদের পরিবারের বাসভবন গুঁড়িয়ে দেওয়া শুরু করে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী।

  • ২৯শে এপ্রিল:

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল অনিল চৌহান এবং সেনা, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে মি. মোদী জানান যে ভারতের কী প্রতিক্রিয়া হবে,, তার ধরণ, লক্ষ্যবস্তু এবং দিনক্ষণ সম্বন্ধে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবে সামরিক বাহিনীগুলিই।

  • ৩০শে এপ্রিল:

পহেলগাম হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা ও সংঘাতের আশঙ্কায় বিশ্বের অনেক দেশ সংযমের আবেদন জানিয়েছে।

এদিন চীন, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক ও কাতার আশা প্রকাশ করেছে, ভারত ও পাকিস্তান উত্তেজনা কমাবে। তবে পহেলগামের হামলার পর থেকে প্রতিদিনই নিয়ন্ত্রণরেখায় দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে গোলাগুলিও চলেছে।

এদিনই পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ এক বিবৃতিতে ইঙ্গিত দেন যে ভারত ও পাকিস্তান সম্ভবত যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এবং পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত কোনও পদক্ষেপ নিতে পারে।

ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চলাকালীন ছবি

ছবির উৎস, Reuters

  • পয়লা মে:

পহেলগামে ভারতীয় পর্যটকদের ওপর হামলার পর উত্তেজনা প্রশমনের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি এদিন আহ্বান জানান মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট মার্কো রুবিও। সেদিন তিনি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এস জয়শঙ্করকে বলেন, উত্তেজনা প্রশমনে ভারতের উচিত পাকিস্তানের সঙ্গে কাজ করা।

তারপরেই মি. রুবিও কথা বলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গেও। তাকে তিনি বলেন যে পহেলগাম হামলার নিন্দা করা উচিত এবং তদন্তে পাকিস্তানের সহযোগিতা করা উচিত।

  • দোসরা মে:

পহেলগামের হামলার জন্য পাকিস্তান আংশিকভাবে দায়ী বলে মন্তব্য করে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার আশা প্রকাশ করেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স।

  • তেসরা মে:

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ ভারতকে হুঁশিয়ারি দিয়ে এদিন বলেন যে পাকিস্তানে জল প্রবাহ বন্ধ করার জন্য যে কোনও স্থাপনা নির্মাণ করা হলে তা ধ্বংস করে দেওয়া হবে।’

জিও নিউজের ‘নয়া পাকিস্তান’ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “ভারত যদি সিন্ধু জল চুক্তি লঙ্ঘন করে জল বন্ধ বা অন্য দিকে চালিত করার জন্য কোনও কাঠামো তৈরি করে তবে এটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণ হিসাবে বিবেচিত হবে এবং আমরা সেই কাঠামোটি ধ্বংস করব।

'অপারেশন সিন্দুর' -এর বিস্তারিত সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন ভারতীয় বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার  ভ্যুমিকা সিং (বাঁয়ে) ও সেনাবাহিনীর কর্নেল সোফিয়া কুরেশি (ডাইনে)

ছবির উৎস, Getty Images

  • চৌঠা মে:

এদিন জানা যায় যে নিয়ন্ত্রণরেখার কাছাকাছি অঞ্চলের মাদরাসাগুলি বন্ধ করে দিয়েছে পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের প্রশাসন। ওই অঞ্চলের অন্যান্য এলাকায় অন্তত এক হাজার মাদ্রাসা ১০ দিন ধরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে বিবিসি জানতে পারে। তবে সেখানকার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খোলা রয়েছে।

  • পাঁচই মে:

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে কথা বলেন। ওই কথোপকথনে মি. পুতিন পহেলগামে পর্যটকদের উপর হামলার নিন্দা করেন।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে জারি করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতকে সমর্থন জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন”।

এদিনই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে সাতই মে অসামরিক প্রতিরক্ষা মহড়া চালানোর নির্দেশ দেয়।

  • ছয়ই মে:

ইসলামাবাদের অনুরোধে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ পরিস্থিতি নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে।

  • সাতই মে:

রাত ১টা ৫ মিনিট থেকে দেড়টার মধ্যে পাকিস্তান ও পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের নয়টি জায়গার ২৪টি স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালায় ভারত।