Source : BBC NEWS

ছবির উৎস, Narendra Modi/Facebook and Getty Images
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ গত সপ্তাহে পাকিস্তানের জন্য ১০০ কোটি ডলারের ‘বেলআউট প্যাকেজ’ (সহায়তা ঋণ) অনুমোদন করে যার তীব্র বিরোধিতা করেছিল ভারত।
দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের সময় একাধিক প্রশ্ন তুলে পাকিস্তানের জন্য আইএমএফ এর ঋণ সহায়তা অনুমোদনের বিরোধিতা করেছিল ভারত।
কিন্তু তা সত্ত্বেও আইএমএফ বোর্ড গত বছর অনুমোদিত ৭০০ কোটি ডলারের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি (১০০ কোটি ডলার) অনুমোদন করে জানিয়েছে, ইসলামাবাদ দেখিয়েছে তারা পরিকল্পনা অনুযায়ী নেওয়া কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়িত করেছে যার ফলে পাকিস্তানে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার অব্যাহত আছে।
আইএমএফ আরও জানিয়েছে ‘পরিবেশগত ঝুঁকি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ মোকাবিলা করার জন্য পাকিস্তানের প্রচেষ্টাকে তারা সমর্থন করে যাবে। পাশাপাশি এই ইঙ্গিতও তারা দিয়েছে যে ভবিষ্যতে ১৪০ কোটি ডলারের পরবর্তী কিস্তিও পাকিস্তান পাবে।

ছবির উৎস, AFP via Getty Images
ভারতের বক্তব্য
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নেওয়া এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভারত কড়া ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে এবং মূলত দুটো কারণ উল্লেখ করে প্রশ্নও তুলেছে।
সংশোধনমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়নে পাকিস্তানের ‘রেকর্ড খারাপ’ সেই যুক্তি দিয়ে এই জাতীয় ‘বেলআউটের’ (অর্থনৈতিক সহায়তার) ‘কার্যকারিতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ভারত।
কিন্তু তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ যে ‘আশঙ্কা’ নিয়ে ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তা হলো, পাকিস্তানের ওই তহবিল “রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আন্তসীমান্ত সন্ত্রাসের” জন্য ব্যবহার হবে কি-না।
যদিও পাকিস্তান বরাবরই এই অভিযোগ (রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসের) খারিজ করে এসেছে।
ভারত জানিয়েছে, আইএমএফ নিজেকে এবং তার ‘দাতা’দের “খ্যাতিকে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে” এবং “বৈশ্বিক মূল্যবোধকে উপহাস করছে”।
বিবিসি আইএমএফ-এর কাছে ভারতের এই অবস্থান নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর মেলেনি।
প্রসঙ্গত, পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, দিল্লির তোলা প্রথম প্রশ্নের কিছুটা ‘যুক্তি’ রয়েছে।
কারণ, আইএমএফ-এর কাছ থেকে ক্রমাগত আর্থিক সহায়তা চাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে পাকিস্তানের দিক থেকে।
১৯৫৮ সাল থেকে ২৪ বার আইএমএফ-এর ঋণ সহয়তা পেয়েছে পাকিস্তান। অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনিক ব্যবস্থা উন্নয়নের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নিয়েই এই অনুদানের আর্জি জানিয়ে চলেছে তারা।
যুক্তরাষ্ট্রে দায়িত্বপালনকারী পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুসেইন হাক্কানি বিবিসিকে বলেন, “আইএমএফের কাছে যাওয়ার অর্থ আইসিইউতে (হাসপাতালের ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট) যাওয়ার মতো। একজন রোগী যদি ২৪ থেকে ২৫ বার আইসিইউতে যান, তার মানে কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ ও উদ্বেগ রয়েছে যা মোকাবিলা করা দরকার।”
আইএমএফ “সীমান্ত সন্ত্রাসবাদের অব্যাহত পৃষ্ঠপোষকতাকে পুরস্কৃত করছে” এবং “এর মাধ্যমে বিশ্ব সম্প্রদায়কে একটি ভয়াবহ বার্তা দিচ্ছে” বলে ভারত যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তার উত্তর দেওয়া অনেক জটিল।
বরং, ভারতের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ঋণের বিষয়ে কিছু করার ক্ষেত্রে আইএমএফ-এর ক্ষমতা সীমিত এবং এটা প্রধানত “পদ্ধতিগত ও প্রযুক্তিগত আনুষ্ঠানিকতার দ্বারা সীমাবদ্ধ”।

ছবির উৎস, Photothek via Getty Images
আইএমএফ কী?
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এমন এক সংস্থা, যা বিশ্বব্যাপী আর্থিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজতর করা, উচ্চ কর্মসংস্থান এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি এবং বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্য হ্রাস করার উদ্দেশ্যে কাজ করে।
এই মুহূর্তে ১৯১টা দেশ এর সদস্য।
নির্বাহী বোর্ড (বোর্ড) আইএমএফের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করে। বোর্ড ২৫ জন ‘ডিরেক্টর’ নিয়ে গঠিত, যারা সদস্য দেশ বা দেশগুলোর গোষ্ঠী দ্বারা নির্বাচিত।
একজন ম্যানেজিং ডিরেক্টর রয়েছেন, যিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। আইএমএফ-এর বর্তমান ম্যানেজিং ডিরেক্টর হলেন ক্রিস্টালিনা জরজিভা।
যে কোনো দেশ আইএমএফ-এ যোগদানের জন্য আবেদন করতে পারে। তবে তাদের কয়েকটা প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করতে হবে।
এর মধ্যে রয়েছে সে দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করা এবং ‘কোটা সাবস্ক্রিপশন’ করা। আইএমএফ-এর তহবিলে সংশ্লিষ্ট দেশের অবদানকে ‘কোটা সাবস্ক্রিপশন’ বলা হয়।
যে দেশ যত ধনী, তার ‘অবদান’ তত বেশি।
আইএমএফ সদস্য দেশের অর্থনীতি পর্যবেক্ষণ ও সমর্থন করার জন্য মূলত তিনটা কাজ করে।
সেই তালিকায় রয়েছে, সদস্য দেশের অর্থনৈতিক এবং আর্থিক ঘটনার ট্র্যাকিং করা। সদস্য দেশগুলোর পরিচালনা ব্যবস্থাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং বাণিজ্য বিরোধ বা ব্রেক্সিট-এর মতো কারণে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তার মতো সম্ভাব্য ঝুঁকির ওপরও লক্ষ্য রাখে আইএমইএফ।
সদস্য দেশগুলোর কীভাবে তাদের অর্থনীতির উন্নতি করতে পারে সে সম্পর্কে পরামর্শ দেয় এবং ধুঁকতে থাকা দেশগুলোকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ও সহায়তা দেয়।
এই ঋণগুলো মূলত কোটা সাবস্ক্রিপশন থেকে আসা অর্থ থেকেই দেওয়া হয়।
কেন গঠন করা হয়েছিল?
যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৪৪ সালে অনুষ্ঠিত ব্রেটন উডস সম্মেলনের মাধ্যমে আইএমএফ গঠিত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নসহ ৪৪টা দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন ওই অনুষ্ঠানে।
তারা যুদ্ধ পরবর্তী আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন। এই বিষয়গুলোর মধ্যে প্রধান ছিল কীভাবে বিনিময় হারের একটা স্থিতিশীল ব্যবস্থা স্থাপন করা যায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত ইউরোপীয় অর্থনীতির পুনর্নির্মাণের অর্থ প্রদান করা যায়।
এই লক্ষ্য পূরণের জন্য পরে দু’টো সংস্থা স্থাপন করা হয়েছিল- আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক।
নবগঠিত আইএমএফের সদস্যরা স্থির বিনিময় হারের একটা ব্যবস্থায় সম্মত হন। স্থির করা হয় তা ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিক পর্যন্ত বহাল থাকবে।
কীভাবে ভোট হয়?
আইএমএফ বোর্ডে ভারত রয়েছে। কিন্তু এই তহবিলে ভারতের প্রভাব সীমিত। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারত নিয়ে গঠিত চার-দেশের গ্রুপের প্রতিনিধিত্ব করে ভারত। পাকিস্তান ইরানের প্রতিনিধিত্বকারী মধ্য এশিয়া গ্রুপের অংশ।
জাতিসংঘের ‘ওয়ান নেশন ওয়ান ভোট’- এর বদলে আইএমএফ-এর বোর্ডের সদস্যদের ভোটের অধিকার দেশটার অর্থনৈতিক আকার এবং তার ‘কন্ট্রিবিউশন’ (তহবিলে অবদানের) ওপর নির্ভর করে।
এই ব্যবস্থা নিয়ে অবশ্য সমালোচনা বেড়েছে, কারণ এটা “উন্নয়নশীল দেশগুলোর চেয়ে ধনী পশ্চিমা দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়।”
উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকায় ভোট শেয়ার সবচেয়ে বেশি ১৬.৪৯ শতাংশ, যেখানে ভারতে মাত্র ২.৬ শতাংশ।
আইএমএফের নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয় না। হয় বোর্ডের সদস্যরা পক্ষে ভোট দিতে পারে বা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে। যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তা বোর্ডের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নেওয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অর্থনীতিবিদ বিবিসিকে বলেন, “এ থেকে বোঝা যায় ক্ষমতাধর দেশগুলোর কায়েমি স্বার্থ কীভাবে কোনো সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে।”
ভারত ২০২৩ সালে যখন ‘জি-২০’-র সভাপতিত্ব করেছিল, সেই সময় আইএমএফ এবং অন্যান্য বহুপাক্ষিক ঋণদাতাদের কথা মাথায় রেখে জন্য ‘সংস্কার করার’ প্রস্তাব এনেছিল। এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য ছিল ‘এই ভারসাম্যহীনতা’কে মোকাবিলা করা।
ভারতের সাবেক আমলা এন কে সিং এবং সাবেক মার্কিন অর্থমন্ত্রী লরেন্স সামার্স তাদের প্রতিবেদনে ‘গ্লোবাল নর্থ’ এবং ‘গ্লোবাল সাউথ’ উভয়ের জন্য ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে আইএমএফের ভোটাধিকার এবং আর্থিক অনুদানের মধ্যে যোগসূত্র ছিন্ন করার সুপারিশ করেছিলেন।
কিন্তু সেই সমস্ত সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কোনোরকম অগ্রগতি দেখা যায়নি।

ছবির উৎস, Bloomberg via Getty Images
আইএমএফ কি নিজেই ‘নিয়ম বদলেছে’?
সংঘাতে জড়িয়ে পড়া দেশগুলোকে অর্থায়নের বিষয়ে আইএমএফ তাদের নিজস্ব নিয়মে যে সাম্প্রতিক পরিবর্তন এনেছে তা ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তোলা ইস্যুকে আরও ‘জটিল’ করে তুলেছে।
ইউক্রেনকে ২০২৩ সালে ইউক্রেনকে ১,৫৬০ কোটি ডলার ঋণ দেয় আইএমএফ। এটাই প্রথমবার আইএমএফ-এর তরফে যুদ্ধরত কোনো দেশকে দেওয়া ঋণ।
দিল্লিতে অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) মিহির শর্মা বিবিসিকে বলেন, “ইউক্রেনকে বিশাল ঋণ প্যাকেজ দেওয়ার জন্য নিজস্ব নিয়ম ভঙ্গ করেছে তারা (আইএমএফ)। যার অর্থ পাকিস্তানকে ইতিমধ্যে করা ঋণ বন্ধ করতে তারা সেই অজুহাত ব্যবহার করতে পারে না।”

ছবির উৎস, Sean Gallup/Getty Images
কী উপায়?
মি. হাক্কানি বলেন, ভারত যদি সত্যিই তাদের অভিযোগের সমাধান চায়, তবে সঠিক ফোরাম হলো জাতিসংঘের এফএটিএফ (ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স)।
এফএটিএফ ‘সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের’ বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বিষয়ের ওপর নজর রাখে।
এই টাস্কফোর্স সিদ্ধান্ত নেয় কোন দেশকে ‘গ্রে বা ব্ল্যাক লিস্ট’ (ধূসর বা কালো তালিকাভুক্ত)-এর আওতায় রাখা উচিত যাতে তারা আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থ অ্যাক্সেস করা থেকে ‘বিরত’ থাকে।
মি. হাক্কানি বলেন, “এই প্রসঙ্গে আইএমএফ-এ ভারতের অবস্থান কাজ করার কথা নয় এবং তা কাজ করেওনি। যদি কোনো দেশ এফএটিএফ তালিকায় থাকে, তবে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে, যেমনটা অতীতে পাকিস্তানের সঙ্গে ঘটেছে।”
তবে জানা যাচ্ছে, পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে এফএটিএফ-এর ধূসর তালিকা থেকে ২০২২ সালে বাদ দেওয়া হয়েছে।

আইএমএফ সংস্কারের দাবি
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে জানিয়েছেন, আইএমএফ-এর তহবিল প্রক্রিয়া ঢেলে সাজানো এবং ভেটো ক্ষমতা সংক্রান্ত ভারতের দাবি দুইদিকে ধার যুক্ত তলোয়ার হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে।
মি. শর্মা বলেন, “এই ধরনের সংস্কার হলে (দিল্লির চেয়ে) বেজিংকে বেশি ক্ষমতা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি।”
মি. হাক্কানিও এই প্রসঙ্গে সহমত পোষণ করেন। তিনি বলেছেন “দ্বিপাক্ষিক বিরোধের জন্য বহুপাক্ষিক ফোরাম” ব্যবহার করার বিষয়ে ভারতের ‘সতর্ক’ হওয়া উচিত।
তিনি জানিয়েছেন, অতীতে বহুবার ভারতের বিরুদ্ধে এ ধরনের ফোরামে ভেটো প্রয়োগ করেছে চীন।
এই প্রসঙ্গে উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “ভারত অরুণাচল প্রদেশের জন্য এডিবির (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) কাছে ঋণ চেয়েছিল, কিন্তু চীন এই অঞ্চলে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধের কারণ দেখিয়ে তখন ভেটো প্রয়োগ করেছিল।”