Source : BBC NEWS
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশকে একটি কার্যকর গণতন্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশন বুধবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বেশকিছু প্রস্তাবনা দিয়েছে, যেখানে দেশটির সাংবিধানিক নাম ও রাষ্ট্রীয় মূলনীতিসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার সুপারিশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান সাংবিধানিক নামে থাকা ‘প্রজাতন্ত্র’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলো বাদ দিয়ে সেখানে ‘নাগরিকতন্ত্র’ ও ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নাম ব্যবহার করার সুপারিশ করেছে কমিশন।
“বাংলাদেশকে যেভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বলা হয়, তার মধ্যে আসলে যে প্রজাতন্ত্রের কথা হয়, সেটায় আমরা দ্বিমত পোষণ করেছি। আমরা বলেছি, বাংলাদেশের পরিচিত হওয়া উচিত ‘জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ’,” বুধবার সাংবাদিকদের বলেন কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
সংবিধানে ‘বাংলাদেশের জনগণকে জাতি হিসেবে বাঙালি’ উল্লেখ করে যে বিধানটি রাখা হয়েছে, সেটি বিলুপ্ত করে দেশটির নাগরিকদের ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সেই সঙ্গে প্রস্তাব করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পরিবর্তনের।
বর্তমান সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে বলা হয়েছে- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
এগুলোর পরিবর্তে নতুন মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র’র কথা সুপারিশ করা হয়েছে।
“১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের যে জনআকাঙ্ক্ষা, তার প্রতিফলন হিসেবে আমরা রাষ্ট্রের পাঁচটি মূলনীতি সুপারিশ করছি,” বলেন অধ্যাপক রীয়াজ।
বর্তমান এককক্ষ বিশিষ্ট সংসদকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। বাড়াতে বলা হয়েছে সংসদের আসন সংখ্যা।
এছাড়া সরকার ও জাতীয় সংসদের মেয়াদ এক বছর কমিয়ে চার বছর করার সুপারিশ করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতির মেয়াদ রাখতে বলা হয়েছে চার বছর। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন ইলেক্টোরাল কলেজ বা নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটের মাধ্যমে। একই ব্যক্তি দুবারের বেশি রাষ্ট্রপতি থাকতে পারবেন না বলে সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী পদে দুই বারের বেশি না থাকা, সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ন্যূনতম বয়স ২১ বছর করা এবং সংসদের বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার বানানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
একজন সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রী পদে থাকলে দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা হিসেবে থাকতে পারবেন না- এমন প্রস্তাব করেছে কমিশন।
একই সঙ্গে, সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোট পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সংবিধানের বিতর্কিত ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করার পরামর্শ দিয়েছে কমিশন।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ প্রস্তুত করতে গিয়ে প্রায় এক লাখ মানুষের মতামত নেওয়া হয়েছে বলে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। কমিশনের সদস্যদের পাশাপাশি ৩২ জন গবেষক এতে কাজ করেছেন।
“আমাদের লক্ষ্য ছিল সুস্পষ্ট- কার্যকর গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার সুনিশ্চিতকরণ এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা। সেদিক থেকে বিবেচনা করে আমরা সংবিধানের যে ধারাগুলোর, যে বিষয়গুলোর সংস্কার করা দরকার সেগুলো আমরা বলেছি,” সাংবাদিকদের বলেন অধ্যাপক রীয়াজ।
প্রস্তাব বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন কমিশনের প্রধান।
“একটা ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্নের ধারাবাহিকতায় আজকে আসলে কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা এই প্রস্তাবগুলো, সুপারিশগুলো রাখছি। আমরা আশা করছি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এক ধরনের ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে,” বলেন অধ্যাপক রীয়াজ।
ক্ষমতার ভারসাম্য বিধান
দেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য বিধানে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ নামে একটি সাংবিধানিক সংস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে কমিশন।
তারা মনে করে, বর্তমান সংবিধানে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ‘একচ্ছত্র আধিপত্য ও ক্ষমতা’ দেওয়া হয়েছে, যা ‘স্বৈরতন্ত্রের পথ’ তৈরি করে দিয়েছে।
“সেই কারণে যাতে কোনো এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে না পারে, সেজন্য রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ এবং নির্বাহী বিভাগের দুটি পদ, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের বিষয় হিসাবে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নামে একটি সাংবিধানিক সংস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করেছি,” সাংবাদিকদের বলেন অধ্যাপক রীয়াজ।
রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা এবং সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারদের পাশাপাশি অন্যান্য দলের প্রতিনিধিত্বকারী একজনকে এই কাউন্সিলে রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, সংসদ সদস্যরা যেন স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারেন, সেজন্য নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবে বলেও সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
“আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় সংসদে অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হওয়া দরকার, সে ব্যবস্থা করা দরকার। সে কারণে ৭০ অনুচ্ছেদ দ্বারা যাতে প্রধানমন্ত্রী কেবলমাত্র সুরক্ষিত না হন, সেজন্য আমরা তার কিছু সংস্কারের প্রস্তাব করেছি,” বলেন সংস্কার কমিশনের প্রধান।
তবে অর্থবিলের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা বিরোধিতা করতে পারবেন না বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
দুই কক্ষের সংসদ, বাড়ছে আসন
বর্তমান এক কক্ষ বিশিষ্ট সংসদকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। বাড়াতে বলা হয়েছে সংসদের আসন সংখ্যা।
এক্ষেত্রে সংসদের নিম্নকক্ষে চারশো আসন রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। তবে সংরক্ষিত হলেও আসনগুলোতে নারী প্রতিনিধিরা আসবেন প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে।
অন্যদিকে, সংসদের উচ্চকক্ষে আসন রাখার কথা বলা হয়েছে ১০৫টি। এক্ষেত্রে উচ্চকক্ষের সদস্য নির্ধারত হবে আনুপাতিক পদ্ধতিতে।
অর্থাৎ সাধারণ নির্বাচনে একটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের হার অনুযায়ী তারা উচ্চকক্ষে আসন পাবে।
“দু’কক্ষ মিলে যাতে সকলের প্রতিনিধিত্ব থাকে, তার জন্য একইসঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নিম্নকক্ষ, কিন্তু সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে উচ্চকক্ষ তৈরি করার জন্য সুপারিশ করেছি,” সাংবাদিকদের বলেন কমিশনের প্রধান অধ্যাপক রীয়াজ।
এরপর কী?
সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়াও বুধবার আরও তিনটি কমিশন তাদের সংস্কার প্রস্তাবনা জমা দিয়েছে সরকারের কাছে।
সেগুলো হলো: নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন।
রাষ্ট্র সংস্কারে তারা যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে সরকার।
“রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হবে,” বুধবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হতে পারে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
“এই রিপোর্ট নিয়ে সংস্কার কমিশন বসবে। এখান থেকে পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে, সেটি চূড়ান্ত করা হবে,” বলেছেন পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
এক্ষেত্রে কবে, কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা হবে, আলোচনার মাধ্যমে সেটিরও একটি রূপরেখাও তৈরি করা হতে পারে বলে জানা যাচ্ছে।
কমিশনগুলোর সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ শেষ করতে ২০২৬ সালের জুন মাস লেগে যেতে পারে পারে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা মি. নজরুল।
উল্লেখ্য যে, গণআন্দোলনের মুখে গত অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের দুই ধাপে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার।
সেগুলো হলো: সংবিধান, বিচার, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার, শ্রম, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম ও নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন।
বুধবার চারটি কমিশনের প্রতিবেদন জমা পড়েছে। আগামী ৩১শে জানুয়ারি বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
অন্য ছয়টি কমিশন আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দিবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।