Source : BBC NEWS
পাঁচই অগাস্টের পর থেকেই নানা বিষয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিতে দেখা গেছে দীর্ঘদিনের দুই রাজনৈতিক মিত্র বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল – বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের।
সবশেষ বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের উদ্যোগে আয়োজিত এক সমাবেশে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
এর আগে গত ডিসেম্বরের শেষদিকে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের “পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক শক্তি” বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে মি. আহমদ বলেন, “জামায়াতে ইসলামীর এই বক্তব্যে আমি অবাক হয়েছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম এখন একটা সুযোগ এসেছে। এই সুযোগে বোধহয় তারা একাত্তরের ভূমিকার জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে।”
“সেটি না করে, তারা একাত্তরের তাদের ভূমিকাকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছে এবং এখন দেশপ্রেমিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে,” বলেন তিনি।
তবে বিভিন্ন সময়ে দলটির ভূমিকা নিয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের এ ধরনের প্রশ্ন তোলার বিষয়টি “নতুন নয়” বলেই মত জামায়াতের।
দলটির আমিরের কথাকে ভিন্নভাবে “চিত্রায়িত করা এবং এটাকে কেন্দ্র করে বক্তব্য দেয়া ঠিক নয়” বলেও মন্তব্য করেন দলটির মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ।
“দেশপ্রেম নিয়ে ডা. শফিকুর রহমান সাহেব তার দলের অবস্থান তুলে ধরেছেন। তিনি জামায়াতে ইসলামীকে একটা দেশপ্রেমিক দল বলেছেন। তার মানে এই নয় যে আর কোনো দলের মধ্যে দেশপ্রেম নেই,” বলছিলেন তিনি।
একইসঙ্গে “জামায়াতে ইসলামী এই জাতীয় বক্তব্যকে আমলে নেয় না” উল্লেখ করে দেশের জনগণ দলটির ভূমিকা সম্পর্কে জেনেই তাদের “সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এবং অব্যাহতভাবে জামায়াতের সমর্থন বৃদ্ধি পাচ্ছে” বলে মন্তব্য করেন মি. আকন্দ।
কেবল এবারই নয়, বিগত সরকারের পতনের পর থেকেই কখনো নির্বাচন, কখনো আওয়ামী লীগ বা ভারতসহ নানা ইস্যুতে দীর্ঘদিনের দুই জোটসঙ্গীর নেতৃস্থানীয়দের ইঙ্গিতপূর্ণ বাক্যবিনিময়ে জড়াতে দেখা গেছে।
বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, রাজনৈতিক সমীকরণের কারণেই এক সময়কার বন্ধুত্ব এখন দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে রূপ নিচ্ছে।
তার ওপর বাংলাদেশের রাজনীতিতে বরাবরই যে মেরুকরণ দেখা গেছে, সেখানে আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় সেই জায়গা দখলও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।
পাল্টাপাল্টি বক্তব্য নিয়ে কী বলেছেন নেতারা
গত ২৯শে ডিসেম্বর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “পাঁচই অগাস্টের পর কি আমরা ব্যাংক আত্মসাৎ করতে দেখিনি? আমরাতো দেখেছি ইসলামী ব্যাংক কীভাবে গ্রাস করে নিলো একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা।”
“তাহলে কোন মুখে বলছেন এক চাঁদাবাজ পালিয়েছে, আরেক চাঁদাবাজকে কেউ দেখতে চায় না। কাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন? আমরা কি বুঝতে পারি না? কারা পায়ের রগ কাটে তাদেরকে জনগণ ঠিকই জানে, চেনে,” বলেন তিনি।
এর দুইদিন আগে ২৭শে ডিসেম্বর দলটির কর্মী সম্মেলনে “একজন চাঁদাবাজ পালিয়েছে, আরেকজন চাঁদাবাজিতে লেগে গেছে” বলে মন্তব্য করেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।
মি. রিজভীর বক্তব্যের পর একইদিন নীলফামারীতে এক পথসভায় মি. রহমান বলেন, “পাঁচ তারিখের পর একদল অস্ত্র হাতে নিয়ে সেই ব্যাংক দখল করতে গেলো। বোঝা গেলো, ডাকাতের বেশে নতুন ডাকাত গেছে ব্যাংক দখল করতে।”
“কেউ কেউ বললেন, ব্যাংক ওমুক-তমুক দল দখল করেছে। ব্যাংক কেউ দখল করেনি। ব্যাংক তার মায়ের কোলে ফিরে আসবে,” বলেন তিনি।
এছাড়াও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অফিসিয়াল ফেসবুকে পোস্ট দেয় জামায়াতে ইসলামী। একইভাবে ফটোকার্ড বানিয়ে পোস্টটির জবাবও দেয় বিএনপি।
এর আগে, আওয়ামী লীগ, ভারত ও নির্বাচন ইস্যুতেও দল দুটির নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। তাহলে কি এক সময়কার জোটসঙ্গী বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে?
এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিএনপি-জামায়াত বরাবরই আলাদা দল ছিল।
“আওয়ামী লীগ একটা ন্যারেটিভ দাঁড় করিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত। কিন্তু বিএনপি-জামায়াততো এক না। বিএনপির তার পলিটিক্স আছে, জামায়াতের তার পলিটিক্স আছে। ন্যাচারালি আমাদের মধ্য দূরত্ব থাকবে,” বলেন মি. টুকু।
একইসঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতের ভিন্ন অবস্থানে থাকার বিষয়টি টেনে তিনি বলেন, “আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশ্বাস করি, জামায়াত স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। মূল তো আছেই এই জায়গাটাতে”।
তবে দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক দূরত্ব বাড়া কিংবা ‘পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের’ বিষয়টি মানতে নারাজ জামায়াতে ইসলামী। একইসঙ্গে এ ধরনের বক্তব্যকে নেতাদের নিজস্ব মন্তব্য উল্লেখ করে তা দুই দলের সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলেও মনে করে জামায়াত।
দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “দলগত কোনো সম্পর্কের দূরত্ব তৈরি বা আমাদের মধ্যে কোনো গ্যাপ তৈরি হচ্ছে এমন না। এটা দল ভার্সাস দল এভাবে আমরা দেখি না। গণতান্ত্রিক দেশে মানুষের মত প্রকাশের অধিকার আছে।”
একইসঙ্গে “কোনো নেতা যদি বক্তব্য রাখেন, সেটা দলের অপিনিয়ন (মতামত) না ব্যক্তির নিজের বক্তব্য এটা জনগণ ডিসাইড করবে” বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
‘রাজনীতিতে এই কাদা ছোড়াছুড়ি ডালভাত’
গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় বদলে গেছে রাজনৈতিক সমীকরণ। আগামী নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে টক্কর দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী।
রাজনীতিতে “পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী” হয়ে ওঠা দুই দলের এমন মুখোমুখি অবস্থানকে অবশ্য স্বাভাবিক বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
“যখন আওয়ামী লীগ মাঠে ছিল, তখন আওয়ামী লীগ ছিল তাদের উভয়ের প্রধান শত্রু। শত্রুর প্রধান শত্রুর বিরুদ্ধে তাদের মধ্যে ঐক্য হয়েছিল,” বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ।
ফলে আসন্ন নির্বাচনি লড়াইকে মাথায় রেখেই দুই দল “বিষোদগার” করছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, “আমাদের দেশের রাষ্ট্রক্ষমতাকেন্দ্রিক যে রাজনীতি, সেই রাজনীতিতে এই কাদা ছোড়াছুড়ি একেবারে ডালভাত”।
অনেকটা একই কথা বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা। তার মতে, “রাজনীতির খেলায় সবই সমীকরণ। এতদিন যে সমীকরণের কারণে জামায়াত বিএনপি সাথে ছিল, সেই একই সমীকরণের কারণে তারা এখন একসাথে থাকতে পারবে না। আর নতুন সমীকরণ তারা করবে এটাই স্বাভাবিক।”
এর সঙ্গে রাজনীতির মাঠে এককভাবে জামায়াতের নিজের জায়গা দখলেরও একটি বিষয় আছে বলেও মনে করছেন অনেকে। বলছেন, আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় দলটির ভোটব্যাংক জামায়াতের দখল চলে যেতে পারে, আর এ নিয়ে শঙ্কা আছে বিএনপির।
“জামায়াততো কিছুটা জায়গা করে নিয়েছে বিএনপির প্রশ্রয় পেয়েই। এখন যেহেতু জায়গা হয়েছে, জায়গাটা সে আরও বড় করতে চায়,” বলেন মি. আহমদ।
তিনি বলেন, “যেহেতু আওয়ামী লীগ কোণঠাসা অবস্থায় আছে, তাদেরতো প্রচুর ভোটার আছে। আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেকে আছেন যারা কখনোই বিএনপির সঙ্গে রিকন্সাইল (সমঝোতা) করবে না। তাদের দিকেও দৃষ্টি দিয়েছে জামায়াত যেন ওই ভোটগুলো পায়।”
আর একারণেই বিএনপি চাইছে আওয়ামী লীগ যেন মাঠে থাকে, যাতে করে জামায়াত সেই ভোটগুলো না পায়। সবাই এই “হিসাবনিকাশ” করছে বলেই মত এই বিশ্লেষকের।
বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের মুখোমুখি অবস্থানকে দলটির রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুম।
“জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল এবং আমার মনে হয়েছে এটা একটা রাজনৈতিক কৌশল। যেভাবে তারা প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে বিরাজ করছে বা প্রতিটি কন্সটিটিউন্সিতে তারা যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলছে, সেটা আসলে রাজনৈতিক কৌশল বা ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা বা তাদের রাজনীতিকে পরিচিত করার একটা কৌশল হতে পারে,” বলছিলেন মি. মাসুম।
তবে রাজনীতির নতুন সমীকরণের কারণে দুই যুগেরও বেশি সময়ের বন্ধুত্বে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সহসাই তা থামবে না বলেই মত বিশ্লেষকদের।
বরং “নির্বাচনের গন্ধটা যত বেশি বেশি করে লাগবে, ততই বিএনপি-জামায়াতের এই দ্বন্দ্বটা আরও প্রকট হয়ে দেখা দেবে” বলেই মনে করছেন মহিউদ্দিন আহমদ।