Source : BBC NEWS
দিনটি ছিল ২০শে সেপ্টেম্বর, ১৯২৪ সাল। যুক্তরাজ্যের সাময়িক পত্রিকা ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ’ সেদিন প্রথম পাতায় বিরাট করে এক আবিষ্কারের খবর ছাপে। লেখা হয়, গ্রিসের ‘টিরিনস্’ ও ‘মাইসিনে’র মতো প্রাচীন শহর খুঁজে পাওয়া গেছে ভারতে।
সেটা ছিল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগেকার দুই গুরুত্বপূর্ণ শহর মহেঞ্জোদারো আর হরপ্পা আবিষ্কারের কাহিনী।
সারা বিশ্বে হৈহৈ পড়ে গেল সেই খবরে।
তার আগে পর্যন্ত কারও ধারণা ছিল না যে ভারতেও থাকতে পারে হাজার হাজার বছরের পুরনো কোনও সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ।
প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের তৎকালীন প্রধান, প্রখ্যাত প্রত্নত্ত্ববিদ স্যার জন মার্শাল। খবরের সঙ্গে ছাপা হয়েছিল প্রচুর ছবি, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ।
তবে মি. মার্শাল তার প্রতিবেদনে এটা উল্লেখ করেননি যে সিন্ধু সভ্যতার ওই দুই প্রাচীন শহর আবিষ্কারের কৃতিত্ব আসলে ছিল দুই ভারতীয় পুরাতত্ত্ববিদের।
তাদের একজন আবার বাঙালি – নাম রাখালদাস ব্যানার্জী।
তিনি ছিলেন পুরাতত্ত্ব বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মী এবং প্রশিক্ষিত প্রত্নতত্ত্ববিদ, যিনি মহেঞ্জোদারো খুঁজে পেয়েছিলেন। অন্যজন, দয়ারাম সাহানি, আবিষ্কার করেছিলেন হরপ্পা।
রাখালদাসের কৃতিত্ব অজানা ছিল বিশ্বের কাছে
ভারতীয়রা স্কুলের ইতিহাস বইয়ে পড়ার সুবাদে ছোট থেকেই জানে যে রাখালদাস ব্যানার্জীই খুঁজে পেয়েছিলেন মহেঞ্জোদারো। তবে বিশ্ব সেই নামটি জানতো না অনেক বছর। রাখালদাস ব্যানার্জী তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জন মার্শালকে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের যে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন, সেটাও প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল।
সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের খবর প্রকাশিত হওয়ার একশো বছর পর মহেঞ্জোদারো নিয়ে রাখালদাস ব্যানার্জীর জমা দেওয়া মূল সরকারি রিপোর্টটি পুনর্গঠন করা হয়েছে সম্প্রতি।
“জন মার্শালকে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার নিয়ে রাখালদাস ব্যানার্জী যে মূল রিপোর্টটি পাঠিয়েছিলেন, তার একটি কপি বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির এক অধ্যাপক হাতে পান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ওই রিপোর্টের গুরুত্ব। সেটির ছবি তুলে রেখেছিলেন সেই অধ্যাপক। আমি সেগুলো যোগাড় করি। মূল রিপোর্টের সঙ্গে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের যেসব ছবি ছিল, তার কিছুটা নানা জায়গা থেকে খুঁজে পাই। আবার যেসব ছবি পাইনি, সেগুলি পাকিস্তানের মহেঞ্জোদারো থেকে আমার সূত্রের মাধ্যমে ছবি তুলে আনিয়েছি।
“এই সব মিলিয়েই গোটা রিপোর্টটি পুনর্গঠন করতে পেরেছি। মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের শতবর্ষে বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস ব্যানার্জীর প্রতি আমার এটা কর্তব্য ছিল,” বলছিলেন দীপান ভট্টাচার্য।
মি. ভট্টাচার্য একজন প্রত্নতত্ত্ব গবেষক। তিনি সিন্ধু সভ্যতাসহ নানা প্রাচীন ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন।
‘মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার ছিল একটা দুর্ঘটনা’
“প্রাগৈতিহাসিক স্থল হিসাবে আমার মহেঞ্জোদারো খুঁজে পাওয়াটা একটা দুর্ঘটনা। সেটা ছিল ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাস। আশপাশে বেরিয়েছিলাম চিতল হরিণ শিকার করতে। কিন্তু পথ হারিয়ে ফেলে ওই জায়গায় পৌঁছে যাই। সেখানে একটা চাঁছুনি (যা দিয়ে মাটি ইত্যাদি চেঁছে তোলা হয়) খুঁজে পাই, যেটা আসলে একটা নিউমিলিটিক ফ্লিন্ট (এক ধরণের জীবাশ্ম)। একই রকম জিনিষ পাশের জেলা সুক্কুরের রোহরি থেকেও কয়েক বছর আগে খুঁজে পেয়েছিলেন ব্র্যাডফোর্ড। সেগুলি এখন কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে রাখা আছে, ” লিখেছিলেন রাখালদাস ব্যানার্জী।
‘ক্যালকাটা মিউনিসিপাল গেজেট’এর সাতই নভেম্বর, ১৯২৮ সালের যে মূল সংস্করণটি কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে, সেখানে এভাবেই নিজের প্রত্নতাত্ত্বিক কর্মজীবন তথা ভারতের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এক আবিষ্কার নিয়ে লিখেছিলেন রাখালদাস ব্যানার্জী।
প্রথমবার মহেঞ্জোদারো যাত্রার কিছুদিন আগেই ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগের পশ্চিমাঞ্চলের কর্তা হিসাবে পুনেতে যোগ দিয়েছেন। তার বন্ধু ও প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. সুনীতি কুমার চ্যাটার্জী তার ‘দ্রাভিডিয়ান অরিজিনস অ্যান্ড দ্য বিগিনিংস অফ ইন্ডিয়ান সিভিলাইজেশন’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন যে রাখালদাস ব্যানার্জী সিন্ধু নদের অববাহিকা অঞ্চলে আদতে গিয়েছিলেন আলেকজান্ডারের স্থাপন করে যাওয়া বিজয়স্তম্ভ ও শিলালিপির খোঁজে।
মহেঞ্জোদারো থেকে পুনেতে ফিরে এসে তিনি জানতে পারলেন যে তার আগে যিনি পশ্চিমাঞ্চলের কর্তা ছিলেন, সেই ড. আর ভাণ্ডারকর নাকি ১৯১২ সালেই ওই অঞ্চল পরিদর্শন করে এসে রিপোর্ট দিয়েছিলেন, ওই ধ্বংসাবশেষটি মাত্র শ’ দুয়েক বছরের পুরনো।
তবে হাল ছাড়েন নি রাখালদাস ব্যানার্জী। সেই ১৯১৭ সালের পরে বার বার তিনি ফিরে গিয়েছিলেন ওই অঞ্চলে। সিন্ধু নদের অববাহিকার দুই তীরেই খুঁজে বেরিয়েছেন প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ।
“অবশেষে আমি যখন নিশ্চিত হলাম যে মহেঞ্জোদারোই ভারতের অন্যতম প্রাচীন প্রত্নক্ষেত্র, প্রাচীনতমও হতে পারে, তখন, ১৯২২ সালে আমি সেখানে খনন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিই,” লিখেছেন মি. ব্যানার্জী।
বৌদ্ধ স্তূপের নিচে লুকানো প্রাচীন সভ্যতা
গবেষক দীপান ভট্টাচার্য বলছিলেন, “খননের আগে মহেঞ্জোদারোতে ভূপৃষ্ঠের ওপরে যেটা দেখা যেত তা হলো কুশান যুগের একটি বৌদ্ধ স্তূপ। সেটা সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের উপরেই গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই স্তূপের নিচে যে লুকিয়ে ছিল এক অতি প্রাচীন অথচ আধুনিক শহর, তা জানা যায় আরও একটি দুর্ঘটনার মাধ্যমে। সাময়িক মাসিক বসুমতী পত্রিকায় মি. ব্যানার্জী লিখেছিলেন:
“১৯২১ খ্রিস্টাব্দে লারকানা জিলার পশ্চিমাংশ গৈচিডেরো নামক স্থান পরিদর্শনকালে দেখিতে পাওয়া গেল যে, একটি বড়ো বাড়ি ভাঙ্গিয়া অনেকগুলি বড়ো বড়ো মাটির জালা বাহির হইয়া পড়িয়াছে। তাহার মধ্যে একটি জালার ভিতরে হাত দিতেই আমার একটি আঙ্গুল কাটিয়া গেল। সকলেই বলিল যে, উহার ভিতরে সাপ আছে এবং তোমাকে সাপে কামড়াইয়াছে। হাত বাঁধিয়া সাপ মারিবার জন্য জালা ভাঙ্গিয়া দেখা গেল যে, সাপের পরিবর্তে জালার ভিতরে ১০টি মাটির ভাঁড় তিন থাকে সাজানো আছে। উপরের থাকে একটি মাটির ভাঁড়ের মুখে একখানি ছোটো পাথরের ছুরি আছে, সে ছুরিতে লাগিয়া আমার আঙ্গুল কাটিয়া গিয়াছিল। প্রত্যেক মাটির ভাঁড়ের মধ্যে মানুষের দেহের একখানি অস্থি এবং সেই অস্থির চারিপার্শ্বে তিন বা চার থাকে খুব ছোটো ছোটো ভাঁড়ে ধান, যব, গুড়, তামাক, অলংকার, কাচের বাসন, কাচের পুঁতির মালা এবং পাথরের অস্ত্র সাজানো আছে। এই আবিষ্কার করিয়া বুঝিলাম, সিন্ধুদেশের দক্ষিণভাগে যে সমস্ত ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে, উত্তরভাগের ধ্বংসাবশেষগুলি সে জাতীয় নহে।”
প্রথমে রাখালদাস ব্যানার্জী নিজে আর তারপরে আরেক প্রত্নতত্ত্ববিদ মাধো স্বরূপ ভৎস সেখানে খননকার্য চালান। অবশেষে, ১৯২৪ সালের জুন মাসে পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান “স্যার জন মার্শালকে আমি আবিষ্কারের বিষয়টা জানাই,” লিখেছেন মি. ব্যানার্জী।
প্রচুর ছবিসহ সেই তথ্য মি. মার্শাল প্রকাশ করে দিয়েছিলেন ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ’ এর প্রথম পাতায়। সেখানে রাখালদাস ব্যানার্জী, বা কয়েক বছর আগে হরপ্পার আবিষ্কর্তা দয়ারাম সাহানির নাম ছিল না কোথাও।
জীবদ্দশায় মেলেনি ‘সরকারি’ স্বীকৃতি
রাখালদাস ব্যানার্জীর ভাষ্যমতে জন মার্শাল ১৯২৪ সালের মে মাসের আগে মহেঞ্জোদারোর ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। ওই পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হওয়ারও বেশ কয়েক মাস পরে, ১৯২৫ সালের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে জন মার্শাল প্রথম মহেঞ্জোদারোতে গিয়েছিলেন বলে লিখেছেন রাখালদাস ব্যানার্জী।
গবেষক দীপান ভট্টাচার্য বলছেন, “এর অর্থ হলো লন্ডনের পত্রিকায় যেসব তথ্য ও ছবি ছাপা হয়েছিল জন মার্শালের নামে, সেগুলো আসলে রাখালদাস ব্যানার্জী এবং তার সহকর্মীদের তোলা। অথচ কোথাও তাদের কৃতিত্ব স্বীকার করা হলো না। জন মার্শাল নিজে একজন অত্যন্ত পণ্ডিত প্রত্নতত্ত্ববিদ। তার কাজের ব্যাপকতা বিশাল। তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও অবকাশই নেই। কিন্তু অন্য কারও আবিষ্কারের স্বীকৃতি না দেওয়াটাও তো ঠিক না।“
মি. ভট্টাচার্য আরও বলছিলেন যে লন্ডনের পত্রিকায় সেই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার বেশ কয়েক বছর পরে রাখালদাস ব্যানার্জীর মূল রিপোর্টে নানা অসঙ্গতি রয়েছে, বিস্তারিত তথ্য নেই – এসব কথা বলেন জন মার্শাল। জন মার্শালের পর যিনি পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান হয়েছিলেন, সেই হ্যারল্ড হারগ্রিভস মূল রিপোর্টটি রাখালদাসকে ফেরত পাঠান।
“মি. হারগ্রিভস চিঠিতে লিখলেন যে জন মার্শালই নাকি তাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন যাতে রিপোর্টটি রাখালদাসকে ফেরত পাঠানো হয়। যদি তিনি চান, সেটি প্রকাশ করতে পারেন, এমন কথাও লেখা হলো,” বলছিলেন দীপান ভট্টাচার্য।
প্রথম প্রতিবেদনে মি. ব্যানার্জী বা মি. সাহানির নাম উল্লেখ না থাকলেও জন মার্শাল ১৯৩১ সালে ‘মহেঞ্জোদারো অ্যান্ড দ্য ইণ্ডাস সিভিলাইজেশন’ নামে তিন খণ্ডের যে আকর গ্রন্থ প্রকাশ করেন, সেখানে অবশ্য দুজনের কাজের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তিনি।
তবে সেই বই প্রকাশের আগেই, মাত্র ৪৫ বছর বয়সে মারা গেছেন রাখালদাস ব্যানার্জী।
পুরাতত্ত্ব বিভাগ থেকে স্বেচ্ছাবসর নিতে একরকম বাধ্য হয়ে তখন তিনি বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপকের চাকরি করেন।
তার আবিষ্কারের স্বীকৃতি জীবদ্দশায় মেলেনি মি. ব্যানার্জীর।
রাখালদাসের রিপোর্ট ‘ভুলে ভরা’?
রাখালদাস ব্যানার্জীর মূল রিপোর্টটি কেন সামনে আনা হলো না অথবা লন্ডনের পত্রিকায় কেন মি. ব্যানার্জীকে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের স্বীকৃতি দেওয়া হলো না, তা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন ইতিহাসবিদ নয়নজ্যোত লাহিড়ী।
মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার নিয়ে তার লেখা বই ‘ফাইণ্ডিং ফরগটেন সিটিজ – হাউ দ্য ইণ্ডাস সিভিলাইজেশন ওয়াজ ডিসকভার্ড’-এ নয়নজ্যোত লাহিড়ী উদ্ধৃত করেছেন জন মার্শালের তার উত্তরসূরি হ্যারল্ড হারগ্রিভসকে ১৯২৯ সালে লেখা একটি চিঠি থেকে।
সেই চিঠিতে পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন প্রধান জন মার্শাল লিখেছিলেন যে মি. ব্যানার্জীর রিপোর্টটি পুঙ্খানুপুঙ্খ অধ্যয়ন করে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে সেই রিপোর্টে প্রচুর ভুল এবং অবান্তর তথ্য রয়েছে, যেগুলি তিনি নিজের লেখা মহেঞ্জোদারোর তিন খণ্ডের বইতে সামিল করতে পারবেন না।
“আমি মি. ব্যানার্জীকে যতটা চিনি, তাতে এটা অসম্ভব নয় যে মহেঞ্জোদারোর বইতে (তিন খণ্ডের) তার সংগ্রহ করা তথ্য তাকে স্বীকৃতি না দিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে – এরকম একটা অভিযোগ তিনি লেখকদের বিরুদ্ধে তুলতেই পারেন। তাই এটাই ভালো হবে যে আপনি যদি প্রতিলিপিটি (মূল রিপোর্টের) তার কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেন এবং তিনি যদি চান, তাহলে যেন আপনি সেটি প্রকাশ করার অনুমতি দেন। তবে আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করব যাতে মহেঞ্জোদারো নিয়ে তার কাজের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দেওয়া হয়,” মি. হারগ্রিভসকে লেখা চিঠিতে জানিয়েছিলেন জন মার্শাল।
এরপরে তিনি আরও লিখেছিলেন যে মহেঞ্জোদারো নিয়ে যে তিন খণ্ডের গ্রন্থ প্রকাশিত হতে চলেছে, তা প্রকাশের আগেই যেন রাখালদাস ব্যানার্জী নিজের প্রবন্ধটি প্রকাশ করেন, “যাতে পরবর্তীতে কোনও ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ না থাকে।”
যে সময়ে জন মার্শাল রাখালদাস ব্যানার্জীর মূল রিপোর্টটি ফেরত পাঠাচ্ছেন, ততদিনে কিন্তু মহেঞ্জোদারো নিয়ে তার লেখা তিন খণ্ডের বিশালাকার বইয়ের রচনা ও পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে গেছে – এটা ধরে নেওয়া যেতেই পারে। তিন খণ্ডের ওই আকর গ্রন্থের প্রকাশকাল ছিল ১৯৩১।
গবেষক দীপান ভট্টাচার্য বলেছেন, “জন মার্শালের ওই চিঠি এবং রাখালদাসের মূল রিপোর্টটি ফেরত পাঠানোর পিছনে যে বিষয়টি কাজ করেছে বলে মনে হয়, তা হলো লন্ডনের পত্রিকায় ১৯২৪ সালের প্রতিবেদনটি ছাপার পরেই ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক ও বিদ্বজ্জনের মধ্যে রাখালদাস ব্যানার্জীর কাজের স্বীকৃতি না পাওয়া নিয়ে একটা ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। নানা পত্র পত্রিকায় রাখালদাস নিজে এবং অন্যান্য পণ্ডিতরা কিন্তু সমানে প্রবন্ধ লিখে চলেছিলেন যে আসলে কীভাবে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কৃত হয়েছিল, কে ছিলেন আবিষ্কর্তা, ইত্যাদি। তাই জন মার্শাল তিন খণ্ডের যে আকর গ্রন্থ প্রকাশ করতে চলেছেন বছরখানেকের মধ্যেই, তা যাতে বিতর্কের মুখে না পড়ে, সে জন্য একরকম বাধ্য হয়েছিলেন রাখালদাসের কাজকে স্বীকৃতি দিতে।
“একটা বিষয় খেয়াল করার মতো – মূল রিপোর্টটি জন মার্শাল ফেরত পাঠালেন ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে রাখালদাস ও তার সহকর্মীদের তোলা যে অজস্র ছবি তার কাছে ছিল, সেগুলো কিন্তু আর ফেরত দেওয়া হয় নি। মূল রিপোর্টের যে প্রতিলিপি মি. হারগ্রিভস পাঠালেন রাখালদাসের কাছে, সেখানে এই ছবিগুলি সংযুক্ত করতে না পারার জন্য দু:খও প্রকাশ করা হয়েছিল,” বলছিলেন মি. ভট্টাচার্য।
“তবে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের নিজের মূল রিপোর্ট ফেরত আসার পর রাখালদাস আর সেটি দেখতে পেয়েছিলেন কী না আমার সন্দেহ আছে কারণ রিপোর্টটি ফেরত আসার কয়েক মাসের মধ্যেই মারা যান রাখালদাস ব্যানার্জী,” বলছিলেন দীপান ভট্টাচার্য।
রাখালদাসের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ
জন মার্শাল ও রাখালদাস ব্যানার্জীর মধ্যে মনোমালিন্য, মতবিরোধের শুরু অবশ্য মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার নিয়ে বিতর্কের অনেক আগে, সেই ১৯১২ সাল থেকে।
তখন রাখালদাস ব্যানার্জী কাজ করতেন কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে, আর ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এসে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের মহাপরিচালকের দায়িত্ব নিলেন জন মার্শাল। পদাধিকারবলে ভারতীয় জাদুঘরের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগটি মি. মার্শালেরই তত্ত্বাবধানে ছিল।
ইতিহাসবিদ নয়নজ্যোত লাহিড়ী তার আকরগ্রন্থ ‘ফাইণ্ডিং ফরগটেন সিটিজ – হাউ দ্য ইণ্ডাস সিভিলাইজেশন ওয়াজ ডিসকভার্ড’-এ এমন অনেক তথ্য দিয়েছেন, যা থেকে বোঝা যায় মি. মার্শাল ও মি. ব্যানার্জীর মধ্যে কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক মতানৈক্য ছিল।
বিভিন্ন সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ করার জন্য যে ‘দাম’ দিতে চাইতেন মি. ব্যানার্জী, তা নিয়ে মি. মার্শাল আপত্তি তুলতেন, কারণ কোন প্রত্ন-নিদর্শনের দাম কী হওয়া উচিত, হাতে-কলমে কাজ করার সুবাদে তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা ছিল মহাপরিচালকের।
নয়নজ্যোত লাহিড়ীর বইতেই পাওয়া যায় যে প্রত্ন-নিদর্শন সংগ্রহের জন্য ‘দাম’ ঠিক করার আগে মি. মার্শালের অনুমোদন নেওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়।
তবে রাখালদাস ব্যানার্জী যে একাধিকবার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের সেইসব নির্দেশনা ভঙ্গ করেছেন, সে কথাও উল্লেখ করেছেন নয়নজ্যোত লাহিড়ী।
এরপরে গভর্নমেন্ট এপিগ্রাফিস্ট বা সরকারি শিলালিপি-বিশারদের চাকরির জন্য যখন রাখালদাস ব্যানার্জী আবেদন করলেন, তাতে কিছুটা বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন জন মার্শাল। তাই সেই চাকরিটা পান নি মি. ব্যানার্জী।
পুরাতত্ত্ব বিভাগের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রধান হিসাবে রাখালদাস ব্যানার্জী যখন পুনেতে দায়িত্ব নিলেন, সেখানেও নানা সমস্যা শুরু হলো তাকে নিয়ে। কখনও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ অমান্য করা, আবার কখনও আর্থিক অনিয়মের গুরুতর অভিযোগ উঠতে লাগল তার বিরুদ্ধে।
আবার বর্তমান মধ্যপ্রদেশের জবলপুর শহরের কাছের এক মন্দির থেকে প্রাচীন একটি মূর্তি ‘হারিয়ে যাওয়ার’ ঘটনাতেও রাখালদাস ব্যানার্জীর দিকে অভিযোগের আঙুল উঠেছিল। মূর্তিটি যখন হারিয়ে যায়, সেই সময়ে মি. ব্যানার্জী তার সহকর্মীদের নিয়ে কাছাকাছি শিবির গেঁড়ে ছিলেন। পরে অবশ্য তিনিই মূর্তিটি পুনরুদ্ধার করে নিয়ে আসেন।
ভারতের জাতীয় আর্কাইভসে সংরক্ষিত একটি পুরনো ফাইল খুঁজে বের করে ইতিহাসবিদ নয়নজ্যোত লাহিড়ী লিখেছেন, “ফাইলটির বিষয় খুব স্পষ্ট : ‘মি. আরডি ব্যানার্জীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’।
ওই ফাইলে ব্যানার্জী সংক্রান্ত চিঠি ও বিভিন্ন নির্দেশ সংকলিত রয়েছে – কিছু তার নিজের লেখা, কিছু তাকে উদ্দেশ্য করে লেখা, আরও কিছু তার ব্যাপারে অন্যদের লেখা। পশ্চিম সার্কেল (পুরাতত্ত্ব বিভাগের) কী ঘটেছিল, তার একটা ধারণা পাওয়া যায় ওইসব নথি থেকে।
“বোম্বে সরকারকে ১৯২১-২২ সালের শীতকালটা জুড়ে ব্যানার্জীর সৃষ্টি করা সমস্যাগুলো সামলাতে হয়েছিল। তারা তখন অনুধাবন করতে পেরেছিল যে তারা একজন দক্ষ অফিসারের আর্থিক নয়ছয়ের মুখোমুখি হয়েছে – যার ব্যাখ্যা তিনি যেমন দিতে পারছেন না, আবার সমাধানও করতে পারছেন না,” লিখেছেন নয়নজ্যোত লাহিড়ী।
মহেঞ্জোদারোতে শেষবার ফেরা
এই পরিস্থিতিতে রাখালদাস ব্যানার্জী পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান জন মার্শালকে গোপন চিঠি পাঠিয়ে বদলি চাইলেন কলকাতায়।
কিছুদিন পরে ‘বোম্বে’ সরকারকে রাজি করিয়ে মি. ব্যানার্জীকে কলকাতায় বদলির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন জন মার্শাল।
পশ্চিমাঞ্চল থেকে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় চলে আসার আগেই রাখালদাস ব্যানার্জী যখন ফিরে গিয়েছিলেন মহেঞ্জোদারোতে, সেটা ছিল ১৯২২ সাল।
তখনই প্রাচীন প্রত্নস্থলটির খনন কাজ শুরু করেন তিনি।
কুষান যুগের বৌদ্ধ স্তূপের নিচ থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে থাকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পুরনো এক আধুনিক শহরের চেহারা।
রাখালদাস ব্যানার্জীর জীবদ্দশায় সেই আবিষ্কারের স্বীকৃতি না পেলেও এখন মহেঞ্জোদারো পেয়েছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের মর্যাদা।
পাকিস্তান সরকার সেখানে যে বোর্ড লাগিয়েছে, তাতে অবশ্য জ্বলজ্বল করছে বাঙালি পুরাতাত্ত্বিক রাখালদাস ব্যানার্জীর নাম।