Source : BBC NEWS

আপাতত আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে পপকর্ন-প্রতীকী ছবি।

ছবির উৎস, Getty Images

ভারতে সাত বছর আগে চালু হয়েছিল ‘গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স’ (জিএসটি) বা পণ্য ও পরিষেবা কর। কিন্তু এই বিষয় নিয়ে মানুষের মধ্যে এখনও নানান ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে, বিতর্কও রয়েছে।

একই পণ্যের জন্য বিভিন্ন ট্যাক্স স্ল্যাবের কারণে এই সিস্টেমটা বেশ জটিল হয়ে উঠেছে আর এটাই জিএসটি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অভিযোগের অন্যতম কারণ। এই মুহূর্তে আরও একবার বিতর্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জিএসটি। এবার আলোচনার কেন্দ্রে থাকা পণ্যের মধ্যে একটা হলো পপকর্ন কারণ, তিনটে ভিন্ন ফ্লেভারের পপকর্নের উপর কর আলাদা।

সম্প্রতি জিএসটি কাউন্সিলের ৫৫তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই বৈঠকে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের সভাপতিত্বে কর সরলীকরণ নিয়ে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছিল। কিন্তু আরও একবার বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে জিএসটি।

এই তালিকায় থাকা পণ্যের মধ্যে যে দুটো পণ্যের উপর কর ধার্য করা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে তা হলো-পপকর্ন এবং পুরানো গাড়ির কেনা বেচার উপর আরোপিত জিএসটি। এই বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচনা হচ্ছে। বহু মানুষ পোস্টও শেয়ার করেছেন।

তারপর সরকারের তরফ থেকে বিষয়টাকে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে কেন পপকর্নের উপর তিন ধরনের ভিন্ন ভিন্ন কর বসবে।

আরও পড়তে পারেন
নোনতা পপকর্নের চেয়ে মিষ্টিযুক্ত পপকর্নের উপর কর বেশি- প্রতীকী ছবি।

ছবির উৎস, Getty Images

ভিন্ন ফ্লেভারের পপকর্নে উপর ভিন্ন কর

জিএসটি কাউন্সিলের তরফে জানানো হয়েছে, ‘রেডি টু ইট’ পপকর্ন নুন ও মশলা দিয়ে আগে থেকে প্যাকেটজাত করে লেবেল ছাড়া বিক্রি করলে তার উপর জিএসটি বসবে পাঁচ শতাংশ। কিন্তু সেই একই পপকর্ন যদি লেবেল সমেত বিক্রি করা হয়, তাহলে ১২ শতাংশ জিএসটি দিতে হবে।

আবার পপকর্ন যদি মিষ্টিযুক্ত হয় তাহলে তার উপর ১৮ শতাংশ জিএসটি বসবে। কারণ সেক্ষেত্রে পপকর্নের শ্রেণি বদলে ‘ক্যারামেল পপকর্ন’ হয়ে যাবে। সেই জন্য ভিন্ন ভিন্ন জিএসটি।

এই প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেন, “আমরা প্রত্যেক জিএসটি কাউন্সিলের পর সাংবাদিক সম্মেলন করি। কর এমন একটা বিষয় যার অনেকগুলো স্তর রয়েছে। অন্ধভাবে কোনও কর আরোপ করা হয় না এবং অন্ধভাবে কর সরানোও হয় না। দয়া করে পুরো বিষয়টি বুঝে আপনার মিডিয়ায় প্রচার করুন।”

অর্থমন্ত্রী পপকর্ন তিনটে ভিন্নভাবে বিক্রির তথ্য দেন এবং তার উপর আরোপ করা করের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন।

অর্থমন্ত্রী নির্মলা  সীতারামনের সভাপতিত্বে জিএসটি কাউন্সিলের ৫৫ তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

ছবির উৎস, ANI

এর আগে, জয়সলমীরে অনুষ্ঠিত জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠকে স্বাদ এবং প্যাকেজিংয়ের ভিত্তিতে পপকর্নে করের নতুন হার নির্ধারণ করা হয়েছিল এবং তা নিয়ে ক্রমাগত বিতর্কও চলছিল।

তারপর থেকেই এই বিষয় নিয়ে নানান রকম কথা হচ্ছিল। কেউ কেউ সিনেমা হলে বিক্রি হওয়া পপকর্ন এবং রাস্তায় বিক্রি হওয়া পপকর্নের তুলনাও করছিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই নিয়ে বেশ বিতর্কের সৃষ্টি হয় এবং তারপরই সরকার এই বিষয় নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে।

কর বিশেষজ্ঞ ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বিকাশ বলেছেন, “এখন সিনেমা হলে নুন মেশানো পপকর্ন খেতে হলে পাঁচ শতাংশ কর দিতে হবে, আর ট্রেনে চিনি মিশ্রিত পপকর্ন কিনলে ১৮ শতাংশ কর দিতে হবে।”

বিকাশ জানিয়েছেন, জিএসটি কাউন্সিলের প্রস্তাবের পর শীঘ্রই নতুন হার সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তিও জারি করা হবে।

ভারতে বিপুল সংখ্যক মানুষ শখ পূরণ করতে পুরানো গাড়ি কেনেন- প্রতীকী ছবি।

ছবির উৎস, Getty Images

পুরনো গাড়ি কেনা বেচায় জিএসটি

পপকর্নের পাশাপাশি আরও একটা পণ্যের উপর জিএসটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে এবং সেটা হলো পুরানো গাড়ির কেনা বেচার উপর ধার্য কর।

জিএসটি কাউন্সিলের ৫৫তম বৈঠকে পুরনো গাড়ির উপর জিএসটি ১২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৮ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পুরনো গাড়ি যে মার্জিনে কেনাবেচা হবে, সেই মার্জিনে এই করের হার প্রযোজ্য হবে।

আগে ছিল ১২০০ সিসি ও ৪ হাজার মিলিমিটার দীর্ঘ পুরনো গাড়ির কেনাবেচায় ১২ শতাংশ জিএসটি ছিল। সেই কর এখন বাড়িয়ে ১৮ শতাংশ করে দেওয়া হয়েছে। এই বৃদ্ধি নিয়েও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনাও হচ্ছে।

তবে এই হার শুধুমাত্র ভারতে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিক্রি হওয়া ব্যবহৃত গাড়ির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে বলে জানানো হয়েছে। পুরনো বা ব্যবহৃত গাড়ির ব্যবসা করে ‘কারস ২৪’ নামক একটা সংস্থা। ওই কোম্পানির সিইও বিক্রম চোপড়া নতুন করের হার নিয়ে বিবিসি তামিলের সঙ্গে কথা বলেছেন।

তার কথায়, “শুধুমাত্র পুরনো গাড়ির উপর কর বাড়ানোর দিকে নজর না দিয়ে সরকারের উচিত ছিল দূরদর্শী পদক্ষেপ নেওয়া। লক্ষ লক্ষ ভারতীয়ের জন্য পুরানো গাড়ি কিন্তু একটা জরুরি বিষয়।”

“পুরনো গাড়ি কিনে মানুষ তার গাড়ি কেনার স্বপ্ন সহজে পূরণ করতে পারে। নতুন জিএসটি নীতি এই ক্ষেত্রের যে বিকাশ হতে পারত, তার গতি কমিয়ে দেবে।”

করের হার পরিবর্তনের প্রস্তাব জিএসটি কাউন্সিলের অনুমোদনের পরেই কার্যকর করা হয়।

ছবির উৎস, Getty Images

কীভাবে করের হার হ্রাস বা বৃদ্ধি করা হয়?

প্রতি বছরই জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠকে পণ্যের উপর আরোপিত কর নিয়ে একাধিক সিদ্ধান্ত হয়।বৈঠকে নতুন কর ধার্য বা করের হারে পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয় এবং কাউন্সিলের অনুমোদনের পরই তা বাস্তবায়ন করা হয়।

ঝাড়খণ্ড সরকারের মন্ত্রী এবং একসময় রাজ্যের অর্থ দফতরের দায়িত্বে থাকা রামেশ্বর ওরাওঁ বলেন, “যে প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট রয়েছে, কেবল সেই প্রস্তাবই বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে রাজ্যগুলোর কাছেও একটা ভোট রয়েছে।”

“রাজ্যের হয়ে মুখ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী বা অন্য কেউ বৈঠকে অংশ নিতে পারেন। কিন্তু এখন মাত্র কয়েকটা রাজ্যে বিরোধী দলের সরকার রয়েছে, তাই আমরা যা চাই সেটা করতে পারি না। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় সরকার যা চায় সেটাই হয়।”

জিএসটি কী?

ভারতে ২০১৭ সালে চালু হয়েছে জিএসটি অর্থাৎ পণ্য ও পরিষেবা কর। এটা বাস্তবায়ন করতে ওই বছরের ৩০শে জুন সংসদ ভবনে একটা বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। রাত ১২টায় অ্যাপের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয় জিএসটির পরিকল্পনা।

ভারতে অধিকাংশ পণ্য ও সেবার উপর থেকে ভিন্ন ভিন্ন কর প্রত্যাহার করে সেগুলোকে জিএসটির আওতায় আনা হয়েছে।

সরকারের দাবি, এখনও পর্যন্ত এটাই ভারতের সবচেয়ে বড় কর সংস্কার। জিএসটিকে ‘এক দেশ এক কর’ হিসাবে ব্যাখ্যাও করা হয়েছে।

তবে জিএসটি-র আওতায় বিভিন্ন করের হার নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে প্রশ্ন তুলেছে। এর পাশাপাশি, জিএসটি-কে জটিল কর ব্যবস্থা আখ্যা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে। সাধারণ মানুষের কটাক্ষের শিকারও হতে হচ্ছে সরকারকে।

জিএসটি কাউন্সিলের সাম্প্রতিক বৈঠকের পরে, মানুষ অভিযোগ করছেন যে জিএসটিতে করের বিভিন্ন হার রয়েছে। তাসত্ত্বেও সরকার দাবি করে আসছে এটা সরল একটা কর।

জিএসটিতে কতগুলো স্ল্যাব রয়েছে?

ভারতে জিএসটির চারটে স্ল্যাব রয়েছে, যার আওতায় পাঁচ শতাংশ, ১২ শতাংশ, ১৮ শতাংশ এবং ২৮ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া কিছু পণ্যের উপর বিশেষ করের হারও আরোপ করা হয়েছে।

যেমন ভোজ্যতেল, চিনি, মসলা, চা ও কফি (ইনস্ট্যান্ট কফি ব্যতীত), কয়লা, রেলওয়ে, ইকোনমি ক্লাস ভ্রমণ ও রাসায়নিক সারসহ অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পাঁচ শতাংশ স্ল্যাবের আওতায় আসে।

১২ শতাংশ স্ল্যাবের আওতায় পরে আলট্রা প্রসেসড এবং বিলাসবহুল পণ্য ও পরিষেবা রয়েছে। তবে এই তালিকায় কিন্তু ফলের রস, কম্পিউটার, আয়ুর্বেদিক ওষুধ, সেলাই মেশিন এবং হোটেলের মতো সস্তা জিনিস এবং পরিষেবাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আর্থিক পরিষেবা এবং বিমা, টেলিকম পরিষেবা, আইটি পরিষেবা, নন-এসি রেস্তোরাঁ, সস্তা পোশাক এবং জুতোসহ অন্যান্য পণ্য ও পরিষেবার উপর ১৮ শতাংশ কর বসানো হয়েছে।

২৮ শতাংশ করের স্ল্যাবের আওতায় রয়েছে বিলাসবহুল পণ্য ও সেবা। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চমানের গাড়ি, এসি-ফ্রিজ, তামাকের মতো পণ্য এবং দামি হোটেলের উপর ২৮ শতাংশ কর ধার্য করা হয়।

এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ রেট রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সোনা এবং মূল্যবান পাথরের জন্য ৩ শতাংশ, ছোট পণ্যের জন্য ১ শতাংশ এবং নির্দিষ্ট রেস্তোরাঁর জন্য ৫ শতাংশ বিশেষ জিএসটি হার প্রযোজ্য।

ঝাড়খণ্ডের মন্ত্রী রামেশ্বর ওরাওঁ জানিয়েছেন, জিএসটির বিষয়ে রাজ্যের হাতে কোনও অধিকার নেই-ফাইল চিত্র।

ছবির উৎস, ANI

বিবিসি বাংলায় অন্যান্য খবর

রাজ্যের হাতে কতটা ক্ষমতা আছে?

রামেশ্বর ওরাওঁ ব্যাখ্যা করেছেন যে জিএসটির বিষয়ে রাজ্যগুলোর হাতে কোনও অধিকার নেই।

তিনি বিবিসিকে বলছেন, “ডিজেল ও পেট্রোলের ওপর ভ্যাট নির্ধারণ করার অধিকার আমাদের আছে, তাই আমরা এটা ছাড়তে চাই না, যাতে আমরা আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ভ্যাট কমাতে বা বাড়াতে পারি। তাছাড়া মদের ক্ষেত্রেও রাজ্যগুলো নিজের করের অধিকার হারাতে চায় না।” ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স বা ভ্যাট হলো মূল্য সংযোজন কর।

রামেশ্বর ওরাওঁ জানিয়েছেন, আগে জিএসটি আদায় ও বণ্টনের ক্ষেত্রে সমস্যা ছিল। কিন্তু বিষয়টা অনলাইন মাধ্যমে হয়ে যাওয়ার পর সেই সমস্যার সমাধান হয়েছে।

তিনি জানিয়েছেন এর আগে, রাজ্যগুলোর প্রাপ্ত এস-জিএসটি (স্টেট গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স) এবং কেন্দ্রের প্রাপ্ত সি-জিএসটি (সেন্ট্রাল গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স) প্রতি মাসের ২০ তারিখে বিতরণ করা হতো, যা রাজ্যগুলোর জন্য একটা বড় সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। কারণ এটা তাদের রাজস্বের একটা বড় অংশ।