Source : BBC NEWS
ওসামা বিন লাদেনকে আফগানিস্তানে আশ্রয় দিয়েছিলেন তালেবান প্রধান মোল্লা ওমর। তাও এমন একটা সময়ে যখন পুরো বিশ্বে তার লুকানোর মতো কোনও জায়গা ছিল না।
আফগানিস্তানে বসেই ওসামা বিন লাদেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আঘাত হানার ষড়যন্ত্র করেছিলেন, যে ঘটনায় প্রায় তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
‘লুকিং ফর দ্য এনিমি, মোল্লা ওমর অ্যান্ড দ্য আননোন তালিবান’ নামে আফগানিস্তানে লাদেনকে আশ্রয় দানকারী মোল্লা ওমরের জীবনী লিখেছেন ডাচ সাংবাদিক এবং লেখক বেটি ডাম।
বইয়ে তিনি এ উল্লেখ করেছেন, “সর্বত্র মোল্লা ওমরের একটা মাত্র ছবিই দেখা যায়। সেটাই যে সঠিক সে বিষয়েও ব্যাপক সমর্থন পাওয়া যায় না। কেউই নিশ্চিত করতে পারেন না যে ছবিটা সত্যিই মোল্লা ওমরের কী না।”
দুই কোটি ডলার পুরস্কার ঘোষণা
২০০১ সালের পর মোল্লা ওমর কোথায় যান, তা নিয়ে রহস্য ছিল। আফগান সরকার, যুক্তরাষ্ট্র এবং দেশটির সরকার ও গণমাধ্যম বিশ্বাস করত তিনি পাকিস্তানে বসবাস করছেন।
অন্যদিকে, তালেবান সে সময় ওই দাবি অস্বীকার করে বলেছিল, মোল্লা ওমর আফগানিস্তানেই আছেন।
তবে, ২০০১ সাল থেকেই বিভিন্ন সময়ে তার মৃত্যুর বিষয়ে খবর ছড়াতে দেখা গেছে।
তাকে ধরতে মরিয়া ছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ২০১২ সালে ঘোষণা করে, এই তালেবান নেতার অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দিতে পারলে সে ব্যক্তিকে দুই কোটি ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় মোল্লা ওমরের বর্ণনা যেভাবে দেওয়া হয়েছিল তা হচ্ছে –
- চুল- কালো
- উচ্চতা- লম্বা
- জাতীয়তা- আফগান
- বিশেষ চিহ্ন- ডান চোখে আঘাতের চিহ্ন
সোভিয়েত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ
এমন নয় যে শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু ছিলেন তিনি। বরং একটা সময় ছিল যখন তাকে ‘কাজের মানুষ’ বলেই বিবেচনা করত মার্কিনীরা।
এর কারণ হলো, যারা সোভিয়েত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল তাদের মধ্যে একজন মোল্লা ওমর।
আফগানিস্তানের কান্দাহারের এক গ্রামে তার জন্ম। মাত্র দুই বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। যে সময় সোভিয়েত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নিতে শুরু করেন, তখন তার বয়স আনুমানিক ২২-২৩ বছর।
ডাচ লেখক বেটি ডাম লিখেছেন, “যুদ্ধের সময় তাকে ‘রকেটি’ বলে ডাকা হতো, কারণ রকেটের বিষয়ে তার নিশানা ছিল অব্যর্থ।”
“শুরুর দিকে কিন্তু আফগান যোদ্ধাদের লক্ষ্য এতটা ভালো ছিল না, যে কারণে বহু নিরীহ বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল।”
মিজ ডামকে তালেবানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ মুতাওয়াক্কিল বলেছিলেন, “সোভিয়েত সৈন্যদের নজর কেড়েছিল ওমর। এমনকি একবার তারা (সোভিয়েতের পক্ষ থেকে) রেডিওতে ঘোষণা করেছিলেন যে লম্বা লোকটাকে (মোল্লা ওমর) হত্যা করা হয়েছে।
তবে, এটা মনগড়া কথা ছিল।
“কারণ ওই লম্বা লোকটা (মোল্লা ওমর) ততক্ষণে তাদের হাত থেকে পালিয়ে গিয়েছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায় নাম থাকা মোল্লা ওমরের ব্যক্তিত্বের বিষয়ে লিখেছেন মিজ ডাম।
তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, “ছেলেবেলায় ওমরের স্বভাব একটু দুষ্টু প্রকৃতির হলেও পরে তিনি অন্তর্মুখী এবং লাজুক হয়ে ওঠেন, বিশেষত বাইরের মানুষের সামনে।”
“কিন্তু তিনি যখন তার বন্ধু বান্ধবদের মাঝে থাকতেন, তখন অন্যদের নকল করে মজা পেতেন।”
চোখে গুরুতর আঘাত
সোভিয়েত সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধের সময়, ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে এক চোখে গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন তিনি।
বেটি ডাম তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, “সোভিয়েত সৈন্যরা তাদের ওপর হামলা করবে এই আশঙ্কায় মোল্লা ওমর ও তার সঙ্গীরা লুকিয়ে ছিলেন। তাদের সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়।”
“তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, এমন সময় সোভিয়েত বিমান বাহিনী একটা বোমা ফেলে। সেই বিস্ফোরণে নিকটবর্তী মসজিদ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ক্ষতিগ্রস্ত সেই ভবনের ধ্বংসাবশেষের একটা টুকরো হাওয়ায় উড়ে এসে মোল্লা ওমরের ডান চোখে আঘাত করে।”
ওই জায়গায় চিকিৎসকের এসে পৌঁছাতে পুরো একটা দিন সময় লেগেছিল।
মিজ ডাম লিখেছেন, “সিআইএ তালেবানকে সাহায্য করছিল, তাদের অস্ত্রও পৌঁছে দিচ্ছিল। কিন্তু তারা মোল্লা ওমরের চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা করেনি।
যতক্ষণে চিকিৎসক মোল্লা ওমরের কাছে পৌঁছান, ততক্ষণে তিনি নিজের হাত দিয়ে তার চোখে ঢুকে থাকা ধাতব টুকরোটা তুলে ফেলেছিলেন।”
“নিজের পাগড়ি দিয়ে চেপে রক্তপাত বন্ধ করার চেষ্টা করছিলেন। ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর সহকর্মীরা মোল্লা ওমরকে পাকিস্তানের কোয়েটা শহরে নিয়ে যান।”
ধর্ষক কমান্ডারকে ফাঁসি দিয়েছিলেন
মোল্লা ওমরের বিষয়ে একটা প্রচলিত গল্প আছে যা বেশ বিখ্যাত। ১৯৯৪ সালের গোড়ার দিকে স্থানীয় এক কমান্ডার দুইজন নারীকে অপহরণ ও ধর্ষণ করে।
সাংবাদিক ও লেখক স্যান্ডি গল সংবাদমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ ২০১৫ সালের ৩০শে জুলাই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, “মোল্লা ওমর ৩০ জন তরুণ ছাত্রকে একত্রিত করে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেন। এরপর তারা ওই অভিযুক্ত কমান্ডারের আস্তানায় আক্রমণ করেন।”
“তারা শুধু দু’জন মেয়েকে উদ্ধারই করেননি, ওই কমান্ডারকে ট্যাংকের ব্যারেলে ফাঁসিতে ঝোলায়। পরে তিনি (মোল্লা ওমর) বলেন, আমরা সেই মুসলমানদের বিরুদ্ধেও লড়াই করছি যারা পথ হারিয়ে ফেলেছে।”
প্রসঙ্গত, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুদ্ধে আনুমানিক ৭৫ হাজার থেকে ৯০ হাজার আফগানের মৃত্যু হয়েছে।
এই যুদ্ধে ১৫ হাজার সোভিয়েত সৈন্যেরও মৃত্যু হয়েছে।
দশ বছরে প্রায় ১৫ লাখ আফগান নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে এবং প্রায় ৩০ লাখ মানুষ আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই চিরতরে হাত-পা হারিয়েছেন।
বিবিসির সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ
বিবিসির সাংবাদিক রহিমুল্লাহ ইউসুফজাই যখন কান্দাহারের গভর্নরের বাংলোয় মোল্লা ওমরের সঙ্গে দেখা করতে যান, তখন ওই সাংবাদিক দেখেন ঘাসের ওপর পাগড়ি পেতে দুপুরের ঘুম দিচ্ছেন ওমর।
মজার বিষয় হলো, বহু বিলাসবহুল কক্ষ এবং বলরুমযুক্ত ওই বিশাল ভবনে মোল্লা ওমর নিজের জন্য পছন্দ করেছিলেন সিঁড়ির নিচে একটা জানালাবিহীন ঘর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইএসআইয়ের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বেটি ডামকে বলেন, “এখানে সব তালেবান নেতারা একসঙ্গে গালিচায় বসে চা পান করতেন। পাশেই একটা লোহার বাক্স রাখা থাকত যার মধ্যে সমস্ত টাকা-পয়সা রাখা হতো।”
“কেউ কেউ এমনও জানিয়েছেন যে মোল্লা ওমর খুব কমই তার পোশাক পরিবর্তন করতেন কারণ তাকে সবসময় একই পোশাকে দেখা যেত।
তার খাদ্যাভ্যাসও ছিল একেবারে সাধারণ। স্যুপ ও সেদ্ধ আলু খেতেন তিনি। এই খাবার এত দ্রুত খেতেন যে দেখে মনে হতো তিনি খুবই ক্ষুধার্ত।”
সাক্ষাৎকার দিতেন না
মোল্লা ওমর ভালো বক্তা ছিলেন না। তার কণ্ঠস্বর একজন বৃদ্ধ ও অশিক্ষিত মানুষের মতো শোনাত। একটা কথা কয়েকবার বলার অভ্যাস ছিল তার, যা শুনে মনে হতো তিনি তোতলাচ্ছেন।
১৯৯৫ সালে বিবিসির সিনিয়র সাংবাদিক রহিমুল্লাহ ইউসুফজাই মোল্লা ওমরের সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিকের মধ্যে একজন যিনি এই শীর্ষ তালেবান নেতাকে কাছ থেকে দেখেছেন।
সে প্রসঙ্গে লেখক বেটি ডাম উল্লেখ করেছেন, “মোল্লা ওমর ইউসুফজাইকে শ্রদ্ধার সাথে স্বাগত জানান। তিনি প্রায়ই বিবিসির পশতু সার্ভিসে তার (রহিমুল্লাহ ইউসুফজাইয়ের) অনুষ্ঠান শুনতেন।
কিন্তু সাক্ষাৎকার দিতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। তালেবান নেতা জানিয়েছিলেন, তিনি মাইক্রোফোনের সামনে কথা বলতে পারবেন না। জীবনে একটাও সাক্ষাৎকার দেননি তিনি।”
বেশ কয়েকবার বোঝানোর পর মোল্লা ওমর ইউসুফজাইকে বলেন, তিনি (রহিমুল্লাহ ইউসুফজাই) যেন নিজের প্রশ্নাবলী এবং টেপ রেকর্ডার তার (মোল্লা ওমরের) প্রেস উপদেষ্টা আবদুল রহমান হোতাকির কাছে রেখে যান। পরদিন মোল্লা ওমর সমস্ত প্রশ্নের জবাব রেকর্ড করান।
তার উত্তর শুনে মনে হচ্ছিল, যেন জবাব দিতে তার বেশ সমস্যা হয়েছে। আবদুল রহমান হোতাকি জানিয়েছিলেন যে, কিছু প্রশ্নের উত্তর তাকে একাধিকবার রেকর্ড করতে হয়েছে।
আসলে বিষয়টা হলো মি. হোতাকি এক টুকরো কাগজে ওই প্রশ্নগুলো লিখে দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা পড়তে বেগ পেতে হচ্ছিল মোল্লা ওমরকে।
মিজ ডাম জানিয়েছেন, ওই টেপ রেকর্ডারটা পরে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং কোনও সংরক্ষণাগারেই সেটা আর পাওয়া যায়নি।
গাড়ি চালানোর শখ
মোল্লা ওমরের গাড়ি চালানোর শখ ছিল, তবে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। বেশ কয়েকবার তিনি দুর্ঘটনার কবলেও পড়েছেন।
তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী মুতাসিম আগা জানের কথায়, “আমরা চাইতাম না যে তিনি গাড়ি চালান। কিন্তু এতটাই নাছোড়বান্দা ছিলেন তিনি যে চালককে পাশে বসিয়ে রেখে নিজেই গাড়ি চালাতেন।”
“অনেক সময় দুর্ঘটনার পর অপেক্ষা করতেন কখন গাড়িটা গ্যারাজ থেকে মেরামত হয়ে ফিরবে, যাতে তিনি আবার সেটি চালাতে পারেন।”
যুদ্ধ গতি হারালে অন্যান্য তালেবান যোদ্ধাদের মতো তিনি নিজেও লড়াইয়ে যোগ দিতেন।
লেখক আহমেদ রশিদ তার বই ‘দ্য স্টোরি অফ আফগান ওয়ারলর্ডস’-এ লিখেছেন, “মোল্লাহ ওমর পারলে সবসময় বাংকারে তালেবান যোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে লড়াই করতেন, কিন্তু তার কমান্ডাররা সেটা চাননি।”
“তারা তাকে বলতেন- তোমাকে আমাদের নেতা হিসেবে প্রয়োজন, সৈনিক হিসেবে নয়।”
আধুনিক জীবন থেকে বহু দূরে
তালেবানরা যখন প্রথম কাবুলে প্রবেশ করে, তখন মোল্লা ওমর কাবুলের পরিবর্তে কান্দাহারে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি কাবুলের দৈনন্দিন শাসনের দায়িত্ব মোল্লা রব্বানির কাছে হস্তান্তর করেন।
মোল্লা রব্বানি প্রেসিডেন্ট ভবনে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন, যেখানে আগে বুরহানউদ্দিন রব্বানি থাকতেন।
তালেবানদের প্রশাসনিক বিষয়ে কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না এবং তাদের মধ্যে অনেকেই খুব অল্প বয়সী ছিলেন।
মোল্লা জাইফ তার বই ‘মাই লাইফ উইথ দ্য তালেবান’-এ লিখেছেন, “এদের অনেকেই শুধুমাত্র কুরআন পড়তে এবং যুদ্ধ করতে জানতেন। খুব কষ্ট করে কোনোমতে মতে সই করতে পারতেন।”
“তারা কক্ষের চেয়ারগুলো সরিয়ে রেখে মেঝেতে তোশক পেতে মন্ত্রীদের বৈঠকের আয়োজন করতেন যা দেখে অন্যান্য কর্মকর্তারা হতবাক হয়ে যান।”
তালেবানের শীর্ষ নেতারা গাড়ির বদলে পায়ে হেঁটে কাবুল শহরে যেতেন।
সম্ভবত এর একটা কারণ হলো – সেই সময় কাবুলে খুব কম গাড়ি ছিল এবং পেট্রোলের দামও ছিল আকাশচুম্বী।
পাসপোর্টের ছবি ছাড়া সারা দেশে ছবি তোলা নিষিদ্ধ ছিল।
গান শোনা এবং বাজানো দুই-ই নিষিদ্ধ ছিল। বহু গাড়ি থামিয়ে তার ক্যাসেট প্লেয়ার থেকে ক্যাসেট সরিয়ে নিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে।
জাতীয় খেলা ‘বুজকুশি’ও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
এর পাশাপাশি দাবা খেলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। ফুটবল খেলার সময় হাফ প্যান্টের পরিবর্তে ফুল প্যান্ট পরতে হতো।
মোল্লা ওমর এবং লাদেনের বন্ধুত্ব
যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পড়ে ১৯৯৬ সালে সুদান যখন ওসামা বিন লাদেনকে সেই দেশ ছাড়তে বলে, তখন আফগানিস্তানে চলে যাওয়া ছাড়া তার কাছে আর অন্য কোনও উপায় ছিল না।
মোল্লা ওমর তাকে সে সময় আশ্রয় দেন বলেই শোনা যায়। যদিও ওসামা বিন লাদেনের পুত্র অন্য কথা দাবি করেছেন।
ওসামা বিন লাদেনের ছেলে ওমর বিন লাদেন তার বই ‘গ্রোয়িং আপ বিন লাদেন’ – এ লিখেছেন, “আফগানিস্তান যাওয়ার পথে আমাদের বিমান যখন সৌদি আরবের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল, তখন বাবার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিল। ভয় ছিল যে আমাদের বিমানকে রকেট দিয়ে আঘাত করে ধ্বংস না করে দেওয়া হয়।”
তিনি জানিয়েছেন, ১৯৯৬ সালে ওসামা বিন লাদেনের বিমান যখন জালালাবাদে অবতরণ করে, তখন তাকে স্বাগত জানানোর জন্য মোল্লা ওমর উপস্থিত ছিলেন না।
বাবা ওসামা বিন লাদেন এবং মোল্লা ওমরের সম্পর্ক নিয়ে ভিন্ন তথ্য জানিয়েছেন পুত্র ওমর বিন লাদেন। তার দাবি, মোল্লা ওমরের আহ্বানে তার বাবা আফগানিস্তান যাননি।
তিনি লিখেছেন, “এটা খুবই ভুল ধারণা যে মোল্লা ওমরের আমন্ত্রণে ওসামা আফগানিস্তানে এসেছিলেন। বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের লোকজন।
প্রাথমিকভাবে আফগান সম্রাট জাহির শাহের এক প্রাসাদে তাকে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পর ওসামা তোরা-বোরা পাহাড়ের একটা গুহায় বাস করতে যান। এই ‘কথিত’ বন্ধুত্বের (মোল্লা ওমর এবং ওসামা বিন লাদেনের) কোনো স্মৃতি আমার নেই।”
৯/১১ হামলার পর
ওমর বিন লাদেন জানিয়েছেন, তার স্পষ্ট মনে আছে ২০০১ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার পর মোল্লা ওমর ওসামা বিন লাদেনকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলেন।
লেখক বেটি ডামকে ওমর বিন লাদেন বলেছিলেন, “মোল্লা ওমর আমার বাবার চেয়েও লম্বা ছিলেন। তিনি যখন আমার বাবার সাথে দেখা করতে আসেন, তখন মোল্লা ওমরের জন্য ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল।”
“কিন্তু তিনি ওসামা থেকে কিছুটা দূরে বসেন। নিজের জন্য একটা চেয়ার চেয়েছিলেন, যা কিছুটা অদ্ভুত ছিল, কারণ অন্য সবাই মেঝেতে বসেছিল। তিনি আমার বাবাকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন – কাজ হচ্ছে না। আপনাকে এখান থেকে বের হতে হবে।”
ওসামাকে মোল্লা ওমর বলেছিলেন, “ওরা (আমেরিকানরা) ইতোমধ্যে মাদক ও নারী অধিকারকে বড় ইস্যুতে পরিণত করেছে। আমি চাই না আপনার প্রত্যর্পণ আরও একটা বড় ইস্যু হয়ে উঠুক।”
ওমর বিন লাদেন লেখক বেটি ডামকে বলেছিলেন, “মোল্লা ওমর বলেন ইসলামি আইন অনুযায়ী আমি আপনাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে পারব না। তবে আমি আশা করব আপনি নিজেই চলে যাবেন।”
“এর উত্তরে আমার বাবা যখন ওমরকে বলেন যে সুদান তাকে পাঁচ বছর থাকার অনুমতি দিয়েছিল, আর আফগানিস্তানে তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছর বাস করেছেন, তখন তিনি (মোল্লা ওমর) উঠে দাঁড়ান এবং চলে যান। এমনকি তিনি ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে করমর্দনও করেনি।”
৯/১১ হামলার পরে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানকে বলেছিল ওসামা বিন লাদেনকে যেন তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
কিন্তু মোল্লা ওমরের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া পায়নি তারা। এরপর যুক্তরাষ্ট্র তোরা-বোরাতে বোমা হামলা শুরু করে দেয়।
বামিয়ানে বুদ্ধ মূর্তি ধ্বংস
২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে মোল্লা ওমর বামিয়ানে দু’টো ঐতিহাসিক বুদ্ধ মূর্তি ধ্বংস করার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেন।
এই মূর্তিগুলো ১৭৪ থেকে ১১৫ ফুট উঁচু ছিল। ১৫০০ বছর আগে পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছিল ওই মূর্তি যা ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাতেও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তার ওই ঘোষণায় সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
তবে, মোল্লা ওমর নিজের সিদ্ধান্ত বদলাননি।
২০০১ সালের দোসরা মার্চ বিস্ফোরক দিয়ে ওই ঐতিহ্যবাহী মূর্তিগুলো ধ্বংস করেন তিনি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।
মোল্লা ওমরকে হত্যার চেষ্টা
কান্দাহারে ২০০১ সালের ছয়ই অক্টোবরের রাতে মোল্লা ওমরের দফতরের ওপরে একটা মার্কিন চালকবিহীন প্রিডেটর ৩০৩৪ ড্রোন উৎক্ষেপণ করা হয়।
উদ্দেশ্য ছিল, তাকে হত্যা করা।
‘দ্য আটলান্টিক’ ম্যাগাজিনের ২০১৫ সালের ৩০শে মে-র সংখ্যায় ‘দ্য স্টোরি অফ আমেরিকাস ফার্স্ট ড্রোন স্ট্রাইক’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে ক্রিস উড লিখেছেন, “হাজার হাজার মাইল দূরে ল্যাংলিতে সিআইএ-র সদর দফতরে সিআইএর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ড্রোনের ছবি দেখছিলেন।
তাদের আশঙ্কা ছিল যে দফতরে ওই বোমাটা ফেলা হলে অনেক নিরীহ মানুষের মৃত্যু হবে। তাই তারা মোল্লা ওমরের বাইরে বেরিয়ে আসার অপেক্ষা করছিলেন।”
ক্রিস উড লিখেছেন, “যখন সশস্ত্র ব্যক্তি বোঝাই তিনটে ল্যান্ডক্রুজার গাড়ি ওই ভবন থেকে বেরিয়ে আসে, তখন সিআইএ কর্মকর্তারা নিশ্চিত ছিলেন যে ওই গাড়ির মধ্যে একটাতে মোল্লা ওমর রয়েছেন।”
“কিন্তু তাদের হামলার টাইমিং নিয়ে দু’জন জেনারেলের মধ্যে মতপার্থক্যের ফলে হেলফায়ার রকেট নিক্ষেপ করা হয়নি। ভিড়ে ঠাঁসা রাস্তায় ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায় ওই তিনটে ল্যান্ডক্রুজার গাড়ি।”
দীর্ঘ রোগভোগের পর মৃত্যু
এই তালেবান প্রধানকে ঘিরে দীর্ঘকাল রহস্য ছিল। আজও মোল্লা ওমরের মৃত্যু নিয়ে নানান ধরনের কথা প্রচলিত আছে।
২০১৫ সালের জুলাই মাসে আফগান সরকার ঘোষণা করে যে তার মৃত্যু হয়েছে। যদিও অনেকে বলেন, এর দুই বছর আগে ২০১৩ সালের ২৩শে এপ্রিল তার মৃত্যু হয়।
লেখক বেটি ডাম লিখেছেন, “মোল্লা ওমরের সহযোগী আবদুল জব্বার ওমারি আমাকে বলেছিলেন যে, সেদিন কান্দাহারে প্রচুর শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। মোল্লা ওমরের তিন মাস ধরে কাশি হচ্ছিল। তিনি বমিও করছিলেন। ওমারি তাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য জোর দিয়েছিলেন, কিন্তু মোল্লা ওমর তার কথা শোনেননি।”
মি. ওমারি তাকে বলেছেন, “অনেক কষ্টে তিনি স্থানীয় একটা দোকান থেকে কেনা ইনজেকশন নিতে রাজি হন। তিনি অচেতন অবস্থায় ছিলেন, তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল।”
“তাকে যখন আমি স্পর্শ করি তখন নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ে যান তিনি। পরদিন তার মৃত্যু হয়।”