Source : BBC NEWS
সাল ১৯১৫। ভারতীয় উদ্যোক্তা ২৯ বছর বয়সী ঝমনদাস ওয়াতুমুল তার আমদানি ব্যবসার জন্য একটি দোকান খোলার উদ্দেশ্যে সঙ্গী ধর্মদাসকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের জনবহুল শহর হনোলুলুতে আসেন।
তারা দু’জন মিলে হনোলুলু’র হোটেল স্ট্রিটে ‘ওয়াতুমুল এ্যান্ড ধর্মদাস’ নামে একটি ব্যবসা শুরু করেন। সেখানে তারা পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন বিলাসী পণ্য বিক্রি করতেন। যেমন‒ সিল্ক, হাতির দাঁতের কারুকাজ, পিতলের জিনিসপত্র কিংবা অন্যান্য নানাবিধ শৌখিন দ্রব্য।
কিন্তু ব্যবসা শুরুর মাত্র এক বছরের মাথায়, অর্থাৎ ১৯১৬ সালে ধর্মদাস কলেরায় মারা যান।
এরপর ঝমনদাস ওয়াতুমুল তার ভাই গোবিন্দ্রামকে দোকান পরিচালনার জন্য হনোলুলুতে নিয়ে আসেন এবং নিজে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় ব্যবসা দেখাশোনা করতে থাকেন।
পরবর্তী কয়েক বছরে দুই ভাই ভারত ও হাওয়াইয়ের মধ্যে যাতায়াত করতে থাকেন এবং তাদের ব্যবসাকে আরও প্রতিষ্ঠিত করেন।
বর্তমানে ওয়াতুমুল নামটি হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের সর্বত্র পরিচিত। পোশাক উৎপাদন আর আবাসন খাত থেকে শুরু করে শিক্ষা ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতায়, এই পরিবার হাওয়াইয়ের সমৃদ্ধ ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
ভারত থেকে হাওয়াইতে আসা দক্ষিণ এশীয়দের মাঝে এই পরিবারটি এখন ওই দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলোর একটি।
“ধীরে ধীরে, এভাবেই আমরা এগিয়েছিলাম,” ১৯৭৩ সালে স্থানীয় একটি হাওয়াইয়ান প্রকাশনাকে বলেছিলেন ঝমনদাস।
ঝমনদাসের জন্ম স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতে। তার বাবা ছিলেন তৎকালীন ভারতের হায়দ্রাবাদ (বর্তমানে পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশ) শহরের একজন ইটের ঠিকাদার।
পরিবারটি শিক্ষিত হলেও ধনী ছিল না। একটি দুর্ঘটনায় তার বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার পর, ঝমনদাসের মা তার ফিলিপাইনে যাওয়ার অর্থ জোগাড় করেন।
সেখানে তিনি প্রথমে একটি টেক্সটাইল মিলে কাজ শুরু করেন। পরে ১৯০৯ সালে ধর্মদাসের সঙ্গে ম্যানিলায় নিজের ব্যবসা শুরু করেন ঝমনদাস।
ঝমনদাসের নাতি জেডি ওয়াতুমুল জানান, ঝমনদাস ও ধর্মদাসের হাওয়াইতে চলে যাওয়ার কারণ হলো ম্যানিলায় ব্যবসায় মন্দা দেখা দেওয়া। তাছাড়া, ফিলিপাইনে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারিত্বের ফলে বিদেশি ব্যবসার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়।
ঝামানদাসের ভাই গোবিন্দ্রাম ব্যবসাটি পরিচালনা করার পর এর নাম পরিবর্তন করে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া স্টোর’ রাখা হয়। এরপরের কয়েক বছরে এই ব্যবসা বড় আকারের ডিপার্টমেন্ট স্টোরে পরিণত হয়, যার শাখা হাওয়াইসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সাউথ এশিয়ান আমেরিকান ইতিহাসের ডিজিটাল আর্কাইভ এসএএডিএ থেকে এ তথ্য জানা যায়।
গোবিন্দ্রাম ১৯৩৭ সালে হনোলুলুর ওয়াইকিকি এলাকায় ‘ওয়াতু্মুল বিল্ডিং’ তৈরি করেন, যা কোম্পানির সদর দপ্তর হিসাবে ব্যবহৃত হতো। এসএএডিএ অনুযায়ী, ১৯৫৭ সালের মাঝে এই ব্যবসাটি ১০টি দোকান, একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবন ও বাণিজ্যিক উন্নয়ন খাতে প্রসারিত হয়।
দ্য স্টার-বুলেটিন পত্রিকা ওয়াতুমুল দোকানের পণ্যগুলিকে “রোমান্স ও রহস্যে মোড়ানো” বলে বর্ণনা করেছে, যা মানুষকে “দূরবর্তী দেশ এবং আকর্ষণীয় দৃশ্যপটের” কথা মনে করিয়ে দেয়।
আলোহা শার্ট
ধনী পর্যটকদের কাছে ১৯৩০-এর দশকে জনপ্রিয় গন্তব্য হিসাবে আবির্ভূত হয় হাওয়াই। তখন দ্বীপের মোটিফসহ উজ্জ্বল রঙের “আলোহা শার্ট” বা আজকের সুপরিচিত হাওয়াই শার্ট একটি জনপ্রিয় উপহারসামগ্রীতে পরিণত হয়।
হাওয়াইয়ান বস্ত্র ও নকশার বিশেষজ্ঞ ডেল হোপের মতে, ওয়াতুমুলের ইস্ট ইন্ডিয়া স্টোর ওই দ্বীপের প্রথম দোকানগুলোর একটি, যারা হাওয়াইয়ান নকশাসহ শার্ট বিক্রি শুরু করে।
গোবিন্দ্রাম ১৯৩৬ সালে সর্বপ্রথম ওই নকশাগুলো তার শালিকা এলসি জেনসেনের কাছে অর্ডার দেন, যিনি পেশায় ছিলেন একজন শিল্পী।
“মাউন্ট ফুজির বদলে তিনি ডায়মন্ড হেড আঁকতেন, কই মাছের বদলে আঁকতেন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মাছ, চেরি ফুলের বদলে গার্ডেনিয়া ও হিবিস্কাস—যা এই দ্বীপের পরিচিত জিনিস,” হোপ বলছিলেন।
লেখক ন্যান্সি শিফার তার বই ‘হাওয়াইয়ান শার্ট ডিজাইনস’-এ লেখেন যে ওই নকশা প্রথমে জাপানে পাঠানো হতো। সেখানে সেগুলো হাতে ব্লক করে কাঁচা সিল্কের উপর ছাপানো হতো।
“শিল্পের বিবেচনায় এই সূক্ষ্ম ফুলেল নকশাগুলো আধুনিক ও অনন্য ছিল। এগুলোই ছিল বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত প্রথম হাওয়াইয়ান নকশা,” শিফার উল্লেখ করেন।
নৌকা ভর্তি করে এসব শার্ট বিক্রি হতো এবং লন্ডনের মতো দূরবর্তী শহরেও তা প্রদর্শিত হতো,” লেখক উইলিয়াম ডেভেনপোর্ট তার বই ‘প্যারাডাইস অব দ্য প্যাসিফিক’-এ বলেন।
গোবিন্দ্রামের মেয়ে লীলা হোপকে বলেছিলেন যে আমেরিকান চলচ্চিত্র তারকারা, যেমন— লরেটা ইয়াং, জ্যাক বেনি, লানা টার্নার ও এডি রচেস্টার অ্যান্ডারসন এই শার্ট কিনতে আসতেন।
“আমরা ক্রমশ বুঝতে পারছি যে ‘ওয়াতুমুল’ এখন হাওয়াইয়ান ফ্যাশনের সমার্থক হয়ে উঠেছে,” ১৯৬৬ সালে গুলাব ওয়াতুমুল হনোলুলু স্টার-বুলেটিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন।
ওয়াতুমুল পরিবার পরে রয়্যাল হাওয়াইয়ান ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি কিনে নেয়, যেখানে প্রথমবারের মতো পরিবারের জন্য ম্যাচিং আলোহা পোশাক তৈরি হয়।
নাগরিকত্ব পাওয়ার দীর্ঘ যাত্রা
ব্যবসা করে সাফল্য অর্জনের পরও ঝমনদাস ও গোবিন্দ্রাম— দুই ভাইকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
‘হাওয়াই বিজনেস ম্যাগাজিন’ লিখেছে যে ওইসময়ের কয়েক বছর তারা চরম বৈষম্য ও কঠোর অভিবাসন আইনের শিকার হয়েছিলেন।
এরপর ১৯২২ সালে গোবিন্দ্রাম মার্কিন নাগরিক এলেন জেনসেনকে বিয়ে করেন। তবে ক্যাবল অ্যাক্ট অনুযায়ী, মার্কিন নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য নয়, এমন একজন অভিবাসীকে বিয়ে করার জন্য এলেনের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়।
এলেন জেনসেন ‘লীগ অব উইমেন ভোটারস’ এর সঙ্গে কাজ করে ওই আইন সংস্কারের চেষ্টা করেন এবং ১৯৩১ সালে তার নাগরিকত্ব ফিরে পান।
তার অনেক বছর পর, ১৯৪৬ সালে অবশেষে গোবিন্দ্রাম নাগরিকত্ব পান।
মূলত ওই আইনে আগে ভারতীয়রা মার্কিন নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য ছিল না। আইন সংস্কারের পর ভারতীয়দের মার্কিন নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
অন্যদিকে, ঝমনদাস বেশিরভাগ সময়েই ভারত ও হাওয়াইয়ের মধ্যে যাতায়াত করতে থাকেন।
দেশভাগের সময় ১৯৪৭ সালে ওয়াতুমুল পরিবার সিন্ধ থেকে বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) চলে আসে এবং তখন তাদেরকে অনেক সম্পত্তি রেখে আসতে হয় বলে উল্লেখ করেছে এসএএডিএ।
এরমাঝে ঝমনদাসের ছেলে গুলাবও পরে হাওয়াই চলে আসেন এবং পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনিই এর প্রধান হয়ে ওঠেন।
দুই ভাই ব্যবসাটি ১৯৫৫ সালে ভাগ করে নেন। ঝমনদাস ও গুলাব মিলে রিটেইল ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব নেন। আর গোবিন্দ্রামের পরিবার রিয়েল এস্টেট ব্যবসার দায়িত্ব নেয়।
পরে ১৯৫৬ সাল থেকে ঝমনদাস স্থায়ীভাবে হাওয়াইতে বসবাস শুরু করেন। এর কয়েক বছর আগে তার স্ত্রী ও এক ছেলের মৃত্যু হয়। কয়েক বছর পর ১৯৬১ সালে ঝমনদাসও মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করেন।
ভারতের সঙ্গে সংযোগ
বছরের পর বছর ধরে ওয়াতুমুল পরিবার ভারত ও ভারতের মানুষের কল্যাণে নিজেদের যুক্ত রেখেছে। এলিয়ট রবার্ট বারকান তার বই ‘মেকিং ইট ইন অ্যামেরিকা’-তে লিখেছেন, গোবিন্দ্রাম ছিলেন ‘কমিটি ফর ইন্ডিয়া’স ফ্রিডম’-এর একজন সক্রিয় সদস্য। ভারতের স্বাধীনতার সমর্থনে তিনি প্রায়ই ওয়াশিংটনে যেতেন।
গোবিন্দ্রামের লস অ্যাঞ্জেলেসের বাড়ি ছিল “ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বিগ্ন মানুষদের মিলনস্থল”, সচীন্দ্র নাথ প্রধান তার বই ‘ইন্ডিয়া ইন দ্য ইউনাইটেড স্টেটস’ বইতে এ কথা লিখেছেন।
ওয়াতুমুল ফাউন্ডেশন ১৯৪৬ সালে আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ড. এস রাধাকৃষ্ণণের অনেকগুলো বক্তৃতাকে স্পনসর করে। ড. এস রাধাকৃষ্ণণ পরবর্তীতে ভারতের রাষ্ট্রপতি হন।
গোবিন্দ্রামের স্ত্রী এলেন ১৯৫৯ সালে দিল্লিতে একটি আন্তর্জাতিক প্যারেন্টহুড কনফারেন্স আয়োজন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
এই কনফারেন্স পরে ভারতে প্রথম জন্মনিয়ন্ত্রণ ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে।
পরিবারের দাতব্য কাজের মধ্যে আরও রয়েছে হাওয়াই ও ভারতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অর্থায়ন, হনোলুলু-ভিত্তিক শিল্পকর্মের প্রোগ্রামগুলোতে অনুদান এবং বিভিন্ন বিষয়ে ভারতীয়-হাওয়াই বিনিময়কে উৎসাহিত করা।
ওয়াতুমুল ভাইদের নাতি-নাতনিরা এখন অনেকেই হাওয়াইসহ আশপাশের অঞ্চলে কাজ করেন।
গত কয়েক বছরে তাদের পারিবারিক ব্যবসা রিয়েল এস্টেটে মনোযোগ দেওয়ার কারণে সর্বশেষ ওয়াতুমুল দোকানটি ২০২০ সালে বন্ধ হয়ে যায়।
তখন কোম্পানি তাদের গ্রাহকদেরকে সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছিল।
গত বছর ওয়াতুমুল প্রোপার্টিজ হাওয়াইতে ১৯ হাজার ৪৫ বর্গমিটার আয়তনের একটি মার্কেটপ্লেস কিনেছে।
কোম্পানির সভাপতি জেডি ওয়াতুমুল বলেছেন, “এখন আমাদের পরিবারের প্রধান লক্ষ্য হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ। ভবিষ্যতেও তাই-ই থাকবে।”