Source : BBC NEWS
৩০ মিনিট আগে
বাংলাদেশে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে একজন মুক্তিযোদ্ধা হেনস্থার শিকার হয়ে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তাকে হেনস্থার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়ার পর বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনকে ঘটনার তদন্ত ও জড়িতদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
সোমবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাইকে অবমাননার তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে।
একই সাথে স্থানীয় পুলিশকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে মি. হাইয়ের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগসহ নয়টি মামলা রয়েছে।
“আমরা আইন হাতে তুলে নেয়া থেকে বিরত থাকার জন্য সবার প্রতি আহবান জানাচ্ছি,” ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
মি. হাইকে লাঞ্ছনার ঘটনায় কয়েকজন জামায়াত কর্মীর নাম বিভিন্ন গণমাধ্যমে এলেও স্থানীয় উপজেলা জামায়াতের আমির বিবিসি বাংলার কাছে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
তিনি বলেছেন, তাদের দলের কেউ এই ঘটনার সাথে জড়িত নয়।
উনআশি বছর বয়সী আব্দুল হাই বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তিনি মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণেই তাকে ছুরি ধরে গলায় জুতার মালা দিয়ে অসম্মান করা হয়েছে।
“আমি এবং আমার ছেলে নয় বছর ‘সাবেক এক মন্ত্রী’র কারণে এলাকায় থাকতে পারিনি। জামায়াতের কারও সাথে কখনো আমার কোন ঝামেলা হয়নি। এরপরেও তারা আমাকে অসম্মান করেছে মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী হওয়ার কারণেই,” বলছিলেন তিনি।
জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ নাজির আহমেদ খাঁন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ঘটনার সাথে জড়িতদের ধরতে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেছেন, তারা মি. হাই ও অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
প্রসঙ্গত, কুমিল্লার এই চৌদ্দগ্রামে আওয়ামী লীগ আমলে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী ছিলেন সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক।
এর আগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় সংসদ সদস্য ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোঃ তাহের।
কী ঘটেছিলো চৌদ্দগ্রামে?
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় চার নম্বর সেক্টরে একজন প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে মৌলভীবাজার অঞ্চলে যুদ্ধ করেছিলেন চৌদ্দগ্রামের আব্দুল হাই।
ওই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন চিত্তরঞ্জন দত্ত (সি আর দত্ত নামেই যিনি পরিচিত)।
রোববার দুপুরের দিকে স্থানীয় ১০/১২ জন সেখানকার কুলিয়ারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে তাকে পেয়ে ঘিরে ধরে ও হেনস্থা করে।
এই হেনস্থার প্রায় পৌনে দুই মিনিটের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে রবিবার রাত থেকেই।
সেখানে দেখা যায় মি. হাইয়ের গলায় জুতার মালা দিয়ে তাকে ধরে আনা হচ্ছে। লাঞ্ছনাকারীদের একজনই ভিডিওটি করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়।
ভিডিওতে তারা সবাই সেখানকার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিলেন।
ভিডিওতে দেখা যায় লাঞ্ছনাকারীদের একজন মি. হাইকে উদ্দেশ্য করে বলছেন – ‘পুরো গ্রামের মানুষের কাছে মাফ চাইতে পারবেন কি না।’
আরেকজন বলেন – ‘আপনি এই এলাকা থেকে চলে যাবেন।’
এ সময় মি. হাই নিজের বাড়িতে যাওয়ার কথা বললে আরেকজনকে প্রশ্ন করতে শোনা যায় – ‘আমরা থাকতে পারছি?’
এ সময় একজনকে বলতে শোনা যায় – ‘বললে পুলিশ চলে আসবে।’
মি. হাইকে ঘিরে ধরা অন্য একজন বলেন- ‘গত দশ বছর যেখানে ছিলেন সেখানে চলে যান।’
আরেকজন বলেন- ‘উনি আর এই এলাকায় থাকতে পারবেন না’। আরেকজনকে বলতে শোনা যায়-‘একদম কুমিল্লার বাইরে’।
জানা যাচ্ছে ওই ঘটনার পরপরই মি. হাই এলাকা ছেড়ে গেছেন।
ভিডিওটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যাওয়ার পর অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা লাঞ্ছনার এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
আবার কেউ কেউ ফেসবুকে মি. হাইকে লাঞ্চনার পক্ষেও মন্তব্য করেছেন।
আবার কেউ লিখেছেন, ‘তিনি বেআইনি কিছু করলে তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ না নিয়ে কথিত মব জাস্টিস কেন?’
আব্দুল হাই যা বললেন
সোমবার দুপুরে বিবিসি বাংলার সাথে যখন মি. হাইয়ের কথা হয় তখন তিনি কোন একটি হাসপাতালে যাচ্ছিলেন চিকিৎসা নেয়ার জন্য।
মি. হাই বিবিসি বাংলার কাছে অভিযোগ করেছেন, তাকে যারা লাঞ্ছনা করেছে তারা সবাই ‘স্থানীয় জামায়াত শিবিরের লোকজন’।
তিনি জানান, রোববার দুপুরে ঔষধ কেনার জন্য বাড়ির বাইরে গেলে কয়েকজন এসে স্কুলের সামনে তাকে ঘিরে ধরে। এক পর্যায়ে জুতার মালা গলায় দিয়ে টেনে হিঁচড়ে তাকে সেখানকার শহীদ মিনারের সামনে নিয়ে যায়।
“তারা আমাকে টর্চার করেছে। আমাকে ছুঁড়ি ধরে গলায় জুতার মালা পড়িয়ে অসম্মান করেছে। অথচ জামায়াতের কারও সাথে আমার কোন শত্রুতা ছিলো না। জামায়াত নেতা তাহের সাহেবের সাথেও আমি জেল খেটেছি,” বলছিলেন তিনি।
মি. হাই জানিয়েছেন, তার ছেলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করেছিলো এবং এ নিয়ে বিরোধের জের ধরে তখনকার মন্ত্রী মুজিবুল হক তার (মি. হাইয়ের) বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ নয়টি মামলা দিয়ে তাদের পরিবারকে এলাকা ছাড়া করেছিলো।
এ ঘটনায় মামলা করেছেন কী-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মামলা করে কী হবে? সবাই তো দেখেছে ঘটনা। সরকার চাইলেই ব্যবস্থা নিতে পারে। এ অসম্মানের পর আমার আর বেঁচে থেকেই লাভ কী! এ দেশের জন্যই কি যুদ্ধ করেছিলাম।”
জামায়াতে ইসলামী কী বলছে
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির মাহফুজুর রহমান দাবি করেছেন, এ ঘটনার সাথে জামায়াতের কারও কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।
মি. রহমান বিবিসি বাংলার কাছে অভিযোগ করেছেন, “এটি ওই এলাকার ইস্যু, সেখানকার প্রতিটি পরিবারের সাথে তার (মি. হাইয়ের) ঝামেলা আছে। আওয়ামী লীগের লোকেরাও আগে তার বাড়িঘর ভেঙ্গেছে। তাকে মেরেছে। এখন সম্ভবত তার আশেপাশের যারা থাকে তারাই ক্ষোভ থেকে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।”
মি. রহমান মনে করেন, এটা নিতান্তই ‘পারিবারিক ও সামাজিক’ সমস্যা, এবং এটি রাজনৈতিক বিষয় নয়।
প্রশাসন ও পুলিশ কী বলছে
কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ নাজির আহমেদ খাঁন বলছেন, ঘটনাটি ইতোমধ্যেই তাদের নজরে এসেছে এবং এর সাথে জড়িত সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আটক করতে অভিযান চলছে।
“আমরা চেষ্টা করছি। স্থানীয় থানা পুলিশ জড়িতদের আটক করার চেষ্টা করছে। আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এর মোটিভ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবো আশা করছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
আর চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ জানিয়েছেন লাঞ্ছনার শিকার মুক্তিযোদ্ধার সাথে তার কথা হয়েছে।
“ওনার বিরুদ্ধে কারও কোন অভিযোগ থাকলে সেটা নিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ ছিলো। তা না করে যেটি করা হয়েছে সেটি যে কোন মানুষের জন্যই অসম্মানজনক। আরও মুক্তিযোদ্ধারা এসেছেন। আমরা কথা বলেছি। আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।
এর আগে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাইকে অবমাননার তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে।