Source : BBC NEWS

প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় দুদক সংস্কার কমিশন

ছবির উৎস, CA PRESS WING

দুর্নীতি দমন কমিশনকে দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব থেকে মুক্ত করার দিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারকে ৪৭ টি সুপারিশ করার কথা জানিয়েছে এ সংক্রান্ত সংস্কার কমিশন।

বুধবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর এ কথা জানান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান।

প্রতিবেদনে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তনের সুপারিশ রাখা হয়েছে।

কমিশনারদের সংখ্যা তিনজন থেকে বাড়িয়ে পাঁচজন এবং দুদককে বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পরামর্শও দিয়েছেন তারা।

তবে, ব্যাপক পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে চেয়ারম্যান, কমিশনার থেকে শুরু করে কর্মকর্তা নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। যা দুদকের দীর্ঘদিনের রেয়াজ পাল্টে দিতে পারে।

কী প্রক্রিয়ায় সেটি করা যেতে পারে বিবিসি বাংলাকে সে ব্যাপারে জানিয়েছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, দুদকের সমস্যা চিহ্নিত করা, সেগুলো থেকে উত্তরণের উপায় এবং উপায়সমূহ বাস্তবায়নের পথরেখা – এই তিন ধাপে প্রতিবেদনটি সাজিয়েছেন তারা।

আরো পড়তে পারেন:

দুদকের সংকট

দুর্নীতি দমন কমিশনের কয়েকটি সংকটের দিক চিহ্নিত করেছেন সংস্কার কমিশনের সদস্যরা।

প্রথমত, নিয়োগ প্রক্রিয়ার কথা বলছেন তারা।

“দুদকের সর্বোচ্চ পর্যায়ে চেয়ারম্যান অথবা কমিশনার হিসেবে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত হন তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব থাকে,” বলেন মি. ইফতেখারুজ্জামান।

“এতে তারা দলীয়ভাবে প্রভাবান্বিত হন এবং সেই কারণে তাদের এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্যতা থাকে না,” যোগ করেন তিনি।

দ্বিতীয়ত, কমিশনারদের নিচের ধাপের পদগুলোতে আমলাতন্ত্রের একচেটিয়া প্রভাব দেখা যায়।

“তার মধ্যেও আবার আমলাতন্ত্রের একটি ক্ষেত্র থেকে অর্থাৎ, প্রশাসনিক ক্ষেত্র থেকে বেশি দেখা যায়,” বলেন সংস্কার কমিশন প্রধান।

একদিকে দলীয় রাজনীতির প্রভাব অন্যদিকে আমলাতন্ত্রের ‘দ্বিমুখী চক্রের হাতে দুদক জিম্মিদশার মধ্যে নিমজ্জিত হয়’ বলে অভিমত তার।

তৃতীয়ত, কমিশনের পর্যবেক্ষণ দুদক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেই ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত।

তাদের দৃষ্টিতে, এখানকার সার্বিক জনবল পর্যাপ্ত নয়, দক্ষতা-যোগ্যতার ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে। তার ওপরে আছে প্রেষণে আসা কর্মকর্তা এবং সরাসরি নিযুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যকার বৈষম্য ও দ্বন্দ্ব।

এছাড়া, জবাবদিহিতার ঘাটতি, বিধি-বিধানের পরিবর্তনের ফলে ক্ষমতার খর্ব করা, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অসহযোগিতার কথাও সংস্কার কমিশনের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।

বিবিসি বাংলার খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল অনুসরণ করুন।

দুদক কর্মকর্তারা একটি অভিযানে

কাঠামো পরিবর্তন, ৫৪ এর দুই ধারা বাতিল

কমিশনের কাঠামোতে যে পরিবর্তনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে, তাতে কমিশনার সংখ্যা তিন থেকে বাড়িয়ে ন্যূনতম একজন নারীসহ পাঁচজন করার কথা বলা হয়েছে।

প্রস্তাব আছে কমিশনের মেয়াদ সম্পর্কেও।

২০০৪ সালে দুদক আইন প্রণয়নের সময় মেয়াদ চার বছর করা হলেও ২০১৩ সালে সংশোধন করে পাঁচ বছর করা হয়েছিল।

সেখান থেকে কমিয়ে আবার চার বছর করার সুপারিশ করা হয়েছে।

দুদক বিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংস্কার কমিশন চায় দুদককে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হোক।

এছাড়া, দুর্নীতি দমন কমিশন চাকুরী বিধিমালার ৫৪ এর দুই ধারা বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, “এই বিধিমালায় ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কোন কারণ না দর্শাইয়া কোন কর্মচারীকে নব্বই দিনের নোটিশ প্রদান করিয়া অথবা নব্বই দিনের বেতন নগদ পরিশোধ করিয়া তাহাকে চাকুরী হইতে অপসারণ করিতে পারিবে।”

এই ধারার ক্ষমতাবলে ২০২২ সালে মো. শরীফ উদ্দিন নামে একজন উপসহকারী পরিচালককে চাকরি থেকে অপসারণ করা হলে তা ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল।

আরো পড়তে পারেন:

নিয়োগে নতুন বিধানের সুপারিশ

দুদকের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মকর্তা পর্যন্ত নিয়োগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

কমিশনারদের যোগ্যতার ক্ষেত্রে বর্তমানে আইন পেশা, শিক্ষা, প্রশাসন, বিচার বিভাগ বা শৃঙ্খলা বাহিনীতে ন্যূনতম ২০ বছরের অভিজ্ঞতার কথা বলা আছে।

সংস্কার কমিশনের সুপারিশে অধিকতর মানদণ্ড হিসেবে এগুলোর পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজের দক্ষতা, অডিট-অ্যাকাউন্টস বা হিসাব-নিরীক্ষা পেশায় দক্ষতা এবং দুর্নীতি বিরোধী কাজ ও সুশাসনের দক্ষতার মত বিষয়কে চিহ্নিত করতে হবে।

“আর্থিক ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইমটা এখন ক্রমাগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং সফিস্টিকেটেড সেখানে এ ধরনের দক্ষতা থাকা জরুরি,” বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

একইসঙ্গে, ২০ বছরের অভিজ্ঞতার বদলে ন্যূনতম ১৫ বছরে অভিজ্ঞতা অন্তর্ভূক্ত করতে বলেছেন তারা।

কমিশনারদের নিয়োগের ক্ষেত্রে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার সুপারিশ করেছে কমিশন।

বিবিসি বাংলার আরো খবর:
প্রতীকী ছবি

ছবির উৎস, Getty Images

তাদের নিয়োগের জন্য একটি বাছাই কমিটি বা সার্চ কমিটি গঠন করা হবে।

বাছাই কমিটির বিন্যাসে পরিবর্তন আনতে চায় সংস্কার কমিশন।

বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতিকে সভাপতি এবং হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান, মহা হিসাব নিরীক্ষক, ও সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে সদস্য করে বাছাই কমিটি গঠনের বিধান রয়েছে।

সুপারিশ অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতির পরে সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি হবেন এটার চেয়ারম্যান।

হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি, মহা হিসাব নিরীক্ষক, ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের পাশাপাশি সংসদ নেতা ও বিরোধী দলীয় নেতার তরফে একজন করে মনোনীত প্রতিনিধি সদস্য হবেন।

এছাড়া, প্রধান বিচারপতি মনোনীত নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধিও রাখা হবে, যিনি দুর্নীতিবিরোধী এবং সুশাসনের কাজের সাথে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন।

“এই সাতজনকে নিয়ে সার্চ কমিটি হবে। ফলে এটি বর্তমান ব্যবস্থার চেয়ে বিস্তৃত ও স্বচ্ছ হবে,” বলছিলেন সংস্কার কমিশন প্রধান ইফতেখারুজ্জামান।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা প্রস্তাব করেছি যে বাছাই কমিটি যখন দায়িত্ব নেবে একদিকে ওপেন অ্যাডভার্টাইজমেন্ট (উন্মুক্ত বিজ্ঞাপন) মাধ্যমে প্রার্থিতা আবেদন আহ্বান করবেন। হেড হান্ট (নেতৃত্ব বাছাই) করতে পারবেন। কিংবা কেউ চাইলে মনোনয়ন দিতে পারবেন।”

পরবর্তীতে প্রার্থীদের প্রত্যেককে ইন্টারভিউতে ডাকা হবে।

“আমরা আশা করছি এইভাবে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া সম্ভব হবে,” যোগ করেন মি. ইফতেখারুজ্জামান।

দুদক ভবন

‘বিশেষ পেশার প্রাধান্য থাকবে না’

সচিব থেকে শুরু করে অধস্তন কর্মকর্তা পর্যায়েও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিয়োগের প্রস্তাব করার কথা বলছে সংস্কার কমিশন।

“সেটার মধ্যে অবশ্যই সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে প্রার্থী থাকতে পারেন, মনোনীত হতে পারেন, আবেদনও করতে পারেন কিন্তু সেটি হবে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এটা নিশ্চিত করতে হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন কমিশন প্রধান।

“সচিবের পরের দিকের পদগুলোতে একটা ভেস্টেড গ্রুপ (স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী) হয়ে গেছে, আমরা যেভাবে সুপারিশ করেছি সেইখানে কোনো একটা বিশেষ শ্রেণির বা বিশেষ পেশার প্রাধান্য থাকবে না। প্রেষণে যারা আসবেন তাদের একটা সুনির্দিষ্ট সর্বোচ্চ কোটা নির্ধারণ করে দেয়ার প্রস্তাব করছি আমরা,” যোগ করেন মি. ইফতেখারুজ্জামান।

দুদককে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি থেকে মুক্ত করতে বিশেষ ধরনের সাঁড়াশি অভিযানের প্রস্তাবও করেছে সংস্কার কমিশন।

“এ অভিযানের মাধ্যমে দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি জন্য যারা দায়ী তাদেরকে চিহ্নিত করে বহিষ্কার করতে হবে,” বলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

শুধু বহিষ্কার নয়, আইনগতভাবে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিশ্চিত করার সুপারিশও করা হয়েছে প্রতিবেদনে।