Source : BBC NEWS
বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলা দিয়ে বয়ে যাওয়া মনু নদীর একটি বাঁধ সংস্কার করা হচ্ছে, যা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। শুক্রবার ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে মনু নদীর বাঁধ এলাকা পরিদর্শন করেছেন উনকোটি জেলার জেলাশাসক।
জেলাশাসক বলেছেন যে তিনি দেখে এসেছেন বাংলাদেশের তরফে মনু নদী বরাবর সীমান্তের জিরো-লাইনের কাছে মাটি ফেলা হয়েছে বাঁধ উঁচু করার জন্য। তবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তরফে বিবিসি বাংলাকে জানানো হয়েছে, তারা শুধু বাংলাদেশের অংশে বাঁধ সংস্কারের কাজ করেছেন।
এই বিষয়টি দিন তিনেক আগে ত্রিপুরার বিধানসভায় তুলেছিলেন সীমান্ত সংলগ্ন কৈলাসহর থেকে নির্বাচিত বিধানসভা সদস্য বীরজিত সিনহা। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন বাংলাদেশ তাদের অংশে মনু নদীর বাঁধ সংস্কার এবং উচ্চতা বাড়ানোর কাজ চালাচ্ছে এবং এর ফলে তার এলাকায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দেবে।
বিধানসভায় মনু নদীর বাঁধ সংস্কারের বিষয়টি উত্থাপন করার পরেই ওই অঞ্চল পরিদর্শন করলেন জেলাশাসক সহ কর্মকর্তারা।
মি. সিনহা এও উল্লেখ করেছিলেন যে ওই মনু নদীতেই ভারতের দিকে যে বাঁধ আছে, সেটি সংস্কারের অভাবে ধুঁকছে।
এই বাঁধ দুটি অবশ্য নদীর মাঝ বরাবর যে ড্যাম বা ব্যারাজ বানানো হয়, সেরকম নয়, নদী-পাড়ের ভাঙ্গন আটকাতে দেওয়া হয়েছে এই বাঁধ।
তার এলাকার মানুষকে জলমগ্নতা থেকে বাঁচাতে সরকারের সহায়তা চাইছেন কংগ্রেস দলের এই বিধায়ক ও প্রাক্তন মন্ত্রী।
বাংলাদেশের মৌলভীবাজারের পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী অবশ্য বিবিসিকে এও জানিয়েছেন যে তাদের অংশের বাঁধ সংস্কার এবং উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে কৈলাশহর ডুবে যাবে, এই আশঙ্কা অমূলক।
এলাকা ঘুরে যা জানালেন জেলাশাসক
শুক্রবার মনু নদীর বাঁধ অঞ্চল ঘুরে দেখেন উনকোটি জেলার জেলাশাসক দিলীপ কুমার চাকমা।
তার সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও গিয়েছিলেন নদী-বাঁধের কাছে।
ওই পরিদর্শনের পরে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ তাদের অংশে একটা এম্ব্যাঙ্কমেন্ট বানিয়েছে ফ্লাড প্রোটেকশনের জন্য। সেটাই সরেজমিনে দেখার জন্য আমরা আজ এসেছিলাম। যেটা দেখলাম যে পুরনো যেটা ছিল এম্বব্যাঙ্কমেন্ট, সেটা অনেকটা উঁচু করেছে। এর ফলে আগামী দিনে, আমার মনে হচ্ছে, জলটা আমাদের দিকে বেশি আসবে।”
“এদিকে আমাদের দিকে যে এম্বব্যাঙ্কমেন্ট আছে, সেটাও মজবুত করা দরকার,” বলেছেন মি. চাকমা।
বাংলাদেশ তাদের দিকের নদী-বাঁধ সীমান্তের জিরো-লাইনে ‘কনস্ট্রাকশন’ করেছে বলেও মন্তব্য করেন জেলা শাসক।
তার কথায়, “আমি বলব এটা উচ্চপর্যায়ে যেন টেক আপ করা হয়, যেহেতু জিরো লাইনে ওরা কনস্ট্রাকশন করেছে। আমাদের দিকে যে নদী বাঁধ, সেটা ১৫০ গজেরও বেশি আছে, বাট ওদেরটা একেবারে জিরো লাইনে বলা যেতে পারে।”
তিনি জানান যে বাঁধ সংস্কার করার আগে কোনও পর্যায়েই কোনও বৈঠক হয়েছিল বলে তার বিগত ১১ মাসের কর্মকালে তিনি জানেন না।
কী বলছেন ত্রিপুরার বিধায়ক?
ত্রিপুরার কৈলাশহর এবং বাংলাদেশের মৌলভীবাজার দিয়ে প্রবাহিত মনু নদীর বাঁধের বিষয়টি ত্রিপুরা বিধানসভায় উত্থাপন করেন কৈলাশহরের বিধায়ক বীরজিত সিনহা। পরে তিনি কথা বলেছেন বিবিসি বাংলার সঙ্গে।
তিনি বলেন, “মনু নদীতে আমাদের অংশেও বাঁধ আছে আবার বাংলাদেশের দিকেও তারা বাঁধ দিয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের অংশে তারা বাঁধ উঁচু করার কাজ করছে।
“এদিকে আমাদের অংশে যে বাঁধ, সেটা প্রায় ৪০ বছরের পুরনো। বহু বার সরকারের কাছে আবেদন করেছি বাঁধ সংস্কার করা হোক। স্লুইস গেটগুলির অবস্থা জরাজীর্ণ। আমি যখন মন্ত্রী ছিলাম, তখন সাত কিলোমিটার জমিও অধিগ্রহণ করে রাখা আছে। কিন্তু বাঁধ সংস্কার হয় নি,” বলছিলেন মি. সিনহা।
তার কথায়, “এই অবস্থায় বাংলাদেশ যখন তাদের দিকের বাঁধ উঁচু করছে, এরপরে আমার বিধানসভা এলাকা কৈলাশহর জলে ডুবে যাবে। আমার আশঙ্কা আগামী বর্ষাতেই জলের তলায় থাকতে হবে সেখানকার মানুষকে।”
কংগ্রেস বিধায়কের কথায় সমর্থন বিজেপির মন্ত্রীর
বীরজিত সিনহা যে কৈলাশহর কেন্দ্রের বিধায়ক, তার লাগোয়া ফটিকরায় কেন্দ্রের বিধায়ক সুধাংশু দাস রাজ্যের মন্ত্রী।
বিধানসভায় কংগ্রেস দলের বিধায়ক মি. সিনহা মনু নদীর বাঁধের বিষয়টি উল্লেখ করার পরে পার্শ্ববর্তী কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক ও মন্ত্রী মি. দাসও এ ব্যাপারে সহমত পোষণ করেন বলে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা পিটিআই।
সুধাংশু দাস বিধানসভায় বলেছেন যে একই উনকোটি জেলার প্রতিনিধি হিসাবে ওই সমস্যার সমাধানে দ্রুত বিবেচনা করা দরকার। বাংলাদেশে বাঁধ উঁচু করার ফলে কৈলাশহরে ভয়াবহ বন্যা হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনিও।
দুই বিধায়কের কথার জবাবে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহাকে উদ্ধৃত করে সংবাদসংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, “এটি একটি আন্তর্জাতিক বিষয়। নদী-বাঁধ সংস্কারের বিষয়ে আমি ইতিমধ্যেই ছবি সহ বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠিয়েছি দিল্লিতে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আমি আবারও বিষয়টি উত্থাপন করব।”
যা বলছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড
ত্রিপুরার বিধায়ক ও মন্ত্রীর উদ্বেগ নিয়ে বিবিসি বাংলা যোগাযোগ করেছিল বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহম্মদ খালেদ বিন অলীদ বিবিসিকে জানিয়েছেন যে ভারতের কৈলাশহর ডুবে যাবে, এমন আশঙ্কার কোনও কারণ নেই বলে তিনি মনে করেন।
তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন যে মনু নদীর বাঁধ সংস্কারের কাজ ‘চলমান রয়েছে’।
“বাঁধটি আগে থেকেই ছিল। কিছু জায়গায় উঁচু নিচু ছিল। ডিজাইন অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় একেক লেভেলে, যতটুকু দরকার ততটুকু করছি। আবার তিনটা পয়েন্টে উনাদের বাধার জন্য আমরা কাজ করতে পারছি না,” বলছিলেন মি. অলীদ।
তিনি আরও বলেন যে সীমান্ত এলাকা হওয়ায় বিএসএফ কয়েকটি জায়গায় তাদের বাঁধ সংস্কারের কাজ করার ব্যাপারে আপত্তি তুলেছে, সেই জায়গাগুলিতে তারা কাজ করতে পারেন নি।
“সীমান্ত অংশে কাজ বন্ধ রেখেছি আমরা। তবে যে জায়গাগুলিতে কাজ হচ্ছে, সেটা তো বাংলাদেশের অংশ,” জানিয়েছেন মি. অলীদ।
নদী ভাঙ্গন রোধে বাঁধ সংস্কার
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মি. অলীদ বলছিলেন মনু নদীতে যে বাঁধ রয়েছে, সেটা নদীর প্রবাহ আটকানোর জন্য নয়, নদীর ভাঙ্গন রোধ করার জন্য।
“এটাতো নদীর ভিতর দিয়ে বাঁধ নয়, নদী বরাবর বাঁধ। নদীর পানি যেন শহরে না ঢোকে, সেজন্য এই বাঁধ। ভারতের দিকেও তো বাঁধ আছে। আমাদের অংশটায় কার্ভ আছে, তাই আমাদের অংশটা ভাঙ্গছে। আমাদের ল্যান্ডটাকে রক্ষা করব না আমরা? বাড়ি ঘরও আছে। ওদের শহর ডোবার কোনও সম্ভাবনাই নেই, টেকনিক্যালি এই কথার কোনও ভিত্তি নেই,” বলছেন মি. অলীদ।
কৈলাশহর ডুবে যাবে, এমন আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দিয়ে মি. অলীদ বলেন, “কৈলাশহরের কিছুই হবে না। সেটা তো অনেক উঁচুতে। বরং সমস্যা হলে সেটা হবে আমাদের দিকে, আমরা তো ভাটিতে।”