Source : BBC NEWS
৭ মিনিট আগে
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় করা বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় প্রায় ২৫০ জন আসামিকে জামিন দিয়েছে আদালত। গত ১৬ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো এই আসামিরা জামিন পেলেন।
কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত বিশেষ আদালতের বিচারক মো. ইব্রাহিম মিয়া এ আদেশ ঘোষণার সময় বলেন, ” যখন কোথাও ইনজাস্টিস (অবিচার) হয়ে যায় তখন জাস্টিস (ন্যায়বিচার) রিস্টোর (পুনঃস্থাপন) করা ছাড়া অন্য কোন পথ নাই।”
পরে কারা এ জামিন পাবেন সে বিষয় ব্যাখ্যা করে আদেশ দেন।
আদেশের পরে এ মামলার চিফ প্রসিকিউটর মো. বোরহান উদ্দিন খান সাংবাদিকদের জানান, “এভাবে জামিনের আদেশটা হয়েছে- যারা আগে খালাসপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে রায় পরিবর্তন হয়েছে বা কারো বিরুদ্ধে আপিল পেন্ডিং আছে এবং বিস্ফোরক দ্রব্য মামলায় আলাদা ৩০ জনের মত আসামি শুধুই বিস্ফোরক দ্রব্য মামলার আসামী ছিলেন, তাদের ব্যতিরেকে অন্যান্য খালাসপ্রাপ্ত আসামীদের জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে”।
অর্থাৎ হত্যা মামলায় যেসব আসামিরা বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টে খালাস পেয়েছেন তাদের জামিন দিয়েছে আদালত।
বেশ কয়েকটি জামিন আবেদন নিষ্পত্তি করে এ আদেশ দিয়েছে আদালত।
তবে জামিনপ্রাপ্ত আসামির মোট সংখ্যা কত তা এখনো জানা যায় নি।
এ সংখ্যা আনুমানিক ২৫০ জন বলে জানিয়েছেন আসামিপক্ষের একজন আইনজীবী।
কেরানীগঞ্জের আদালতের চিত্র
গত সপ্তাহে কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় অবস্থিত অস্থায়ী আদালতে এই মামলার বিচার হবে জানিয়ে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে।
এর আগে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে অবস্থিত অস্থায়ী আদালতে এর বিচার কার্যক্রম হয়েছিল।
সকাল থেকেই বিডিআর সদস্যদের পরিবারের স্বজনরা কারাগারের প্রধান ফটকে ভিড় জমাতে শুরু করে।
এক পর্যায়ে তারা সেখানেই অবস্থান নিয়ে স্বজনদের জামিন, চাকরিতে পুনর্বহাল ও ঘটনার প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করার দাবি জানান।
এদিকে, সকাল দশটায় আদালতের এজলাসে সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেয়া হবে না বলে জানানো হয়।
তবে প্রায় দেড় ঘণ্টা পর সাংবাদিকদের আদালতের এজলাসে ঢুকতে দেয়া হয়।
সোয়া এগারটায় আদালতের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়।
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জামিন শুনানি করতে আবেদন করেন।
তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জামিন আবেদন শুনানির বিরোধিতা করে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আবেদন করেন।
এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, “একদিকে তদন্ত কমিশনের তদন্ত চলছে, আরেক দিকে সাক্ষ্য নেয়া হলে তা জাজমেন্টকে প্রভাবিত করবে। একদিকে বিচার চলে, আরেকদিকে যদি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং চলে তবে এটা কী হবে?”
মি. ইসলাম শুনানিতে আদালতকে বলেন, “এ মামলায় যেসব আসামিরা আগের মামলায় খালাসপ্রাপ্ত তাদের স্টেপ বাই স্টেপ জামিন আবেদন শুনানি করলে কৃতজ্ঞ থাকবো। “
তবে রাষ্ট্রপক্ষ আবারও সাক্ষ্য নেয়ার আবেদন করে বলেন, “এ মামলার গত কয়েকটা শুনানির দিনে সাক্ষী উপস্থাপন করতে পারি নাই। এখন সাক্ষ্য শুনানি করতে চাই। আমরা সরকারকে না স্টেটকে প্রতিনিধিত্ব করছি”।
তবে একপর্যায়ে যেহেতু আজ রোববার এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের দিন নির্ধারিত ছিল, তাই সাক্ষ্য গ্রহণে ঐক্যমত্যে পৌঁছান উভয়পক্ষের আইনজীবীরা।
পরে সাক্ষ্য গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হয়। এ মামলার ২৮৪ তম সাক্ষী মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) সৈয়দ মো. ইউসুফ ইকবালের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে তাকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী।
জামিন নিয়ে যুক্তি-পাল্টা যুক্তি
সাক্ষীর জেরা শেষ করার পরে অন্তত চারশ আসামির জামিন আবেদনের কথা আদালতকে জানান মি.ইসলাম।
শুনানিতে আসামিদের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, “২৭৭ জন হাইকোর্ট পর্যন্ত খালাস পেয়েছেন। অনেক আসামি মারাও গেছেন, অনেক বয়স বেশি অনেকে হাঁটতেও পারেন না। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবেন।”
যারা খালাস পেয়েছেন এবং যাদের দশ বছরের সাজা ভোগ করা হয়ে গেছে তাদের এ মামলায় জামিন দিতে আবেদন করেন মি. ইসলাম।
এ সময় জামিনের বিরোধিতা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো. বোরহান উদ্দিন খান।
তিনি আদালতে বলেন, “মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির পক্ষেও জামিনের আবেদন করা হয়েছে। এগুলো যাচাই না করে দেয়া যাবে না। যাচাই না করে জামিন দেয়া কঠিন”।
একইসাথে জামিনের যুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মি. খান।
” অসুস্থতা, বেশি বয়স, এগুলো জামিনের পক্ষে লিখিত আবেদনে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়নি। শুধু বলা হইছে আগের মামলায় খালাস পেয়েছে এটাই যুক্তি দেয়া হয়েছে। যে মামলায় মৃত্যুদণ্ডের মতো দণ্ড আছে সেখানে জামিনের বিরোধিতা করি” বলেন রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী।
পাল্টা যুক্তি তুলে ধরে আসামিপক্ষের আইনজীবী মি. ইসলাম বলেন, “কারো কাছ থেকে অস্ত্র পাওয়া যায় নি, অথবা বিস্ফোরণ ঘটাইছে। মেরিটে গেলে ১৬ বছর জেলে আছি খালাস পাইনি”।
জামিন আবেদনের শুনানি শেষে এক ঘণ্টার বিরতি দেয় আদালত।
পরে বেলা তিনটায় আবার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। এ সময় আদেশ ঘোষণা করে আদালত।
এ ঘটনায় হওয়া হত্যা মামলায় যেসব আসামিরা বিচারিক আদালত এবং হাইকোর্ট দুই আদালতেই খালাস পেয়েছেন এবং যাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আর কোন আপিল নেই তাদের জামিন দেয়া হয়েছে।
জামিনের আদেশ দেয়ার সময় বিচারক মো. ইব্রাহিম মিয়া বলেন, “যখন কোথাও ইনজাস্টিস (অবিচার) হয়ে যায় তখন জাস্টিস ন্যায়বিচার রিস্টোর করা ছাড়া অন্য কোন পথ নাই”।
পরে তিনি জানান যারা হত্যা মামলায় খালাস পেয়েছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অন্য কোন পদক্ষেপ নেই তাদের জামিনের বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে।
আদেশের পর আসামিপক্ষের আইনজীবী মি. ইসলাম সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, “গত ১৬ বছরে প্রথমবারের মতো এ মামলায় জামিন পেলেন আসামিরা। এ মামলাতে অধিকাংশ মানুষ ভবিষ্যতে নির্দোষ প্রমাণিত হবে এ প্রত্যাশা করি”।
একইসাথে তদন্ত চলাকালীন সময়ে এ মামলার বিচার কাজ চলবে বলে যে প্রজ্ঞাপনে যে বিধান দেয়া হয়েছে এটিতে আপত্তি জানিয়ে প্রজ্ঞাপন সংশোধনের দাবি জানান মি. ইসলাম।
জামিনপ্রাপ্ত আসামি কতজন সে বিষয়ে মি. ইসলাম জানিয়েছেন, ” হত্যা মামলার মধ্যে ২৭৭ জন আসামি নির্দোষ প্রমাণ হয়ে খালাসপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ২৫৬ জনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয় নাই, তাদের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র ১০ বছরের সাজা দেয়া হয়েছিল ৩৮০ ধারায়। এই ২৭৭ ও ২৫৬ জনের মধ্যে ৩০ জন আসামির বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ হাইকোর্টে আপিল ফাইল করেছিল”।
” সেখানে ১৯ জনের বিরুদ্ধে নতুন করে সাজা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২৭৭ জন যারা খালাসপ্রাপ্ত হয়েছিল এখন প্রায় ২৫০ জনের বেশি মানুষ তারা নিচের কোর্ট ও হাইকোর্ট মিলিয়ে খালাসপ্রাপ্ত আছেন। যে ২৫৬ জন যাদের ১০ বছরের সাজা তাদের ইতোমধ্যে সার্ভড আউট হয়ে গেছে। যার কারণে আর কোন সাজা বিদ্যমান নাই। ফলে টোটাল পাঁচশয়ের উপরে আসামি জামিনের হকদার ছিল। আমরা সবার পক্ষেই জামিনের আবেদন করেছিলাম, ” বলেন মি. ইসলাম।
“সবকিছু বিশ্লেষণ করে, হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত থেকে যারা খালাস পেয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে সরকার কোন আপিল করেনি তাদের সংখ্যা প্রায় ২৫০ জন। তাদেরকে আদালত জামিনে মুক্তি দিয়েছেন” বলেন মি. ইসলাম।
যাচাই বাছাই ও তথ্য মিলিয়ে দেখতে সময় লাগার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী দুই দিন পর তারা মুক্তি পেতে পারেন।
একই সাথে যাদের দশ বছর মেয়াদের সাজা খাটা শেষ হয়েছে তাদেরও জামিনের আবেদন করা হয়েছিল।
তবে এই ক্যাটাগরির আসামিদের বিষয়ে এখন আপাতত কোন সিদ্ধান্ত নয় বলে জানিয়েছে আদালত।
এ মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণ ১০ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে।
স্বজনদের প্রতিক্রিয়া
জামিনের আদেশের পরে কান্নায় ভেঙে পড়েন বিডিআর সদস্যদের স্বজনরা। দীর্ঘ ১৬ বছর পর জামিনে মুক্ত হতে যাচ্ছেন তারা।
“আমরা ১৬ বছর ধরে কষ্ট করতেছি। ১৬ বছর ধরে এইরকম একটা দিন দেখার জন্য আমরা অপেক্ষা করতেছিলাম” জামিনের আদেশ শোনার পর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এ কথা বলেন একজন বিডিআর সৈনিকের মেয়ে বিথী আক্তার।
মিজ আক্তার বলেন, ” আজকে আমাদের জয় হইছে, আজকে সত্যের জয় হইছে। আমার বাবা যে নির্দোষ ছিল, আমার বাবা যে কোন দোষ করে নাই। তারই প্রমাণ হইছে আজকে।”
“এরকম একটা রায় হবে অপেক্ষা করতেছিলাম আমরা। এরকম একটা রায় চাই যে আমাদের বিদ্রোহীর তকমা উঠে যাবে” বলেন মিজ আক্তার।
প্রকৃত দোষীদের বিচার দাবি করেন তিনি।
বিডিআর সদস্যদের স্বজনরা সকাল থেকেই এজলাসের বাইরে জামিন হবে কিনা সে বিষয় জানতে উৎসুক হয়ে উপস্থিত ছিলেন।
একই সাথে পুনরায় চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি জানান তারা।
২০০৯ সালে পিলখানায় ফয়সাল বালা যখন সৈনিক হিসেবে কাজ করেন তখন তার চাকরির বয়স মাত্র ১৬ দিন।
অথচ বিদ্রোহের ঘটনার পর গত ১৬ বছর কারাগারে কাটাতে হয়েছে তাকে।
অবশেষে জামিন পেলেন তিনি।
তার বোন সুমাইয়া আক্তার সুমি বলেন, ” ১৬ দিন ছিল তার চাকরির বয়স। তার জীবনের মূল্য কে দিবে? প্রকৃত খুনীদের বিচার চাই।”