Source : BBC NEWS

বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অটল বিহারী বাজপেয়ী

ছবির উৎস, Getty Images

ভারতের জরুরী অবস্থার পরে ইন্দিরা গান্ধীকে পরাজিত করে ক্ষমতায় এসেছিল জনতা পার্টির সরকার। ওই দলেই ছিলেন তখনকার প্রধান হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল জনসংঘের নেতা কর্মীরাও। জনসংঘের অনেকে আবার হিন্দু পুণরুত্থানবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসেরও সদস্য ছিলেন।

জনতা পার্টিতে দ্বৈত সদস্যপদ রাখা যেত। তবে জনতা পার্টি সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী জগজীবন রাম ১৯৮০ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করেন যে তিনি দ্বৈত সদস্যপদের বিষয়টি নিয়ে শেষ দেকে ছাড়বেন।

জনতা পার্টি এবং আরএসএস – একসঙ্গে দুটিরই সদস্যপদ রাখা নিয়ে অনেক নেতারই তীব্র আপত্তি ছিল।

চৌঠা এপ্রিল জনতা পার্টির কার্যনির্বাহী কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় যে জনসংঘের লোকেরা যদি আরএসএস ত্যাগ না করেন, তাহলে তাদের জনতা পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হবে। জনতা পার্টির মধ্যে থাকা জনসংঘের সদস্যরা আগেই আঁচ করেছিলেন যে এরকম একটা সিদ্ধান্ত হয়তো নেওয়া হবে।

কিংশুক নাগ তাঁর বই ‘দ্য স্যাফরন টাইড, দ্য রাইজ অফ দ্য বিজেপি’-তে লিখেছেন, “১৯৮০ সালের পাঁচ ও ছয় এপ্রিল জনতা পার্টির মধ্যে থাকা জনসংঘ গোষ্ঠী দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়ামে একটি সভা করে। ওই সভায় প্রায় তিন হাজার সদস্য অংশ নিয়েছিলেন এবং ওই সভা থেকেই ভারতীয় জনতা পার্টি গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল।

অটল বিহারী বাজপেয়ীকে দলের সভাপতি করা হয় এবং সুরজ ভান ও সিকান্দার বখতের সঙ্গে লালকৃষ্ণ আডবাণীকে দলের সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

১৯৮০ সালের নির্বাচনে জনতা পার্টি মাত্র ৩১টি আসন জিতেছিল, যার মধ্যে জনসংঘের সদস্যরাই ছিলেন ১৬ জন।

রাজ্যসভার ১৪ জন সংসদ সদস্য, পাঁচ জন প্রাক্তন ক্যাবিনেট মন্ত্রী, আট জন প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী এবং ছয় জন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নতুন দলে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারা সকলেই দাবি করেছিলেন যে তারাই আসল জনতা পার্টি।

বিবিসি বাংলায় আরও পড়তে পারেন
বিজেপির প্রথম তিনজন সাধারণ সম্পাদকের অন্যতম লালকৃষ্ণ আডবাণী

ছবির উৎস, Getty Images

‘পদ্ম’ প্রতীক যেভাবে পেল বিজেপি

জনসংঘের সঙ্গে যুক্ত নেতারা তারাই আসল জনতা পার্টি বলে যে দাবি করেছিলেন, তাকে চ্যালেঞ্জ করেন জনতা পার্টির সভাপতি চন্দ্রশেখর। তবে গোড়ায় নির্বাচন কমিশন চন্দ্রশেখরের দাবিকে মানতে চায় নি।

নির্বাচন কমিশন ভারতীয় জনতা পার্টিকে সরাসরি জাতীয় দলের মর্যাদা দেয় এবং জনতা পার্টির নির্বাচনী প্রতীক ‘হলধর কৃষক’ কিছুদিনের জন্য স্থগিত করে। ভারতীয় জনতা পার্টিকে নির্বাচনি প্রতীক হিসাবে দেওয়া হয় ‘পদ্ম’।

তবে ভারতীয় জনতা পার্টি নির্বাচনি প্রতীক হিসাবে ‘চক্র’ ও ‘হাতি’ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল, যদিও নির্বাচন কমিশন সেই অনুরোধ মানে নি।

মি. চন্দ্রশেখর নির্বাচন কমিশনকে জনতা পার্টির নির্বাচনী প্রতীক স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়েছিলেন। প্রায় ছয় মাস পরে মি. চন্দ্রশেখরের অনুরোধ নির্বাচন কমিশন মেনে নিয়ে ‘হলধর কৃষক’ প্রতীকটির ওপরে জারি করা স্থগিতাদেশ তুলে নেয় কিন্তু ভারতীয় জনতা পার্টির জাতীয় দলের মর্যাদাটা থেকেই যায়।

জনতা পার্টির তৎকালীন সভাপতি ও পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর

ছবির উৎস, Getty Images

আরএসএসের নন, এমন নেতারাও দলে

বিজেপি গঠনের গোড়ার দিকে এমন নেতাদেরও রাখা হয়েছিল, যারা আরএসএসের সঙ্গে জড়িত নন।

নলিন মেহতা তাঁর বই ‘দ্য নিউ বিজেপি’-তে লিখেছেন, “বিজেপি প্রাক্তন আইনমন্ত্রী শান্তি ভূষণ, বিখ্যাত আইনজীবী রাম জেঠমালানি, সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি কেএস হেগড়ে এবং প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা সিকান্দার বখতকে শুধু যে স্বাগতই জানিয়েছিল তা নয়, ফিরোজ শাহ কোটলার ওই সভায় তাদের মঞ্চে বসিয়েছিল।ঘটনাচক্রে দলের গঠনতন্ত্রের খসড়া যে তিন সদস্যের কমিটি তৈরি করেছিল, সেই তিনজনের কমিটিতে এমন দুজন ছিলেন যারা আরএসএসের সদস্য নন।”

রাম জেঠমালানি দেশভাগের পরে উদ্বাস্তু হিসাবে পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশ থেকে ভারতে এসেছিলেন আর সিকান্দার বখত দিল্লিরই মুসলমান নেতা ছিলেন।

সিকান্দার বখতই মি. বাজপেয়ীর নাম দলের সভাপতি হিসাবে প্রস্তাব করেছিলেন এবং রাজস্থানের বিজেপি নেতা ভৈরোঁ সিং শেখাওয়াত তাকে সমর্থন করেছিলেন।

কিংশুক নাগের লেখা বই

ছবির উৎস, Rupa Publications

গান্ধীবাদী পথ কেন নিয়েছিল বিজেপি?

বিজেপির জন্মের আগে থেকেই নতুন দলের নাম কী হবে, তা নিয়ে বিতর্ক চলছিল। মি. বাজপেয়ী চেয়েছিলেন একটি নতুন আদর্শ নিয়ে গড়ে ওঠা দলের জন্য একটি নতুন নাম হোক।

বিজেপির আনুষ্ঠানিক তথ্য অনুযায়ী দলের প্রথম অধিবেশনে আসা ব্যক্তিদের যখন দলের নাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় তখন তিন হাজার সদস্যের মধ্যে মাত্র ছয় জন পুরনো জনসংঘের নামটিই রেখে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন।

শেষ পর্যন্ত দলের নাম ভারতীয় জনতা পার্টি রাখারই সিদ্ধান্ত হয়। মতাদর্শগতভাবে, দলটি ‘গান্ধীবাদী সমাজতন্ত্র’ গ্রহণ করেছিল কিন্তু প্রথম দিকে এই মতাদর্শ দলের মধ্যেই অনেকে সমর্থন করেন নি।

কিংশুক নাগ লিখেছেন, “বিজয়রাজে সিন্ধিয়ার নেতৃত্বে অনেক বিজেপি নেতাই ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি ব্যবহার করার ব্যাপারে শঙ্কিত ছিলেন কারণ এটা কমিউনিস্টদের সঙ্গে মতাদর্শগত নৈকট্যের ইঙ্গিত দেয়। আরএসএস আবার যে কোনও মূল্যেই তার থেকে দূরত্ব রাখতে চায়।

“আবার কেউ কেউ মনে করেছিলেন যে ‘গান্ধীবাদী সমাজতন্ত্র’-এর পথ নিলে সেটা কংগ্রেসের আদর্শ অবলম্বন করা হবে এবং নবগঠিত পার্টির বিরুদ্ধে নকল করার অভিযোগ উঠবে,” লিখেছেন কিংশুক নাগ।

এটাও মনে করা হয় যে আরএসএসের তৎকালীন প্রধান বালাসাহেব দেওরসও ‘গান্ধীবাদী সমাজতন্ত্র’-এর পথ গ্রহণের বিপক্ষে ছিলেন, তবে পরে তিনি এতে সম্মত হন।

কিংশুক নাগ লিখেছেন, “আরএসএসের লোকেরা মুসলমান সহ অ-হিন্দুদের দলে নেওয়ায় খুশি হন নি।তা সত্ত্বেও পার্টির মধ্যে একটা মতামত জোরালো ভাবেই ছিল যে জনসংঘের পুরনো নীতিমালা ভুলে গিয়ে নতুন করে শুরু করা হোক।

“সম্ভবত সেই কারণেই মঞ্চে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ও দীনদয়াল উপাধ্যায়ের ছবির সঙ্গেই জয়প্রকাশ নারায়ণের ছবিও ছিল,” লিখেছেন কিংশুক নাগ।

লালকৃষ্ণ আদবাণীর আত্মজীবনী

ছবির উৎস, Rupa Publications

মুম্বাইতে বসল দলের মহাধিবেশন

মুম্বাইতে, ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে দলের এক মহাধিবেশন আহ্বান করা হয়। ওই অধিবেশনে হাজার হাজার পার্টি সদস্য ছিলেন।

লালকৃষ্ণ আডবাণী তাঁর আত্মজীবনী ‘মাই কান্ট্রি, মাই লাইফ’-এ দাবি করেছেন, ততদিনে সারা দেশে ২৫ লক্ষ মানুষ ভারতীয় জনতা পার্টির সদস্য হয়ে গিয়েছেন। জনসংঘের সময়ে সর্বাধিক ১৬ লক্ষ সদস্য ছিলেন।

‘ইন্ডিয়া টুডে’ পত্রিকার ১৯৮১ সালের ৩১ জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বিজেপি কনভেনশন, ওল্ড ওয়াইন ইন নিউ বটল’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সাংবাদিক সুমিত মিত্র লিখেছিলেন, “বিজেপির মোট ৫৪,৬৩২ জন প্রতিনিধির ৭৩ শতাংশ এসেছেন মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ও বিহার – এই পাঁচ রাজ্য থেকে। বোম্বের বান্দ্রা রিক্লেমেশন এলাকায় এক অস্থায়ী শিবির বানানো হয়েছিল।”

ওই পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন শুরু হয়েছিল ২৮শে ডিসেম্বর।প্রায় ৪০ হাজার মানুষের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে সেদিন দুপুরের মধ্যেই ৪৪ হাজার প্রতিনিধি অনুষ্ঠান স্থলে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যার মধ্যে আরও মানুষ আসার কথা ছিল।

দলের সাধারণ সম্পাদক লালকৃষ্ণ আডবাণীকে অনুরোধ করতে হয় যাতে দলের সদস্যরা সম্ভব হলে সভাস্থলের বাইরেই খাওয়া-দাওয়া সেরে নেন।

বিজেপির গোড়ার দিকের নেতা সিকান্দার বখত

ছবির উৎস, Getty Images

প্রকাশ্য সভা যেভাবে হয়েছিল

অনুষ্ঠান স্থলের সর্বত্র নতুন দলীয় পতাকা টাঙ্গানো হয়েছিল। পতাকার এক-তৃতীয়াংশ সবুজ আর বাকি দুই-তৃতীয়াংশ গেরুয়া।

মহাধিবেশনের প্রথম দিন, ২৮ তারিখের সন্ধ্যায় ২৮ একর এলাকা জুড়ে থাকা শিবাজী পার্কে দলের একটি জনসভা ছিল, যেখানে সাধারণ মানুষও অংশ নিতে পেরেছিলেন।

বিনয় সীতাপতি তাঁর বই ‘যুগলবন্দী, দ্য বিজেপি বিফোর মোদী’-তে লিখেছেন, “সভাস্থল থেকে শিবাজী পার্ক পর্যন্ত চার কিলোমিটার পথ একটি খোলা জিপে চেপে গিয়েছিলেন দলের নতুন সভাপতি অটল বিহারী বাজপেয়ী। মারাঠি সৈনিকের পোশাক পরা এক ব্যক্তি ঘোড়ায় চড়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং স্থানীয় জনগণের ভাবনাকে মূর্ত করে তুলেছিলেন। তাঁর পিছনে ছিল ট্রাকের বহর। ওই ট্রাকগুলিতে দীনদয়াল উপাধ্যায় এবং জয়প্রকাশ নারায়ণের ছবি ছিল।”

সেখানে হাজির ছিলেন আরএসএস প্রধান বালাসাহেব দেওরসের ভাই ভাউরাও দেওরসও। সভায় উপস্থিত আরএসএস নেতা শেষাদ্রি চারী স্বীকার করেছিলেন যে তার পক্ষে জয়প্রকাশ নারায়ণের ‘গান্ধীবাদী সমাজতন্ত্র’-এর নীতিটা মেনে নিতে তার সমস্যা হচ্ছিল।

পরবর্তীকালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রধান হয়েছিলেন যে প্রবীণ তোগাড়িয়া, তিনি একটি সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, “বিজেপির বেশিরভাগ সদস্যই গান্ধীবাদী সমাজতন্ত্রের মতাদর্শ গ্রহণ এবং দলের পতাকা পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত ছিলেন না। আমি এটা জানতাম কারণ আমি তখন একজন স্বয়ংসেবক ছিলাম। এই মতবিরোধ সর্বত্রই ছিল, তবে তা সামনে আসতে দেওয়া হয় নি।”

গোয়ালিয়রের  রাজমাতা বিজয়রাজে সিন্ধিয়া

ছবির উৎস, Getty Images

বিজয়রাজে সিন্ধিয়ার তীব্র বিরোধিতা

গোয়ালিয়রের প্রাক্তন রাজমাতা ও বিজেপির প্রবীণ নেত্রী বিজয়রাজে সিন্ধিয়া দলের নতুন আদর্শের বিরোধিতা গোপন রাখেন নি। তাঁর মত ছিল, ইন্দিরা গান্ধীর সমাজতন্ত্রই গোয়ালিয়রের মতো দেশীয় রাজপরিবারগুলির ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল।

নিজের প্রতিবাদের ব্যাখ্যা করতে তিনি দলের মহাধিবেশনের প্রতিনিধিদের মধ্যে পাঁচ পাতার একটা প্রতিবাদ-পত্র বিলি করিয়ে ছিলেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন যে ‘গান্ধীবাদী সমাজতন্ত্র’ -এর মতাদর্শ বিজেপির সাধারণ কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করবে কারণ এই স্লোগানটি শুধুই প্রগতিশীল হিসাবে তুলে ধরার জন্য আনা হয়েছে।এই স্লোগান আসলে বিজেপিকে কংগ্রেসেরই একটা ফটোকপিতে পরিণত করবে, দলের মৌলিকত্বকে নষ্ট হয়ে যাবে।

পরবর্তীকালে তিনি তাঁর ‘রয়্যাল টু পাবলিক লাইফ’ বইয়ে লিখেছিলেন, “আমি এই পরিবর্তনের বিরোধিতা তুলে ধরেছিলাম, কিন্তু তা সত্ত্বেও বোম্বাই (এখনকার মুম্বাই) সম্মেলনে তা পার্টির পথপ্রদর্শক নীতি হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। দলের অনেক নেতা মনে করেছিলেন, জনতা পার্টি থেকে বেরিয়ে আসার পর আর ‘গান্ধীবাদী সমাজতন্ত্র’-এর পথ অবলম্বন করার প্রয়োজন নেই।”

ক্রিস্টোফার জেফরলেট তাঁর ‘দ্য হিন্দু ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট অ্যান্ড ইন্ডিয়ান পলিটিক্স’ বইয়ে লিখেছেন, “অবশেষে একটি মধ্যপন্থা খুঁজে পাওয়া গেল এবং রাজমাতাকে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ প্রত্যাহার করাতে রাজি করানো হল। তিনি সাংবাদিক বৈঠকে ঘোষণা করেন, দলের সিনিয়র নেতারা তাঁকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, বিজেপির সমাজতন্ত্র মার্ক্সের সমাজতন্ত্রের একেবারেই বিপরীত।”

মি. বাজপেয়ী এই পুরো বিতর্ক নিয়ে বলেছিলেন যে দল ‘গান্ধীবাদী সমাজতন্ত্রের’ আদর্শ থেকে পিছু হটবে না।

অটল বিহারী বাজপেয়ী

ছবির উৎস, Getty Images

‘ইতিবাচক ধর্মনিরপেক্ষতা’র পক্ষে

মুম্বাইয়ের মহাধিবেশনের শেষ দিন ৩০ ডিসেম্বর রাতে ভাষণ দেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। সেখানেই তিনি ঘোষণা করেন যে বিজেপি বাবাসাহেব আম্বেদকরের সাম্যের নীতি গ্রহণ করেছে।দলের “ইতিবাচক ধর্মনিরপেক্ষতা”-র ধারণাটিও সেদিন সামনে এনেছিলেন মি. বাজপেয়ী।

এই ধারণার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় সপ্তদশ শতাব্দীতে সংখ্যালঘুদের প্রতি মারাঠা রাজা শিবাজী যে নীতি নিয়েছিলেন, তার।

মি. বাজপেয়ী বলেছিলেন যে আগ্রায় ছত্রপতি শিবাজীর আটক থাকার সময় তাঁর দেখভাল করতেন একজন মুসলিম।

অটল বিহারী বাজপেয়ী বলেছিলেন, “জনতা পার্টি ভেঙে গেছে ঠিকই কিন্তু আমরা কখনই জয়প্রকাশ নারায়ণের স্বপ্ন ভেঙ্গে যেতে দেব না।”

তিনি এও অস্বীকার করেন যে সংবাদপত্রে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে যে “গান্ধীবাদী সমাজতন্ত্র”এর নীতি নিয়ে দলের মধ্যে কোনও মতপার্থক্য রয়েছে।

মি. বাজপেয়ীর ভাষণের শেষ বাক্যটি ছিল এরকম: “সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি অন্ধকার দূর হবে, সূর্য উঠবে এবং পদ্ম ফুটবে।”

বিজেপির মহাধিবেশন থেকে ফিরে ‘অনলুকার’ পত্রিকার সম্পাদক জনার্দন ঠাকুর লিখেছিলেন, “আমি বিজেপির বম্বে সম্মেলন থেকে এই আশা নিয়ে ফিরেছি যে একদিন অটল বিহারী বাজপেয়ী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন। আমি এটা বলছি না যে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। আমি বলছি তিনি অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী হবেন। আমার ভবিষ্যদ্বাণী কোনও জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে নয় কারণ আমি জ্যোতিষী নই। আমি তাকে এবং তার দলকে খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করার পরে এই মূল্যায়ন করেছি। ভবিষ্যতের দলটির নেতা বাজপেয়ী।”

মুহম্মদ করিম চাগলা

ছবির উৎস, Getty Images

বিজেপিকে সমর্থন মুহম্মদ করিম চাগলার

ওই ভাষণের সময়ে প্রধান অতিথি হিসাবে ছিলেন জওহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভার সদস্য মুহম্মদ করিম চাগলা।

দেশভাগের আগে মি. চাগলা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সহকারী ছিলেন।

আত্মজীবনী ‘রোজেস ইন ডিসেম্বর’-এ তিনি লিখেছেন, “সেই সময়ে রাজনীতি ও আইন দুই ক্ষেত্রেই জিন্নাহ ছিলেন আমার আদর্শ। যতদিন তিনি জাতীয়তাবাদী ছিলেন, আমি তাঁর সঙ্গে ছিলাম, কিন্তু যখন তিনি সাম্প্রদায়িক হয়ে দ্বিজাতি তত্ত্বের পক্ষে কথা বলতে শুরু করলেন, তখন থেকেই তার সঙ্গে আমার পথ আলাদা হয়ে গেল।”

অটল বিহারী বাজপেয়ী মি চাগলাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন যে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক। এমনকি মি. জিন্নাহর সঙ্গে কাজ করা সত্ত্বেও তিনি দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করেছিলেন।

জবাবে মি. চাগলা বলেছিলেন যে মি. বাজপেয়ী ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী। তিনি সম্মেলনে হাজির প্রতিনিধিদের বলেন, “মানুষকে বোঝান যে আপনাদের পার্টি সাম্প্রদায়িক দলও নয়, নতুন রূপে জনসংঘও নয়। আপনাদের পার্টি এমন একটি জাতীয় দল যারা আগামী নির্বাচনে বা তার আগেই ইন্দিরা গান্ধীর জায়গাটা নিয়ে নিতে পারেন।”

নুসলি ওয়াদিয়া

ছবির উৎস, Getty Images

সম্মেলনের খরচের সিংহভাগ দিয়েছিলেন জিন্নাহর নাতি

মুম্বাইয়ের সম্মেলনে ব্যয় হয়েছিল ২০ লক্ষ ভারতীয় টাকা, যা তখনকার সময়ে যথেষ্ট বড় অঙ্ক ছিল।

বিনয় সীতাপতি লিখেছেন, “ওই সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিজেপির এক প্রবীণ নেতা বলেছিলেন যে এর জন্য বেশিরভাগ অর্থ বিখ্যাত শিল্পপতি নুসলি ওয়াদিয়া দিয়েছিলেন। ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে জিন্নাহর নাতি নুসলি ওয়াদিয়াই শিল্পপতিদের মধ্যে সবথেকে বেশি পরিমাণ চাঁদা দিতেন বিজেপিকে।”

দলের মহাধিবেশনের ১৬ বছর পরে, ১৯৯৬ সালে, বিজেপিকে প্রথমবারের মতো কেন্দ্রে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু দলটি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে পারেনি এবং অটল বিহারী বাজপেয়ীকে ১৩ দিনের মধ্যে পদত্যাগ করতে হয়েছিল।

কিন্তু পরের দুটি নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং ১৯৯৮ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার শপথ নেয়।