Source : BBC NEWS

ছবির উৎস, Getty Images
৭ মিনিট আগে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে গলায় রশি বেঁধে শাড়ি পরানো একটি নারী প্রতিকৃতিতে জুতাপেটার ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর এ নিয়ে নানা আলােচনা ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহবুব কায়সার জানিয়েছেন যে, খবর পেয়ে শনিবার তারাই সেটি সরিয়ে ফেলেছেন।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনার বিচার দাবি করে কুশপুত্তলিকা হিসেবে প্রতিকৃতিটি কোনো একটি সংগঠন বা কেউ সেখানে ঝুলিয়েছিলো বলে তারা জানতে পেরেছেন।
ওই প্রতিকৃতিতেও শেখ হাসিনার নাম সংযুক্ত ছিলো না।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা বলছেন, নারী প্রতিকৃতিটিতে জুতাপেটা ও শাড়ী খুলে অশালীন আচরণের ভিডিও ভাইরাল হয়ে যাওয়ার কারণে এখন সেটিকে সামাল দিতে কিংবা ‘যৌক্তিক’ প্রমাণের চেষ্টা থেকেই শেখ হাসিনার নাম টেনে আনা হচ্ছে।
তার মতে, ঘটনাটিতে নারী বিদ্বেষ থেকেই নারীর প্রতি অবমাননাকর আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে তিনি মনে করেন।
ওদিকে জাগ্রত জুলাই নামে একটি সংগঠন ওই প্রতিকৃতিটি রেখেছিল বলে প্রচার হলেও এই সংগঠনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ভিডিও এবং ঘটনা সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে
শনিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, রশি দিয়ে ফাঁসির মতো করে ঝুলানো নারী প্রতিকৃতিটিতে কয়েকজন জুতাপেটা করছেন। এক পর্যায়ে প্রতিকৃতিতে পেঁচানো শাড়ি খুলে যায়। পরে দুজন এসে শাড়িটি পরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন।
আবার ভিডিওতে যারা নারী প্রতিকৃতিটিতে জুতাপেটা করেছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ পাঞ্জাবি টুপি পরিহিত থাকায় সামাজিক মাধ্যমে অনেকে হেফাজতে ইসলামের সমর্থকদের এ ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন।
যদিও হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তাদের কেউই এ ধরনের ঘটনার সাথে জড়িত নন।
“নারীকে অসম্মান করার মতো কোন কাজে আমরা বা আমাদের কেউ জড়িত নয়। আমরা আমাদের দাবি যৌক্তিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করি। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে হেফাজতের ঘাড়ে দোষ দেয়ার জন্য ঘটনাটি আওয়ামী চক্রই ঘটিয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।
ওই ঘটনার সাথে কোনো সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ নাকচ করে পরবর্তীতে একটি বিবৃতিও দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম।
ওদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেন এমন কয়েকজন সাংবাদিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন যে পহেলা মে’তেই একটি সংগঠন শেখ হাসিনার বিচার দাবি করে প্রতীকী ওই প্রতিকৃতি টিএসসির রাজু ভাস্কর্য চত্বরে রেখেছিলো।
কিন্তু তাদের সেই কর্মসূচি শেষে প্রতিকৃতিটি সেখান থেকে না সরিয়ে তারা সেখানেই রেখে যায়।
শনিবার আরেকদল এসে ওই প্রতিকৃতিটিতে জুতাপেটা ও কয়েকজন অশালীন আচরণ করে, যার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

অনেকেই এর সমালোচনা করে নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন।
আব্দুল কাদের নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, “নারীর প্রতিকৃতি মানে কােনাে একজন নির্দিষ্ট নারী না, সমগ্র নারী জাতিকে বুঝায়। একজন নারী অপরাধী হতে পারে কিন্তু সমগ্র নারী জাতি অপরাধী হতে পারে না। এবং কী অপরাধে নারীকে শাস্তি প্রদান করা হচ্ছে সে অপরাধটাও কেউ জানে না। একজন নারী প্রতিকৃতিতে জুতাপেটা করে সমস্ত নারী জাতিকে অপমান করা হয়েছে। নারী জাতিকে অপমান করার অপরাধে আমি এ অপরাধীদের বিচার দাবি করছি”।
কুসুম তাহেরা নামে একজন লিখেছেন, “দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে এক নারীর প্রতিকৃতি বানানো হয়েছে জুতোপেটা করার জন্য। নারীকে কী করে ঘৃণা করতে হবে, কী করে তাদের হেনস্থা করতে হবে, নির্যাতন করতে হবে তা শেখানো হচ্ছে। একজন নারী একজন মা। দেশ মাতৃকাকে তারা উলঙ্গ করছে, জুতাপেটা করছে ফ্যাসিস্ট সরকারের অবয়বে।”
আসাদুজ্জামান আল মুন্না লিখেছেন, “জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ ও সাহস দুই দিক দিয়েই নারীরা অন্যতম প্রধান শক্তি হয়ে উঠেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ‘রাজাকার’ তত্ত্বকে খারিজ করে দিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ইডিওলজিক্যাল হেজিমনি ভেঙ্গে চুড়ে শেষ করে দিয়েছিলেন সেদিন রাতে এই রাজুর সামনেই। আর আজ এই রাজুর সামনেই এক নারীর প্রতিকৃতি বানিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জুতাপেটা করছে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা”।

তবে পহেলা মে’র ওই কর্মসূচি যারা পালন করেছিলো, চেষ্টা করেও তাদের সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি বলে এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য জানা যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহবুব কায়সার বিবিসিকে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে কেউ বা কোনো সংগঠন বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধান শেখ হাসিনার কুশপুত্তলিকা বা প্রতিকৃতি ঝুলিয়েছিলো মূলত তার বিচারের দাবিতে প্রতীকী অবস্থানের অংশ হিসেবে।
“তবে সেটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কারণ যেহেতু সেটায় শেখ হাসিনার নাম ছিলো না। তাই অনেকে শুধু নারীর প্রতিকৃতি হিসেবে বিবেচনা করে এটিকে নারীর প্রতি অসম্মান হিসেবে মনে করেছেন। অন্য কেউ এসে সেটিতে জুতাপেটা করছে বা শাড়ি ছিঁড়ছে এমন ভিডিও দেখা গেছে। খবর পেয়েই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটি সরিয়ে ফেলেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. কায়সার।
কুশপুত্তলিকা সরিয়ে ফেলার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ সমস্যাটির সমাধান করতে পেরেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা বলছেন, ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর সবমহল থেকে সমালোচনা হচ্ছে বলেই এখন শেখ হাসিনার নাম টেনে আনা হচ্ছে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে কুশপুত্তলিকা দাহ করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এই ঘটনার ভিডিওতে যা দেখা যাচ্ছে তা চরম অগ্রহণযোগ্য।
“এটি শেখ হাসিনার হয়ে থাকলেও তাতে কুশপুত্তলিকার নামে বস্ত্রহরণ চরম অবমাননাকর। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এ ধরনের আপত্তিকর কাজ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আগেই সচেতন হওয়া উচিত ছিলো,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তার মতে “এখানে নারী, নারীর পোশাক ও ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। যারা করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া উচিত, যাতে কেউ চাইলেই নারীর প্রতি অবমাননাকর কোনো আচরণ দেখাতে সাহস না পায়”।
প্রসঙ্গত, গত বছরের অগাস্টে আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আন্দোলনকারীদের একটি অংশ গণভবনে প্রবেশ করেছিলো। তখন তাদের কেউ কেউ নারীদের অন্তর্বাস হাতে নিয়ে নিজেরাই ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে দেয়ার পর তা নিয়েও তীব্র সমালোচনা হয়েছিলো।