Source : BBC NEWS

ছবির উৎস, ANI
“আমরা চাই না লোকে কাশ্মীরি বা মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যাক। আমরা শান্তি চাই, শুধুমাত্র শান্তি। অবশ্যই ন্যায় বিচার চাই। যারা দোষী তাদের সাজা পাওয়া উচিৎ,” সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এই কথাগুলো বলেছিলেন হিমাংশী নারওয়াল।
তিনি পহেলগাম হামলায় নিহত ভারতীয় নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট বিনয় নারওয়ালের স্ত্রী।
ভারত শাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে গত ২২শে এপ্রিল পর্যটকদের লক্ষ্য করে চালানো হামলার ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরই বেশ কয়েকটা ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল।
সেগুলোর মধ্যে একটি ছবিতে স্বামীর নিথর দেহের পাশে শোকস্তব্ধ অবস্থায় বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল এক নারীকে। সেই ছবি, সদ্য বিবাহিত বিনয় নারওয়াল ও তার স্ত্রী হিমাংশীর।
গত মাসে ১৬ই এপ্রিল তাদের বিয়ে হয়। রিসেপশন বা বৌভাত ছিল ১৯ তারিখ। কাশ্মীরে মধুচন্দ্রিমায় গিয়েছিলেন এই নবদম্পতি। সেখানেই ২২শে এপ্রিল হামলায় নিহত হন মি. নারওয়াল।
বিনয় নারওয়াল ভারতীয় নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট পদে কর্মরত ছিলেন। কেরালার কোচিতে তার পোস্টিং ছিল।
গত পহেলা মে ছিল বিনয় নারওয়ালের ২৭ তম জন্মদিন। সেইদিন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথোপকথনের সময় কাশ্মীরি এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ না করার আরজি জানিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন তার স্ত্রী।
তারপর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে ট্রল করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, ওই মন্তব্যের জন্য তাকে কটূক্তির শিকার হওয়ার পাশাপাশি হুমকিও দেওয়া হচ্ছে বলেও জানা যাচ্ছে।

ছবির উৎস, ANI
‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও নিন্দনীয়’
এই বিষয়ে হিমাংশী নারওয়ালের পাশে দাঁড়িয়েছে ‘জাতীয় মহিলা কমিশন’। কারও ব্যক্তিগত জীবন বা আদর্শগত অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য ট্রোল করা ঠিক নয় বলে বলেছে কমিশন।
জাতীয় মহিলা কমিশন একটি বিবৃতিতে বলেছে, “এই সন্ত্রাসী হামলায় গোটা দেশ ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ। লেফটেন্যান্ট বিনয় নারওয়ালের স্ত্রী হিমাংশী নারওয়ালের এক মন্তব্যকে কেন্দ্র করে তাকে যেভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিশানা করা হচ্ছে সেটা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং দুর্ভাগ্যজনক বিষয়।”
কমিশন আরো বলেছে, কোনও বিষয়ে সহমত প্রকাশ বা তার বিরুদ্ধে কথা বলা- দুই ক্ষেত্রেই শালীনতা বজায় ও সাংবিধানিক মর্যাদার কথা মাথায় রাখা উচিৎ।
বিবিসির পক্ষ থেকে হিমাংশী নারওয়ালের সঙ্গে এই প্রসঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তার পরিবারের সদস্যরা বিবিসিকে বলেছেন, “হিমাংশী এই মুহূর্তে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।”

ছবির উৎস, Getty Images
‘ট্রল করার মাধ্যমে মেরুকরণের রাজনীতি’
হিমাংশীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব ট্রল চলছে, তার নিন্দা করেছেন সমাজকর্মীসহ অনেকে।
অ্যাক্টিভিস্ট কবিতা কৃষ্ণণ বলেন, “কিছুদিন আগে পর্যন্ত হিমাংশী ও তার স্বামী বিনয়ের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল ছিল। মানুষ তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে এবং বিচারের দাবি জানিয়েছে।”
“আজ সেই মানুষগুলোই হিমাংশীর বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক মন্তব্য করছে এবং দেশের প্রতি তার ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।”
তার মতে এর নেপথ্যে অন্য ‘উদ্দেশ্য’ রয়েছে। মিজ কৃষ্ণণ মনে করেন, এখন একটা চেষ্টা চলছে “মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটা মনোভাব তৈরি করা। এই পরিস্থিতিতে হিমাংশীর মতো যদি কোনও নারী সেই ন্যারেটিভকে খারিজ করেন, তখন তিনি নিশানা হয়ে ওঠেন।”
তিনি বলেন, “জেএনইউ (জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়)-এর সঙ্গে তার যোগ টেনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে তাকে দেশদ্রোহী হিসেবে তুলে ধরারও চেষ্টা করা হচ্ছে, যেমনটা দীর্ঘদিন ধরেই ডানপন্থী সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলগুলো থেকে করা হচ্ছে।”
জাতীয় মহিলা কমিশনের পক্ষ থেকে বিবৃতি জারি করার পর দাবি উঠেছে যে, যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ধরনের মন্তব্য করেছেন, তাদের শুধুমাত্র খারিজ করলেই হবে না, বরং ‘উস্কানিমূলক’ বক্তব্য দেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিভিন্ন সংগঠনের তরফে এই জাতীয় অ্যাকাউন্ট ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত এফআইআর দায়ের করারও দাবি জানানো হয়েছে।
এমনই এক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জগমতি সাংওয়ান।
এই ধরনের ট্রলিং নিয়ে তিনি বলছেন, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ধরনের ট্রলিং এবং হুমকি বারবার দেখা গিয়েছে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে একটাই প্রশ্ন উঠেছে যে হেটস্পিচ (বিদ্বেষমূলক বক্তব্য) নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কি আমাদের কাছে কোনও উপায় নেই?”
“পাশাপাশি এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোরও তো একটা বড় দায়িত্ব রয়েছে।”

ছবির উৎস, INDIAN NAVY
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও নেতারা এই ঘটনার সমালোচনা করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
শিবসেনা (উদ্ধব বালাসাহেব ঠাকরে) সাংসদ প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী হিমাংশী নারওয়ালকে হেনস্থার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, “তাকে গালিগালাজ করা হচ্ছে, ট্রল করা হচ্ছে, ঘৃণার শিকার হতে হচ্ছে কারণ তিনি ঘৃণার পরিবর্তে ন্যায়বিচার দাবি করেছেন- তাই?”
“স্বামীকে হারিয়ে, একমাত্র তার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। আর এই অসুস্থ ট্রল (যারা ট্রল করছেন) ওকে নিশানা করে ঘৃণা ছড়াচ্ছে।”
তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ সাকেত গোখলেও প্রয়াত নৌসেনা কর্মকর্তা বিনয় নারওয়ালের স্ত্রীর সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন। তাকে যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হেনস্থা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার দাবি তুলেছেন।
তবে ট্রলের মাঝেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই হিমাংশী নারওয়ালের বক্তব্যকে সমর্থন করছেন। তার সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন।
সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “বিনয় নারওয়াল অমর রহে, হিমাংশী নারওয়াল জিন্দাবাদ। বিনয় ও হিমাংশীর মতো মানুষদের জন্যই এই দেশ শক্তিশালী, যারা এমন ট্রল করছেন, তাদের কারণে নয়।”
কেউ কেউ আবার লিখেছেন, “এই ট্রলের কারণেই অবশেষে পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে।”

ছবির উৎস, Getty Images
হিমাংশী নারওয়াল ছাড়াও যাদের ‘নিশানা’ হতে হয়েছে
প্রসঙ্গত, হিমাংশী নারওয়ালই একমাত্র নন, যাকে সাম্প্রতিক সময়ে ট্রলের নিশানা করা হয়েছে।
পহেলগাম হামলার পর অলিম্পিকে সোনাজয়ী নীরজ চোপড়াওকেও ট্রলের শিকার হতে হয়েছে। কারণ তিনি পাকিস্তানি অ্যাথলিট আরশাদ নাদিমকে ভারতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
এই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে ব্যাপক কটাক্ষের শিকার হয়। শেষপর্যন্ত আন্তর্জাতিক পদকজয়ী এই খেলোয়াড় নীরজ চোপড়াকে এই বিষয়ে বিবৃতি জারি করতে হয়েছিল।
নীরজ চোপড়া বলেছিলেন, “আমি কম কথা বলা একজন মানুষ। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি কোনওরকম ভুল বিষয়ের বিরুদ্ধে কথা বলব না। বিশেষত যখন দেশের প্রতি আমার ভালোবাসা এবং পরিবারের প্রতি সম্মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।”
“আমি আরশাদকে যে আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলাম সেটা ছিল এক অ্যাথলিটের কাছ থেকে অন্য এক অ্যাথলিটকে জানানো আমন্ত্রণ। এর চেয়ে বেশি কিছুও নয়, কমও নয়।”
“নীরজ চোপড়া ক্লাসিক-এর উদ্দেশ্য ছিল সেরা অ্যাথলিটদের ভারতে নিয়ে আসা এবং আমাদের দেশে বিশ্বমানের ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা।”