Source : BBC NEWS

যোধপুর থেকে বিশেষ বিমানে করে অবৈধ বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত ১৪৮ জনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, ফাইল ছবি

ছবির উৎস, Jitendra Dudi/BBC

ভারতের রাজস্থান থেকে ‘অবৈধভাবে বসবাসরত বাংলাদেশি’ সন্দেহে আটক ১৪৮ জনকে ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় স্থানান্তর করা হয়েছে বলে জানতে পেরেছে বিবিসি। সেখানে আটক আরো ছয় শতাধিক ‘চিহ্নিত বাংলাদেশি’কে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে বলে জানাচ্ছে সেখানকার কর্তৃপক্ষ।

সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে এভাবে আটককৃতদের কয়েক দফায় সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ‘পুশ ব্যাক’ করেছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী, বিএসএফ।

পহেলগাম হামলার পর ভারতের নানা রাজ্যে ‘অনুপ্রবেশকারী’ খোঁজার অভিযান শুরু হয়েছিল। এর অংশ হিসেবে ‘অবৈধভাবে’ ভারতে বসবাসকারী ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে অনেককে আটক করা হয়েছে।

রাজস্থানে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ চিহ্নিত করার অভিযানে ভারতীয় বাংলাভাষী মুসলমানও আটক হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। বিবিসি এরকম একাধিক ভারতীয় বাংলাভাষী আটক হওয়ার খবর পেয়েছে।

পরবর্তীতে আটককৃত অনেককে পরিচয় যাচাইয়ের পর ছেড়ে দেয়া হয়।

ইতিমধ্যেই যাদের ‘বাংলাদেশি’ বলে চিহ্নিত করতে পেরেছে রাজস্থান পুলিশ, তাদের প্রথম দলটিকে বুধবার যোধপুরের বিমানবন্দর থেকে বিশেষ বিমানে চাপিয়ে ত্রিপুরার আগরতলায় পাঠানো হয়।

প্রথম দলে ১৪৮ জন চিহ্নিত ‘বাংলাদেশি’ আছেন বলে রাজস্থান থেকে বিবিসির সহযোগী সংবাদদাতা জানিয়েছেন।

আগরতলার বিমানবন্দর সূত্র নিশ্চিত করেছে, ওই বিশেষ বিমানটি বুধবার ভারতীয় সময় সন্ধ্যা সাতটা নাগাত সেখানে পৌঁছেছে।

ধারণা করা হচ্ছে, স্থানান্তর করা এই ব্যক্তিদের বাংলাদেশে পুশ-ব্যাক করা হবে।

গত সপ্তাহে ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা, শান্তিপুর ও পানছড়ি সীমান্ত দিয়ে মোট ৭২ জনকে বাংলাদেশে পুশ-ইন করানো হয়েছে; অর্থাৎ তাদেরকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করানো হয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসন বিবিসিকে জানিয়েছিল।

এর বাইরে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম, সিলেট এবং মৌলভীবাজার সীমান্ত দিয়েও সম্প্রতি পুশ-ইনের ঘটনা ঘটেছে।

ওদিকে গুজরাত থেকে এর আগে বড় সংখ্যায় ধরপাকড় হয়েছিল – যাদের মধ্যে অনেককে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বলে চিহ্নিত করে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে সেখানকার পুলিশ।

রাজস্থানেও গত কয়েকদিন ধরেই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে বাংলাভাষী মুসলমানদের আটক করা হচ্ছে। এদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়ের বাংলাভাষী মুসলমানরাও আছেন।

ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বলছে, গত কয়েকদিনে তারা ভারতীয় বাংলাভাষী মুসলমানদের কাছ থেকে অন্তত ২০০টি অভিযোগ পেয়েছে, যারা দাবি করছে যে পরিচয় নিশ্চিত করার নাম করে তাদের নানা জায়গায় আটকে রেখেছে রাজস্থান পুলিশ।

বিবিসি বাংলায় আরও পড়তে পারেন
চারটি বাসে চাপিয়ে ১৪৮ জন চিহ্নিত অবৈধ বাংলাদেশীকে রাজস্থানের যোধপুর বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয়

ছবির উৎস, Jitendra Dudi/BBC

কতজন ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ চিহ্নিত?

রাজস্থান পুলিশের বরাত দিয়ে জয়পুর থেকে বিবিসি-র সহযোগী সংবাদদাতা মোহর সিং মীনা জানাচ্ছেন, বুধবার পর্যন্ত ১০০৮ জনকে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে আটক করা হয়েছে।

তবে তাদের মধ্যে ৭৬১ জনকে পুলিশ চিহ্নিত করেছে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বলে।

বাকিদের ভারতীয় পরিচয়পত্র খতিয়ে দেখে তাদের ছেড়ে দিতে শুরু করেছে পুলিশ।

বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিতদের সবাইকেই বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে বলে রাজস্থান পুলিশ জানিয়েছে।

তারই প্রথম ধাপ হিসেবে বুধবার ১৪৮ জনকে বিশেষ বিমানে তুলে দেওয়া হয়।

এর আগে বুধবার সকালে জয়পুরের প্রতাপ নগরে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের আটকে রাখার জন্য তৈরি করা ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ থেকে চারটি বাসে চাপিয়ে যোধপুর বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয় তাদের।

‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে ধরপাকড় শুরু হওয়ার পরে নতুন করে তিনটি ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ গড়া হয়েছে। এখন মোট চারটি এরকম শিবির রয়েছে রাজস্থানে।

পশ্চিমবঙ্গর দিনহাটার বাসিন্দা ওবায়েদুল খন্দকার ও তার স্ত্রী ১০ দিন আটক ছিলেন রাজস্থানে

ছবির উৎস, Obayedul Khandakar

আটক ভারতীয় বাঙালিরাও

‘অবৈধ বাংলাদেশি’ চিহ্নিত করার অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এমন অনেককেও আটক করা হয়েছিল যারা ভারতীয় এবং বাংলাভাষী মুসলমান।

তাদের পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য প্রায় দশ দিন ধরে তাদের আটকে রাখা হয়েছিল। তবে এই সময়কালের মধ্যে তাদের কোনো আদালতে তোলা হয়নি।

পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী যেসব মুসলমান নারী,পুরুষ ও শিশুদের আটকে রাখা হয়েছিল, তাদের মঙ্গলবার রাত থেকে ছেড়ে দেওয়া শুরু হয়েছে।

এরকমই একজন, পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার বাসিন্দা ওবায়েদুল খন্দকার।

তিনি শিখর জেলার পাটন থানা অঞ্চলের একটি ইটভাটায় কাজ করতেন।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, “দিন দশেক আগে পুলিশ এসে আমাদের পরিচয়পত্র দেখতে চায়। আমাদের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড সবই দেখিয়েছিলাম। তবুও তারা বলে যে ওগুলো যাচাই করা হবে।”

“এই বলে আমাদের একটা অতিথিশালায় নিয়ে যায়। সেখানে আমার স্ত্রীসহ অন্য নারী এবং শিশুরাও ছিল যারা ভারতীয়। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম আর মেঘালয় থেকে আসা বাঙালি মোট ১৩ জন ছিলাম আমরা,” জানাচ্ছিলেন মি. খন্দকার।

তাদের সঙ্গে প্রায় ১০০জনের মতো ‘চিহ্নিত বাংলাদেশি’ও ছিলেন বলে তিনি জানিয়েছেন।

মি. খন্দকার বলছিলেন, “ওই অতিথিশালার বাইরে পুলিশ পাহারা থাকত। তবে প্রয়োজনে আমরা বাইরে বেরুতে পারতাম। কিন্তু খাবারের পরিমাণ খুবই কম ছিল। দুটো রুটি আর সামান্য ভাত খেতে দিত।”

মঙ্গলবার রাতে তারা নিজেদের ঘরে ফেরার পরে দেখতে পান সব কিছু চুরি হয়ে গেছে, কেটে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুতের লাইনও।

মি. খন্দকার বলছিলেন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে তিনি গ্রামে ফিরে যাবেন এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে আর কাজ করতে যাবেন না।

আটক অবস্থায় ভারতীয় বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকরা - বিবিসির নীতি অনুযায়ী শিশুদের মুখ ঢেকে দেওয়া হয়েছে

ছবির উৎস, Obayedul Khandakar

আদালতে নেওয়া হয়নি

পশ্চিমবঙ্গের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ’ বলছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ চিহ্নিত করার অভিযান শুরুর পর থেকে তারা যে হেল্পলাইন নম্বর চালু করেছে, সেখানে রাজস্থান থেকে অন্তত ২০০টি অভিযোগ পেয়েছেন।

“পশ্চিমবঙ্গের অনেক বাঙালি মুসলমানকে সেখানে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে আমরা অভিযোগ পাচ্ছি। রাজস্থানের থানাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করছি আমরা। কিছু মানুষের খোঁজ পেয়েছি। আবার এমনও অনেকে আছেন তাদের যে কোথায় রাখা হয়েছে সেটাই জানতে পারছে না পরিবারের সদস্যরা। ফোনও নিয়ে নেওয়া হয়েছে,” বলছিলেন ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক আসিফ ফারুক।

এরকমই একজন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার বাসিন্দা সফিকুল সেখ। তার পরিবার অভিযোগ করছে যে গত এক সপ্তাহ ধরে আটক করে রেখেছে রাজস্থান পুলিশ।

“আমাদের কাছে পরিবারের লোক অভিযোগ জানায় তখন আমরা লালকুঠি থানায় যোগাযোগ করলে সেখান থেকে বলা হয় যে তাকে আমের এলাকার ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে,” জানাচ্ছিলেন মি. ফারুক।

পুলিশ বলছে যে প্রত্যেকের আদি বসবাসের এলাকা থেকে পরিচয়পত্র যাচাই করার জন্যই আটকে রাখা হয়েছে।

“আটক হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে পেশ করাটা আইন অনুযায়ী বাধ্যতামূলক। তাহলে পুলিশ কী করে এদের কাউকে সাত, কাউকে ১০ দিন ধরে আটকিয়ে রাখতে পারে?” প্রশ্ন আসিফ ফারুকের।

তবে রাজস্থান ও যোধপুর পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেও এই প্রশ্নের জবাব পায়নি বিবিসি বাংলা।