Source : BBC NEWS

ছবির উৎস, Getty Images
৫ মিনিট আগে
ভারতের ‘এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম’ বা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গত আটই মে পাকিস্তানি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকিয়ে দিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। তার পর থেকেই আলোচনা হচ্ছে ভারতের এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে, বিশেষ করে ‘এস-৪০০’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে- যা কয়েক বছর আগে রাশিয়ার কাছ থেকে কেনা হয়েছে।
তবে পাকিস্তান ভারতের দাবি খারিজ করে (ভারতে) ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা অস্বীকার করেছে।
প্রসঙ্গত, আধুনিক যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে যে কোনো দেশের কাছেই প্রতিপক্ষ বা ‘শত্রু’র যুদ্ধবিমান, ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও হেলিকপ্টারের মতো আকাশপথে ধেয়ে আসা ‘থ্রেট’কে (হুমকি) ধ্বংস করার আধুনিক প্রযুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।
ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে দুই দেশের সীমান্তে প্রায়শই উত্তেজনা বিরাজ করে, এই জাতীয় ডিফেন্স সিস্টেম বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ভূমিকা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
প্রসঙ্গত, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যে কোনো দেশের প্রতিরক্ষায় সহায়তা করে ঠিকই, কিন্তু তার পাশাপাশি ‘যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি’তে কৌশলগত দিক থেকে এগিয়ে থাকতেও সাহায্য করে।
দুই দেশের মধ্যে এই চলমান উত্তেজনার মাঝে দুই দেশেরই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কী, তা কীভাবে কাজ করে এবং ভারত ও পাকিস্তানের কাছে কী কী ধরনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে তা আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে।

ছবির উৎস, Getty Images
আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কী?
আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এমন এক ধরনের সামরিক ব্যবস্থা যা শত্রু বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও আকাশপথে আসা অন্যান্য হুমকি থেকে নিজেদের আকাশসীমাকে রক্ষা করে।
রাডার, সেন্সর, ক্ষেপণাস্ত্র ও গান সিস্টেম ব্যবহার করে আকাশপথে আসা হুমকিকে চিহ্নিত ও ট্র্যাক করে এবং পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানানো হয় এই ব্যবস্থার মাধ্যমে।
আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থির (স্থায়ী স্থাপনা) বা চলমান আকারে স্থাপন করা যেতে পারে। এটা ছোট ড্রোন থেকে শুরু করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মতো বৃহত্তর হুমকিকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম।
প্রতিপক্ষের বিমান হামলা থেকে নিজেদের বেসামরিক এলাকা, সামরিক ঘাঁটি ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোকে রক্ষা করাই এর মূল উদ্দেশ্য।
আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চারটি প্রধান অংশে কাজ করে। রাডার ও সেন্সর শত্রু বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন চিহ্নিত করতে পারে। কমান্ড এবং কন্ট্রোল সেন্টার ডেটা ‘প্রসেস’ করে এবং অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে। প্রতিপক্ষের অস্ত্র ব্যবস্থার হুমকি প্রতিরোধ করে।
মোবাইল (চলমান) ইউনিটগুলো দ্রুত মোতায়েন করা সম্ভব যা যুদ্ধক্ষেত্রে এই সিস্টেমের ব্যবহারকে অত্যন্ত কার্যকর করে তোলে।

ছবির উৎস, Getty Images
কীভাবে কাজ করে?
আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হুমকি চিহ্নিত ও ট্র্যাক করা এবং সেটা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার আগেই নির্মূল করাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করে।
এর প্রতিটা পর্যায়ে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন থাকে, আবার কীভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে সেটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম পর্যায়ে- রাডার ও অন্যান্য সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহার করে আকাশপথে আসা হুমকিকে চিহ্নিত করা হয়।
রাডার হলো প্রাথমিক সরঞ্জাম। এর কাজ সম্পর্কে সহজভাবে বলতে গেলে–– রাডার ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ পাঠায় এবং সেগুলোর ফেরত আসা বা প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে শত্রু বিমান বা ক্ষেপণাস্ত্রের অবস্থান শনাক্ত করে।
দূরপাল্লার রাডার, মাঝারি পাল্লার ও স্বল্পপাল্লার রাডারের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক সেন্সর ও ইনফ্রারেড সেন্সর শত্রু বিমান থেকে নির্গত সংকেতকে শনাক্ত করে তাদের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করে।
এই পর্যায়ে আসন্ন ওই হুমকির গতি, সেটা কী ধরনের- যেমন হামলার জন্য কোন ধরনের ড্রোন বা বিমান বা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে সেটা শনাক্ত করা হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘থ্রেট ট্র্যাকিং’ বা হুমকি শনাক্ত করা হয়। এটা আকাশপথে ধেয়ে আসা ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র বা যুদ্ধবিমানের, পথ এবং অন্যান্য কার্যক্রম সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে।
রাডার, লেজার রেঞ্জ ফাইন্ডার এবং ডেটা লিংক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যে শত্রু বিমান বা ক্ষেপণাস্ত্রের গতিবেগ কী, কোন উচ্চতা দিয়ে তা উড়ছে এবং কোনদিকে তা ধাবিত হচ্ছে।
‘থ্রেট ট্র্যাকিং’ খুবই জরুরি। কারণ কোনো আক্রমণ বা যুদ্ধের সময় ‘ট্র্যাকিং সিস্টেম’ প্রতিপক্ষের নিক্ষেপ করা ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন বা যুদ্ধবিমানগুলোর পাশাপাশি নিজেদের যুদ্ধবিমান বা ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকেও ট্র্যাক করতে পারে।
সুতরাং ট্র্যাকিং সিস্টেমের কার্যকারিতা সম্পূর্ণ মসৃণ ও নির্ভরযোগ্য হওয়াটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ যাতে কোনো দেশের নিজেদের সরঞ্জাম বা ক্ষেপণাস্ত্র বা ফাইটার জেটগুলোর ক্ষতি না হয়।
ক্রমাগত ট্র্যাকিং করার পরে, একসময় আকাশপথে ধেয়ে আসা ওই হুমকিকে একবারে ধ্বংস করতে হয়।

ছবির উৎস, Getty Images
ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী?
এবার আসা যাক ভারতের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এস-৪০০ এর বিষয়ে, যাকে ভারতীয় সেনাবাহিনী ‘সুদর্শন চক্র’ নামে ডাকে।
ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তার একাধিক স্তর এবং সিস্টেমের বৈচিত্র্যের জন্য পরিচিত। এতে রাশিয়ান, ইসরায়েলি এবং দেশীয় প্রযুক্তির মিশ্রণ রয়েছে যা ভারতীয় আকাশ প্রতিরক্ষাকে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আরও কার্যকর করে তোলে।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে রাশিয়া থেকে পাঁচটা ‘এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম’ কিনতে রাজি হয়েছিল ভারত। একে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেরা ‘প্যাট্রিয়ট মিসাইল এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম’ (যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ব্যবহৃত ক্ষেপণাস্ত্র (আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার) সঙ্গে তুলনা করা হয়।
ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে এই চুক্তির পরিমাণ ছিল ৫.৪৩ বিলিয়ন (৫৩৪ কোটি) ডলারের।
এস-৪০০ একটা মোবাইল বা চলমান সিস্টেম। এর অর্থ হলো এই সিস্টেমকে সড়কপথে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া বা আসা যায়। নির্দেশ পাওয়ার পাঁচ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে এটা মোতায়েন করা যায় বলে জানা গেছে, অর্থাৎ এতে সময়ও কম ব্যয় হয়।
ইংরেজি সংবাদপত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী- ভারতের কাছে ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’ ছাড়াও ‘বারাক -৮’ এবং দেশীয় প্রযুক্তির মিসাইল সিস্টেম (ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা) আকাশ প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
‘স্পাইডার’ এবং ‘ইগলার’-এর মতো সিস্টেমগুলো স্বল্প-পরিসরের ‘থ্রেট’কে মোকাবিলা করতে ব্যবহার করা হয়।
এই প্রসঙ্গে ভারতের অবসরপ্রাপ্ত মেজর ড. মোহাম্মদ আলী শাহের সঙ্গে কথা বলেছিল বিবিসি।
তিনি বিবিসিকে বলেছেন, “আমি আমাদের দেশের নিরাপত্তায় মোতায়েন করা সরঞ্জামের তথ্য শেয়ার করব না, তবে আমি বলব যে ভারত ও পাকিস্তানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট।”
“পাকিস্তানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আমাদের বাহিনীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে ভারতীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জম্মুর বেশ কয়েকটা স্থানে পাকিস্তানের প্রচেষ্টা এবং উড়ন্ত ড্রোনকে সফলভাবে প্রতিহত করেছে।”
“রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ কেনার সময় নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি ছিল, কিন্তু আজ সেই একই ব্যবস্থা অসংখ্য ভারতীয় নাগরিকের জীবন বাঁচাচ্ছে।”
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, গত আটই মে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ভারতের একাধিক সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালানোর চেষ্টা করেছিল পাকিস্তান।
অন্যদিকে, পাকিস্তান এই হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে পাল্টা দাবি করা হয়েছে যে ভারতের ২৫টা ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে।
বিবিসি স্বাধীনভাবে উভয় দাবিই নিশ্চিত করতে পারেনি।

ছবির উৎস, Getty Images
পাকিস্তানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
ভারত ২০১৯ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে ‘এস-৪০০ অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফট মিসাইল সিস্টেম’ (বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা) কিনেছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের কাছে রয়েছে ‘এইচকিউ-৯ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম।’
ইংরেজি সংবাদপত্র ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’য় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মূলত চীন ও ফ্রান্সের প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল।
এর প্রধান অংশ হলো এইচকিউ-৯ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম (এইচকিউ-৯ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা) যা ১২০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত আকাশপথে আসা হুমকিকে প্রতিহত করতে পারে।
এছাড়া, ফ্রান্স থেকে আমদানি করা স্পাডা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম (স্পাডা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা) বিমান ঘাঁটি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানের সুরক্ষার জন্য একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করা হয় হয়।
পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাবেক ভাইস মার্শাল ইকরামুল্লাহ ভাট্টি বিবিসি উর্দুকে বলেন, “পাকিস্তানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্বল্প পাল্লার, মাঝারি পাল্লার এবং ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য দূরপাল্লার ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে বাধা দেওয়ার সক্ষমতা রাখে।”
তিনি জানিয়েছেন, পাকিস্তান নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও মজবুত করতে চীনের তৈরি ‘এইচকিউ-১৬ এফই ডিফেন্স সিস্টেম’ (এইচকিউ-১৬ এফই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা) অন্তর্ভুক্ত করেছে, যা ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং যুদ্ধজাহাজের বিরুদ্ধে কার্যকর।
তবে আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র আটকানোর ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই।
আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে উন্নত হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানকে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং সোয়ার্ম ড্রোনের ক্রমবর্ধমান হুমকি এই সিস্টেমগুলোর আরও বিকাশের প্রয়োজনীয়তাকে বাড়িয়ে তুলেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও লেজারভিত্তিক অস্ত্র আকাশ প্রতিরক্ষাকে আরও কার্যকর ও সস্তা করে তুলতে পারে।
এআই সিস্টেম ‘থ্রেটে’র প্রাথমিক শনাক্তকরণ এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। অন্যদিকে, লেজার প্রযুক্তি প্রাণঘাতী আক্রমণগুলোর ক্ষেত্রে নির্ভুল হওয়াকে নিশ্চিত করবে।