Source : BBC NEWS

ছবির উৎস, CA PRESS WING
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছর এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণার পর বিএনপি ও সমমনা দলগুলো তাতে হতাশা প্রকাশ করেছে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাই এই সময়সীমা মেনে নিলেও নির্বাচনটিকে অংশগ্রহণমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক, উৎসবমুখর ও গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে কী কী চ্যালেঞ্জ সরকারকে আগামী দশ মাসে মোকাবেলা করতে হবে- সেই আলোচনাও উঠছে।
বিশেষ করে রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়াও, এই অল্প সময়ের মধ্যে ভোটার তালিকা চূড়ান্তকরণ, নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণের মতো জটিলকাজ সহ নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো শেষ করার সক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের আছে কি-না সেই প্রশ্নও আছে।
প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে বলেছেন “ইতিহাসের সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য সকল পক্ষের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি”।
যদিও তার ঘোষিত নির্বাচনের সময়সীমাই বিতর্কের মুখে পড়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এই সময় নির্ধারণে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের মতামতকেই তিনি উপেক্ষা করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ অবশ্য বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে আগামী মাসের মধ্যেই ‘জুলাই সনদ’সহ সংস্কার কর্মসূচিগুলো চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে।
মি. ইউনূস তার ভাষণে বলেছিলেন জুলাই সনদ অনুযায়ী আশুকরণীয় সংস্কার কাজগুলো বাস্তবায়নের পাশাপাশি বাকি অংশের বেশকিছু কাজও তারা শুরু করে যেতে চান।

ছবির উৎস, Getty Images
যেসব চ্যালেঞ্জ সামনে আসবে
বিশ্লেষকরা বলছেন, কোন বিষয়গুলোতে সংস্কার হবে সে বিষয়ে সব দলকে এক করা, আন্দোলনের সময় হওয়া হত্যাকাণ্ডের বিচারকে ‘গ্রহণযোগ্য’ করার পাশাপাশি পক্ষপাতহীন নির্বাচনের পরিবেশ ও একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সরকার যে তৈরি করতে পারবে- এই আস্থা তৈরি করাই এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
এছাড়া আইনশৃঙ্খলা ঠিক করা, পুলিশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে কাজ করার উপযোগী করা, বিতর্কহীন ভোটার তালিকা তৈরি করা, নির্বাচনি আসনের সীমানা নির্ধারণ কি পুরনো আইনে হবে নাকি নতুন আইন করা হবে, আবার নতুন আইনে হলে তার ভিত্তিতে এই জটিল কাজ এতো অল্প সময়ে করা সম্ভব কি-না- সেই চ্যালেঞ্জগুলোও সরকারের সামনে থাকবে বলে তারা মনে করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, সরকারের সামনে প্রকৃত চ্যালেঞ্জই হবে নিজে নিরপেক্ষ থেকে একটি পক্ষপাতহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন তারা যে করতে চায়, সেই আস্থাটা অর্জন করা।
“ইতোমধ্যেই দু’একটি দলের প্রতি তাদের পক্ষপাতমূলক আচরণ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠেছে। এর নিষ্পত্তি না হলে আইন শৃঙ্খলা ও নির্বাচন কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সেটা নিশ্চিত করা আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
ইতোমধ্যেই বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে এবং দু জন উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে দলটি অনড় আছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, সরকার তাদের দলের সাথে ‘বিমাতাসুলভ’ আচরণ করছে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান আগামী নির্বাচনে ‘সম্ভাব্য ডাকাতির’ বিষয়ে হুশিয়ার করেছেন। শনিবার মৌলভীবাজারে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন জাতি যেনতেন নির্বাচন চায় না।
বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, সরকার এখনো আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করতে পারেনি। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত সরকার কতটা করতে পারবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে বলে মনে করেন তিনি।
“এনসিপি ও জামায়াত তো ভোট ডাকাতির আশঙ্কা প্রকাশ করছে। তাদের অভিযোগ প্রশাসন চালাচ্ছে বিএনপি। আবার বিএনপি বলছে সরকার নিজেই নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। তাহলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কিভাবে হবে সেটি সরকারকে ঠিক করতে হবে,” বলছিলেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে বলেছেন, সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন এই তিনটি ম্যান্ডেটের ভিত্তিতে তারা দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম।
“সে বিবেচনায় আগামী রোজার ঈদের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে আমরা একটি গ্রহণযোগ্য জায়গায় পৌঁছতে পারবো বলে বিশ্বাস করি। বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার- যা কি না জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি আমাদের সম্মিলিত দায়- সে বিষয়ে আমরা দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পারব,” বলেছেন তিনি।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে গত এগার মাসে সরকার সংস্কার ইস্যুতে কিছু করতে পেরেছে কি-না এবং একই সাথে সংস্কার বাস্তবায়নের চেয়ে ‘সময় ক্ষেপণের জন্য’ এসব নিয়ে আলোচনাটাই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে কি-না।
আবার ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা করে তারপর সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন হলে পরের আট মাসে নির্বাচন আয়োজনের মূল চ্যালেঞ্জ কতটা গুরুত্ব পাবে, সেই আশংকাও আছে অনেকের মধ্যে।
যদিও আলী রীয়াজ বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে সহযোগিতা করছে সেটি অব্যাহত থাকলে জুলাই সনদসহ সংস্কারের দিকগুলো বাস্তবায়নের জন্য চূড়ান্ত হয়ে যাবে ।
“এরপরেও কিছু বিষয় থাকবে যেগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই সবাই একমত নাও হতে পারে। সে বিষয়গুলো আমরা জনগণকে অবহিত করবো,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী দশ মাসেই সরকারকে সংস্কার কার্যক্রমে বড় অগ্রগতি অর্জন করতে হবে। আবার বিচারের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল করা হলেও কথা উঠছে ‘গ্রহণযোগ্য বিচার’ কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে তা নিয়েও।
সাইফুল আলম চৌধুরী বলছেন, একটা নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রণয়নসহ অন্তত দশটা কাজ করতে হয় নির্বাচন কমিশনকে কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ কিছুটা করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি এখনো।
যদিও নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানের মাছউদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় যে সময়সীমা দেয়া হয়েছে তার মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে প্রস্তুত আছে কমিশন।

ছবির উৎস, Getty Images
আওয়ামী লীগ ও অন্তর্ভুক্তির চ্যালেঞ্জ
সম্প্রতি ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস বলেছেন, তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক বলতে দলের নয়, সব ভোটারের অংশগ্রহণের কথা বুঝিয়ে থাকেন।
অর্থাৎ সব পর্যায়ের ভোটাররা যেন নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পায়।
যদিও বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্য নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগের ভোটের হার ৩০-৪০ শতাংশ। এখন দলটিকে নিষিদ্ধের পর তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে নির্বাচনকে কিভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক করা যাবে সেই চ্যালেঞ্জও এই অন্তর্বর্তী সরকারকেই নিতে হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
জোবাইদা নাসরীন বলছেন, আওয়ামী লীগ আমলেও বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন করা গেছে কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে সেগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মেনে নিলেও মানুষ গ্রহণ করেনি।
“এখন সরকার একটি দলকে নিষিদ্ধ করেছে, যেই দলটির এখনো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জনসমর্থন আছে। এই জনগোষ্ঠীকে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কীভাবে নিশ্চিত করা হবে – সেটা সরকারকেই ঠিক করতে হবে,” বলছিলেন তিনি।
আর সাইফুল আলম চৌধুরী বলছেন, আওয়ামী লীগ সমর্থক ভোটারদের বাদ দিয়ে কিভাবে এই নির্বাচনটি হবে- এটিও বড় একটি চ্যালেঞ্জ হবে সরকারের জন্য।
“একটা বড় অংশ ভোটার ও তাদের দলকে বাইরে রেখে নির্বাচন উৎসবমুখর কতটা কীভাবে করা হয় সেটাও দেখতে হবে,” বলছিলেন তিনি।