Source : BBC NEWS
মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলা আওয়ামী লীগ অফিস। স্থানীয় ঘোড়দৌড় বাজারের পাশে অফিসটির একরকম বিধ্বস্ত অবস্থা। দ্বিতল ভবনের পুরোটাতেই ভাঙচুরের চিহ্ন স্পষ্ট।
মূল ফটকে ঝুলছে তালা। ভেতরে পড়ে আছে আসবাবপত্রের ধ্বংসাবশেষ। অফিস জনমানবশূন্য।
অফিসের সামনে যেতেই ভিড় করলেন বাজারের লোকজন। দৃষ্টিতে কৌতূহল।
তাদের সঙ্গে কথা বলতেই জানা গেলো একসময় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের আনাগোনায় ভরপুর থাকতো অফিস প্রাঙ্গণ।
“প্রচুর লোক আসতো। রমরমা অবস্থা। এখন কেউ আসে না,” বললেন অহিদুল ইসলাম নামে একজন।
কেন আসে না এমন প্রশ্নে তার উত্তর, “সবাইতো পলাইছে। কেউ গ্রামে নাই। একটা নেতাও নাই।”
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে পাওয়া যাচ্ছে, মুন্সিগঞ্জে দলটির বেশিরভাগ নেতাই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। কেউ ঢাকায় কেউবা বিদেশে। বাকিদের কেউ কারাগারে আর কেউ এলাকায় আছেন স্থানীয়দের ভাষায় ‘টাকা-পয়সা খরচ করে বিভিন্নজনকে ম্যানেজ করার’ মাধ্যমে।
মুন্সীগঞ্জের লোৗহজং, শ্রীনগর এবং সদর উপজেলা- সবখানে ঘুরেই একইচিত্র পাওয়া গেলো। এমনকি প্রকাশ্যে ক্যামেরার সামনে কথা বলার মতো কোনও নেতাকেও পাওয়া গেলো না।
এই অবস্থা কমবেশি সারাদেশেই। মূলত বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ। প্রকাশ্যে নেই নেতা-কর্মীরা, দলীয়ভাবে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি বা নির্দেশনাও নেই তৃণমূলে।
এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলটির সব স্তরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে প্রথমবারের মতো ভার্চুয়াল মিটিংয়ে বসতে যাচ্ছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। উদ্দেশ্য নেতা-কর্মীদের সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় করে তোলা।
দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম বলছেন, অচিরেই দলের পক্ষ থেকে কর্মসূচি দেয়া হবে। ‘ধাপে ধাপে কর্মসূচিতে হরতালের কথাও চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।’
কিন্তু তৃণমূলে যে দুর্বল অবস্থা সেখানে দলকে চাঙা করা চ্যালেঞ্জ হবে বলেই অনেকে মনে করেন।
রাজনীতি বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, গণঅভ্যুত্থানে পতন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ দল হিসেবে জনগণের মুখোমুখি কীভাবে হবে সেটা হচ্ছে দলটির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, “চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আওয়ামী লীগ জনগণের সামনে কীভাবে আবার দাঁড়াবে। মানে কী কৌশল নিয়ে দাঁড়াবে, কী বার্তা নিয়ে নিয়ে দাঁড়াবে, কী উদ্দেশ্য নিয়ে দাঁড়াবে এবং কী কর্মসূচি নিয়ে দাঁড়াবে। আবার জনগণের সামনে আসলেও জনগণ তাদের বার্তাকে কীভাবে নেবে এগুলো এখনও অনিশ্চিত।”
তৃণমূলে কী অবস্থা আওয়ামী লীগের?
আওয়ামী লীগের একটি জেলার ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা তোরাব আলী। এটি তার ছদ্মনাম।
মি. আলী গত ৫ই অগাস্টের পর থেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিশেষত রাতে বাসায় থাকেন না। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তার সঙ্গে কথা হয়।
মি. আলী জানাচ্ছেন, দলের কোনও খোঁজখবরই তার কাছে নেই।
“সবাইতো আছি দৌড়ের উপরে। দলের কাজ-কাম নিয়া আমাগো কোনও পরিকল্পনা নাই। নিউট্রাল অবস্থায় আছি। কারও সঙ্গেই যোগাযোগ হয় না আর কেউ নাইও।”
তৃণমূলের এই নেতা দলের নির্দেশনা নিয়ে অন্ধকারে আছেন। তবে তার চেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন তার ভাষায় ‘নিজ দলের কিছু দুর্নীতিবাজ নেতাদের’ উপর। বলছেন, খারাপ লোকদের দল থেকে ‘বের করতে হবে’।
“যে নির্যাতন এখন আমরা হইতেছি, এটা নিয়া ভাই বহু দুঃখ মনের মধ্যে। অনেক সময় সারাদিন চোখের পানি ফেলি। মনে মনে ভাবি দুর্নীতিবাজ নেতা যারা অন্যায় করছে, তাগো জন্য এখন পলায়া থাকতে হয়, জেল খাটতে হয়, রাইতে বাগানে থাইকা মশার কামড় খাইতে হয়, মামলা খাইতে হয়। কিন্তু কেন আমি এইসব ভোগ করুম?”
“যারা দুর্নীতি করছে, ওদের জন্যে আমার অশান্তি। ওরা যদি দলের ভেতর থাকে, তাইলে আমরা আর এর মধ্যে মাথা ঘামামু না। দলের পরিশুদ্ধ করা লাগবো, ম্যান বদলানো লাগবো।”
এই ব্যক্তি এমনকি রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার কথাও ভাবছেন।
তবে সবাই যে এমন অবস্থায় আছেন তা নয়। ক্ষোভ থাকলেও সাংগঠনিক নির্দেশনার অপেক্ষাতেও আছেন অনেকে।
তাদেরই একজন আওয়ামী লীগের একটি অঙ্গ সংগঠনের নেতা এরশাদুল বারী (ছদ্মনাম)।
“উনারা (দলের শীর্ষ নেতারা) যে আমাদের কোনও দিক-নির্দেশনা না দিয়ে চলে গেলো এবং এর পরে প্রায় চার/পাঁচ মাস কোনও খোঁজ-খবর রাখে নাই। অথচ উনারা সেইফ জোনে আছে। এটা আমাদের কর্মীদের মধ্যে একটা হতাশা তৈরি করেছে। কিন্তু এখন আবার পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। এখন অনেকেই খোঁজ-খবর নিচ্ছেন।”
কিন্তু কী করতে হবে সে বিষয়ে দলীয় কোনও নির্দেশনা কি পেয়েছেন এমন প্রশ্নে নির্দেশনা পাওয়ার কথা জানাচ্ছে মি. বারী।
“নির্দেশনা হচ্ছে আগে নিজেকে সেইফ রাখতে হবে। প্রস্তুত হতে হবে এবং ধৈর্য্য ধরতে হবে। আমাদের অঙ্গ সংগঠনের সভাপতি আমাকে ফোন করেছিলেন। এটাই বলেছেন তিনি। এরপর জানতে পেরেছি অচিরেই দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা আপা বক্তব্য দেবেন, ভার্চুয়াল মিটিং হবে। সেখানে আমাদের জুমে কানেক্ট হতে বলেছেন। সেখানে আপা (শেখ হাসিনা) যে নির্দেশনা দেবেন, তার আলোকে কাজ করতে হবে।”
নেতারা প্রকাশ্যে নেই, কর্মীরা কীভাবে সামনে আসবে?
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর পর ধাপে ধাপে তাকে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে প্রকাশ্যে আসতে দেখা গেছে। যদিও প্রকাশ্যে আসা বলতে ফোনালাপ এবং বিবৃতির মাধ্যমে বক্তব্য দেয়া।
প্রথমবারের মতো শেখ হাসিনা ফোনালাপের মাধ্যমে নেতা-কর্মীদের সামনে আসেন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক সপ্তাহ পর গত ১২ই অগাস্ট। সেসময় একটি জেলার আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে তার কথোপকথন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন দলের নেতারা।
এরপর মাসখানেক ধরে শেখ হাসিনা কথা বলেছেন মূলত বিভিন্ন এলাকার তৃণমূলের অপরিচিত নেতাদের সঙ্গে। এসব ফোনালাপ পরে প্রকাশ পেয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে।
তবে তৃতীয় ধাপে এসে তাকে প্রথমবারের মতো কথা বলতে দেখা যায় দলীয় কোনও ফোরামে। যেটা শুরু হয় গত সেপ্টেম্বর মাসে।
মূলত প্রবাসী আওয়ামী লীগের বৈঠকে ভার্চুয়ালি যোগ দেন তিনি। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতাদের বৈঠকে টেলিফোনে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
সর্বশেষ এখন দলের দেশে এবং বাইরে অবস্থানরত সব স্তরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে শেখ হাসিনার ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বলে খবর দিচ্ছেন দলের নেতা-কর্মীরা। এই বৈঠকের উদ্দেশ্য দলকে সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় করা।
কিন্তু দেশের ভেতরে যেখানে দলের কোনও নেতাকে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না সেখানে দল কীভাবে সংগঠিত হবে সেটা একটা প্রশ্ন।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম অবশ্য জানাচ্ছেন, নেতারা আত্মগোপনে থাকলেও সেটা দলের কার্যক্রমে বাধার কারণ হবে না।
কিন্তু নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধেই যখন তৃণমূলে ক্ষোভ তখন সেটা নিয়ে কী ভাবছে দল? এমন প্রশ্নে দলে পরিবর্তনের কথা বলেছেন তিনি।
“আমাদের ভিতরে যারা খারাপ আছে, গণধিকৃত যারা, যাদের দেশের জন্য কাজ করার যোগ্যতা নেই, তাদেরকে তো স্বাভাবিকভাবেই বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করতে হবে। যেখানে আওয়ামী লীগের ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, সেগুলো আলোচনা করে দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েই দলীয় সভানেত্রীর নেতৃত্বে আমরা সংশোধন করবো, সংযোজন করবো, প্রয়োজনে বিয়োজন করা হবে।”
বাহাউদ্দিন নাসিম জানাচ্ছেন, উপজেলা-জেলার তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে ইতোমধ্যেই দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা যোগাযোগ করেছেন, কথা বলেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন।
কর্মসূচি কী হবে?
আওয়ামী লীগ নেতা বাহাউদ্দিন নাসিম বলছেন, দলের নেতা-কর্মীরা ‘কর্মসূচি চায়’।
তবে কী কর্মসূচি আসবে সেটা স্পষ্ট না করলেও তিনি জানিয়েছেন হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচির কথাও আলোচনা হয়েছে দলীয় ফোরামে।
“ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি আমাদের আছে। নেতা-কর্মীরা কর্মসূচি চায়। অচিরেই আমাদের কর্মসূচি আসবে। তবে এটা আসবে ধাপে ধাপে। এভাবে শেষ পর্যন্ত হরতালের কর্মসূচিতেও যাওয়ার চিন্তুা-ভাবনা আছে আমাদের।”
‘জনগণের সামনে যাওয়াই হবে বড় চ্যালেঞ্জ’
আওয়ামী লীগ বলছে, কর্মসূচির মাধ্যমে সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় হওয়ার কথা। সেরকম পরিস্থিতিও দেখছেন দলের নেতারা। যদিও বাস্তবে দলটির জন্য নানা চ্যালেঞ্জ দেখছেন বিশ্লেষকরা।
এক. প্রশাসনিক বাধা, গ্রেপ্তার এবং মামলার আতঙ্ক আছে নেতা-কর্মীদের মধ্যে।
দুই. অভ্যুত্থানের পর দলটির ভঙ্গুর সাংগঠনিক কাঠামো।
তিন. দলীয় নেতাদের অনুপস্থিতি।
চার. গণহত্যার অভিযোগ।
তবে এসবের মধ্যেই রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দেখছেন, দলটি জনগণের মুখোমুখি কীভাবে হবে তা নিয়ে।
“চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আওয়ামী লীগ জনগণের সামনে কীভাবে আবার দাঁড়াবে। কী কৌশল নিয়ে দাঁড়াবে, কী বার্তা নিয়ে নিয়ে দাঁড়াবে, কী উদ্দেশ্য নিয়ে দাড়াবে এবং কী কর্মসূচি নিয়ে দাঁড়াবে। আবার জনগণের সামনে আসলেও জনগণ তাদের বার্তাকে কীভাবে নেবে সেটা দেখার বিষয়,” বলেন জোবাইদা নাসরীন।
তার মতে, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু তাদের জন্য পরিস্থিতি এখন বেশ কঠিন।
“একটা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যখন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়, তখন এরকম একটি দলকে জনগণের কাছে নানারকম জবাবদিহিমূলক অবস্থায় থাকতে হয়। তো সেখানে আওয়ামী লীগ জনগণকে কীভাবে ফেইস করবে, কীভাবে আসলে জনগণের কাছে রাজনৈতিক বার্তা নিয়ে যাবে, সেটা কিন্তু তাদের জন্য রাজনৈতিক দল হিসেবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এই মুহূর্তে।”
আওয়ামী লীগের জন্য বাস্তবতা প্রতিকূল তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
এমনকি গত ৫ই অগাস্টের পর দলটিকে নিষিদ্ধ করার মতো দাবিও উঠেছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে।
যদিও কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আবার এর বিরোধিতাও করেছে।
তবে আদালতে জুলাই গণহত্যার বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে বিচারিকভাবেই নিষিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি আছে আওয়ামী লীগের। ফলে তেমন পরিস্থিতিতে পড়ার আগেই কর্মসূচি বাস্তবায়নের মতো সাংগঠনিক অবস্থা তৈরি করতে চায় আওয়ামী লীগ।
দলটি মনে করছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে তাদের ভাষায় ‘জনরোষ এখন সময়ের ব্যাপার’।
ফলে বিভিন্ন ইস্যুতে মাঠে নামার পর সেখানে জনসমর্থন পাওয়া যাবে বলেই আশাবাদী আওয়ামী লীগ। যদিও রাজনীতির জটিল সমীকরণ যে এতো সরলভাবে মিলে যাবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।