Source : BBC NEWS

ফ্রান্সের কাছ থেকে ২৬টা রাফাল-এম যুদ্ধবিমান কিনছে ভারত- ফাইল ছবি।

ছবির উৎস, ANI

ফ্রান্সের কাছ থেকে ২৬টা রাফাল-মেরিন যুদ্ধবিমান কিনছে ভারত। এই চুক্তির বিষয়ে সে দেশের সঙ্গে কথা বার্তা আগেই চূড়ান্ত হয়েছিল। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে এমন একটা সময়ে যখন পহেলগামে পর্যটকদের উপর হামলাকে কেন্দ্র পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের উত্তেজনা তুঙ্গে।

সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, ৭৪০কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করে ফ্রান্স থেকে যুদ্ধবিমান কিনছে ভারত।

এই যুদ্ধবিমান আইএনএস বিক্রান্ত থেকে পরিচালিত হবে। পুরানো যুদ্ধবিমানগুলোকে ধীরে ধীরে সরিয়ে দিয়ে এই আধুনিক যুদ্ধজাহাজ ব্যবহার করার কথা ভাবা হয়েছে।

ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “এই বিমানগুলো সরবরাহের কাজ ২০৩০ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে। ক্রুদের ফ্রান্স এবং ভারতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।”

ফরাসি প্রতিরক্ষা সংস্থা ‘ডাসোঁ এভিয়েশন’-এর কাছ থেকে এই বিমান কিনছে ভারত।

এখন প্রশ্ন হলো ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও ‘আঁটসাঁটো’ করার নেপথ্যে কারণ কী?

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক রাফাল চুক্তি ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে তোলার দিকে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং সিনিয়র সাংবাদিক কমার আঘা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই চুক্তি ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও আধুনিকতম প্রযুক্তির মাধ্যমে আরও মজবুত করে তুলবে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর কাছে ইতিমধ্যে রাফাল যুদ্ধবিমান রয়েছে। এখন নৌবাহিনীর কাছেও তা থাকবে।”

যুদ্ধবিমান ভারতে আসতে এবং ব্যবহার শুরু হতে আরো কয়েক বছর লাগলেও, এই চুক্তি স্বাক্ষর করা একাধিক কারণে বিশেষ ইঙ্গিতবহ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে রাফাল চুক্তির পিছনে ভারতের দীর্ঘমেয়াদী ভাবনা রয়েছে।

অবসরপ্রাপ্ত ফাইটার এয়ারক্র্যাফ্ট পাইলট এবং প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ প্রফুল্ল বক্সী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “এই চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানের কাছে একটা বার্তা তো যাবেই পাশাপাশি, চীনের কাছেও একটা বার্তা পৌঁছাবে।”

“চীনের তরফে ভারতের জন্য তৈরি হওয়া ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি এবং পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কথা মাথায় রেখেও এই চুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

আরও পড়তে পারেন
দুই দেশের মধ্যে সোমবার এই যুদ্ধবিমান কেনার বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর হয়।

ছবির উৎস, ANI

রাফাল-এম চুক্তি স্বাক্ষর

ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব রাজেশ কুমার সিং এবং ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত থিয়েরি ম্যাথোয়ের সভাপতিত্বে সোমবার দিল্লিতে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

প্রসঙ্গত, এই চুক্তির আওতায় থাকা ২৬টা যুদ্ধবিমানের মধ্যে ২২টা সিঙ্গেল সিটার এবং চারটে ডবল সিটার হবে বলে জানা গিয়েছে।

ভারতে রাফাল বিমানের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন এবং রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ও এই চুক্তির অন্তর্গত। এর ফলে বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে বলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছে।

ভারতীয় বিমানবাহিনীর কাছে ইতিমধ্যেই ৩৬টা রাফাল যুদ্ধবিমান রয়েছে। সাম্প্রতিক চুক্তি হয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীর কথা মাথায় রেখে রাফাল-এম বা রাফাল মেরিনের জন্য। এই যুদ্ধবিমান সমুদ্রে এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ারের সাহায্যে অপারেট করা হয়।

ভারতের ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি-র সাবেক ডেপুটি ডাইরেক্টর জেনারল মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) গগনজিত সিং বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ভারতের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে প্রতিরক্ষা খাতের আধুনিকীকরণ একটা উল্লখযোগ্য পদক্ষেপ। এর আগে বিমান বাহিনীর প্রধান ভারতে যুদ্ধবিমানের ঘাটতির বিষয়ে জানিয়েছিলেন। আমি মনে করি সাম্প্রতিক এই পদক্ষেপ (রাফাল) দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও সমৃদ্ধ করবে।”

অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডর প্রফুল্ল বক্সীও এই চুক্তির গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “এই ২৬টা রাফাল যুদ্ধবিমানের চুক্তি ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য। এখন প্রশ্ন হলো বিমানবাহিনী থাকা সত্ত্বেও নৌবাহিনীর কেন এয়ার আর্ম দরকার?”

“আসলে, নৌবাহিনীর জন্য এয়ারক্র্যাফ্ট ক্যারিয়ার থাকার একাধিক কৌশলগত সুবিধা রয়েছে। নৌবাহিনী যতই মজবুত হোক না কেন, সমুদ্রে মোতায়েন বাহিনীর প্রতিরক্ষা তখনই আরও মজবুত হয় যখন এই জাতীয় ক্যারিয়ার জাহাজে উপস্থিত থাকে।”

এক্ষেত্রে একাধিক কৌশলগত সুবিধাকে বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। তার কথায়, “এয়ারক্র্যাফ্ট ক্যারিয়ার বা ফাইটার এয়ার ক্র্যাফ্ট ক্যারিয়ার জাহাজকে সুরক্ষিত রাখতে, বিপক্ষের জাহাজকে প্রতিহত করতে এবং প্রয়োজনে প্রতিপক্ষের জাহাজ ধ্বংস করতে সাহায্য করে।”

“মিসাইল নিক্ষেপ করেও এমনটা সম্ভব কিন্তু জাহাজে এয়ারক্র্যাফ্ট ক্যারিয়ার উপস্থিত থাকলে রেঞ্জ বেড়ে যাওয়ার ফলে প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করাটা সহজ হয়ে যায়।”

আইএনএস বিক্রান্ত।

ছবির উৎস, Getty Images

কেন গুরুত্বপূর্ণ এই চুক্তি?

ভারত গত কয়েক দশক ধরে নিজেদের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনাকে চারদিক থেকে মজবুত করার চেষ্টা করে এসেছে। বিশ্বের সামরিক শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে একাধিক দেশের সঙ্গে এই খাতে বিভিন্ন চুক্তিও হয়েছে।

মি. বক্সী ব্যাখ্যা করেছেন, “প্রতিরক্ষার কথা ভেবেই কিন্তু ‘৬০ দশকে এয়ারক্র্যাফ্ট ক্যারিয়ার আনা হয়। তারপর হ্যারিয়ার জাম্পজেট, মিরাজ, এমআইজি ২৯কে থেকে শুরু করে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে একদিক নয় সমস্তদিক থেকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। বিমানবাহিনীর কাছে ইতিমধ্যে রাফাল যুদ্ধবিমান ছিল এখন তা নৌবাহিনীর কাছেও থাকবে।”

প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও আধুনিকীকরণ প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সিনিয়র সাংবাদিক ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ মনোজ যোশীর কথায়, “বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনীর কাছে একই ধরনের যুদ্ধবিমান থাকার ফলে তাদের মধ্যে সমন্বয় বাড়বে। এই যুদ্ধবিমানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রেও সুবিধা হবে।”

মি. বক্সী আবার বলেছেন,, “ফ্রান্সের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক পুরানো। সে দেশের সঙ্গে এর আগেও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে চুক্তি হয়েছে। কাজেই সেই দিক থেকে দুই দেশের সম্পর্কের কথা মাথায় রেখেও এই চুক্তির গুরুত্ব আছে।”

বিবিসি বাংলায় আরও পড়তে পারেন
চীন ও পাকিস্তানের ‘নৈকট্য’ ভারতের কাছে উদ্বেগের কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

ছবির উৎস, Getty Images

চীন ও পাকিস্তান

সাম্প্রতিক এই চুক্তি চীন এবং পাকিস্তানকে ‘মোকাবিলা’ করতে সাহায্য করবে কি না জানতে চাওয়া হলে মি. যোশী বলেছেন, “আমার মনে হয় পাকিস্তানকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে এই যুদ্ধবিমান বেশি কার্যকরী হবে।”

মি. বক্সী অবশ্য ভিন্ন মত পোষণ করেন। তার কথায়, “চীনকে মোকাবিলা করতে অবশ্যই এই চুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তাই নয়, বর্তমান আবহে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, সেই সমীকরণের দিক থেকেও এই চুক্তি উল্লেখযোগ্য।”

সাউথ এশিয়ান পলিটিক্স এন্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিস-এর গবেষক এবং মানব রচনা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ রিসার্চ অ্যান্ড স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক উপমন্যু বসুর মতে এই চুক্তির পিছনে ভারতের দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা ভাবনা রয়েছে।

তিনি বলেছেন, “ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের উপস্থিতির বিষয় ভারত অনেক আগে থেকেই সতর্ক ছিল। সেকথা মাথায় রেখেই কিন্তু নৌবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আগে থেকেই মজবুত করার বিষয়ে মনোনিবেশ করেছে ভারত।

“এখানে পাকিস্তান কিন্তু সরাসরি ঝুঁকি নয়। বরং বড় ঝুঁকি হলো চীন।”

তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, চীনের কথা মাথায় রেখেই ভারত নিজেদের আরও মজবুত করছে।

“চীন কিন্তু ইন্দো-প্যাসিফিকে নিজেদের অস্তিত্বের বিষয়ে সরব। চীনকে মোকাবিলা করতে হলে ভারতকে ওই অংশে নৌবাহিনীকে জোরদার করতে হবে,” বলেছেন তিনি।

একইসঙ্গে তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সমীকরণকেও টেনে এনেছেন। তার কথায়, “পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে চীন চায় পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা থাকুক, বিশেষত চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের কথা মাথায় রেখে। তাই, পাকিস্তানের অন্দরেও যে অস্থিরতা রয়েছে, সেটা চীন চায় না।”

“এই সমস্ত বিষয়গুলো মাথায় রাখলে এবং সন্ত্রাসের বিষয়টা বাদ দিলে আমার মনে হয়, পাকিস্তানের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদে চীন ভারতের জন্য বেশি ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠতে পারে। আর তাই রাফাল চুক্তি চীনকে মোকাবিলা করতে সহায়তা করতে পারে বলে আমার মনে হয়।”