Source : BBC NEWS

মনোযোগ দিয়ে খাওয়া মস্তিষ্ক ও পেটের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে

ছবির উৎস, Getty Images

এক ঘন্টা আগে

“আস্তে আস্তে খাও!”, “মন দিয়ে খাও”, “খাওয়ার মাঝে কথা বলতে হয় না” – এই কথাগুলো আমরা অনেকেই ছোটবেলায় খাওয়ার সময় শুনেছি। যারা এই কথাগুলো বলতেন তারা যে ঠিকই বলতেন সেটা এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

মনোযোগ দিয়ে খাওয়া, ধীরে ধীরে চিবানো মস্তিষ্ক এবং পেটের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে।

খাদ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ লেসলি হেইনবার্গ, দ্রুত খাওয়া ও ধীর গতিতে খাওয়ার স্বাস্থ্যগত দিক দিয়ে দীর্ঘ সময় গবেষণা করেছেন।

সেখান থেকে তিনি জানতে পেরেছেন শুধু সময় নিলে খেলে অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা পাওয়া সম্ভব।

এখন আপনি দ্রুত খান নাকি ধীরে ধীরে খান সেটা কীভাবে বুঝবেন। এক্ষেত্রে একটা সহজ থিওরি আছে।

কোনো কিছু খাওয়ার পরে আমাদের পেট ভরেছে কিনা আমাদের পাকস্থলী মস্তিষ্কে সেই সিগনাল পাঠাতে ২০ মিনিট সময় নেয়।

এর মানে দ্রুত খাওয়া বলতে বোঝায় কেউ যদি খাবার খেতে ২০ মিনিটের কম সময় নেয়।

বেশি সময় ধরে খেলে, অর্থাৎ ২০ মিনিট বা তার বেশি সময় নিলে খাবার ভালো হজম হয়, পেট বেশিক্ষণ ভরা থাকে, এটা ওটা খাওয়ার প্রবণতা কমে যায় এ কারণে সঠিক ওজন বজায় রাখা সহজ হয়।

অন্যদিকে দ্রুত খেলে ভালোভাবে চাবানো হয় না, একবার গ্রাস খাওয়ার পর আরেকটি গ্রাস নেওয়ার মধ্যে বিরতি দেয়া হয় না।

তাছাড়া ব্রেনও পেট ভরার সিগন্যাল পায় না। এতে যেটা হয় বেশি বেশি খাওয়া হয়ে যায় এবং শরীর ভারী লাগে।

এই দ্রুত খাওয়ার কয়েকটি কারণ আছে, একটি হলো ব্যস্ততা বা কাজের চাপ। অনেকে মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা থেকেও দ্রুত খেয়ে থাকেন।

আবার দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে, কঠোর ডায়েট ফলো করলে অনেক ক্ষুধা লাগে এবং দ্রুত খাওয়া হয়।

কিন্তু দ্রুত খাওয়ার ফলে খাবার আনন্দ নিয়ে বা খাবারটা উপভোগ করে খাওয়ার হয় না। এতে হজমের সমস্যাসহ নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দেয়।

আরও পড়তে পারেন
হজমে সমস্যা

ছবির উৎস, Getty Images

হজমে সমস্যা

খাবার ভালোভাবে চিবিয়ে খাওয়া হজম প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে জানিয়েছেন পুষ্টিবিদ তাসনিম চৌধুরী।

দ্রুত খাওয়ার সময় বড় বড় গ্রাস নিয়ে কম চিবিয়ে সেটা গিলে ফেলা হয়। এতে খাবারগুলো বড় বড় টুকরো আকারে পাকস্থলীতে পৌঁছায়।

এই খাবারগুলোকে ভাঙতে পরিপাকতন্ত্রের ওপর বেশি চাপ পড়ে। এতে নানা বিপাকীয় সমস্যা দেখা দেয়।

ওজন বৃদ্ধি

ছবির উৎস, Getty Images

ওজন বৃদ্ধি

দ্রুত খাওয়ার অভ্যাস অনিচ্ছাকৃত ওজন বৃদ্ধির একটি বড় কারণ।

হারবার্ট হেল্থ পাবলিকেশন্সের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা খুব দ্রুত খান তাদের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাওয়া হয়। কারণ মস্তিষ্ক ২০ মিনিটের আগে বুঝতে পারে না যে পাকস্থলী পর্যাপ্ত খাবার পেয়েছে।

ফলে বেশি খাওয়া হয়, শরীরে ক্যালোরিও যায় বেশি। এতে ওজন বাড়ে।

গ্রিসের লাইকো জেনারেল হাসপাতালের গবেষণায় দুটি দলকে আইসক্রিম খেতে দেয়া হয়। এক দলকে বলা পাঁচ মিনিটের মধ্যে খেতে। আরেক দলকে বলা হয় আধা ঘণ্টা ধরে ধীরে ধীরে খেতে।

দেখা যায়। যারা আস্তে আস্তে খেয়েছে তাদের শরীর থেকে এমন এক হরমোন নিঃসরণ হয়েছে যা আমাদের পেট ভরা থাকার সিগনাল দেয়। ফলে পরিমিত খাবারেও পেট ভরা থাকার অনুভূতি হয়।

২০১৮ সালে চীনে জাতীয় পর্যায়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সাত থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের স্থূলতার বড় কারণ ছিল তাদের দ্রুত খাওয়ার অভ্যাস।

এক হাজার মানুষের ওপর পাঁচ বছর ধরে চালানো এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে যারা দ্রুত খান তাদের স্থূলতা, হাই প্রেশার, হাই ব্লাড সুগার, হাই ট্রাইগ্লিসারাইড, পেটের চর্বি এবং অস্বাভাবিক কোলেস্টেরল মাত্রার মতো স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ভোগার হার, ধীরে ধীরে খাওয়া মানুষদের চাইতে ১১ শতাংশ বেশি।

এসব কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।

অম্লভাব ও হার্টবার্ন

ছবির উৎস, Getty Images

অম্লভাব ও হার্টবার্ন

দ্রুত খেতে গিয়ে বদহজম ও হার্টবার্ন অর্থাৎ বুক জ্বালাপোড়ার মতো সমস্যা হতে পারে বলে জানিয়েছেন পুষ্টিবিদরা।

দ্রুত খাওয়ার ফলে আপনি বাতাস গিলে ফেলতে পারেন এতে পেট ফুলে ভারি হয়ে যায়, অস্বস্তি লাগে, গ্যাসের সমস্যা তৈরি হয়, টক ঢেকুর আসে।

এছাড়া, বেশি খাবার খাওয়ার ফলে পাকস্থলী অতিরিক্ত অ্যাসিড উৎপন্ন করে, যার কারণে বুকে জ্বালাপোড়া হয়।

পুষ্টি শোষণে ঘাটতি

দ্রুত খাওয়ার ফলে শরীর খাবার থেকে পুষ্টি যথাযথভাবে শোষণ করার সময় পায় না বলে পুষ্টিবিদ তাসনিম চৌধুরী জানিয়েছেন।

এতে করে আপনি পুষ্টিকর খাবার খেলেও সেই খাবারের ভিটামিন, মিনারেলস বা অন্যান্য পুষ্টি শরীরে কোনো কাজে লাগে না।

টাইপ টু ডায়াবেটিস

ছবির উৎস, Getty Images

টাইপ টু ডায়াবেটিস

জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা টাইপ টু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৫০ হাজার জনের বেশি মানুষকে দ্রুত, স্বাভাবিক এবং ধীর গতিতে খাওয়ার শ্রেণিতে ভাগ করে তাদের তথ্য বিশ্লেষণ করেন।

দেখা যায়, যারা ১০ মিনিটের মধ্যে তাদের খাবার খেয়েছেন তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা খুব দ্রুত বেড়েছে।

অথচ একই খাবার ‘সময় নিয়ে খাওয়ার’ কারণে অন্যদের রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়েছে অনেক কম।

পুষ্টিবিদদের মতে, দ্রুত খেলে রক্তচাপও বেড়ে যায় আর রক্তচাপ বাড়লে শরীরে ইনফ্লামেশন, টাইপ টু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ে।

দ্রুত খেলে ইনসুলিন নিঃসরণও কমে যায় যা টাইপ টু ডায়বেটিস হওয়ার বড় কারণ। এখন যাদের শুরু থেকেই দ্রুত খাওয়ার অভ্যাস তারা কীভাবে নিজেদের বদলাবেন।

সময় নিন

খাবারের জন্য সময় রাখুন, অন্তত আধা ঘণ্টা। এতে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার আগেই আপনার তৃপ্তি ও পেট ভরার অনুভূতি হবে।

খাবার ভালোভাবে চিবিয়ে খেতে হবে

ছবির উৎস, Getty Images

চিবিয়ে নিন

প্রতিটি গ্রাস সময় নিয়ে ভালোভাবে চিবিয়ে খান। ডা. হেইনবার্গের পরামর্শ প্রতিটি মুখভর্তি খাবার ১৫ থেকে ৩০ বার পর্যন্ত চাবানো উচিত।

প্রতিটি কামড় নেওয়ার পর হাত বা চামচ নামিয়ে রাখুন এতে আরেকটি কামড় নেয়ার তাড়া থাকবে না।

যদি খাবার বেশি শক্ত ও শুকনো মনে হয় তাহলে চাবানোর সময় সামান্য পানি খেয়ে নিন। এতে খাবারটি সহজেই নরম হয়ে যাবে।

খাওয়া

ছবির উৎস, Getty Images

মাইন্ডফুল ইটিং

যখন খাবেন তখন মন দিয়ে উপভোগ করতে খান। একে মাইন্ডফুল ইটিং বলে। ড. হেইনবার্গ একে মাইন্ডফুল ইটিং বলেছেন। যার মানে হলো আমাদের পাঁচ ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে খাওয়া।

অর্থাৎ শুধু খাবারের স্বাদ নয়, বরং এর চেহারা, গন্ধ, গঠন সব কিছু পরখ করে খাওয়া।

আজকাল আমরা অনেকেই খাওয়ার সময় টিভি দেখি, মোবাইল স্ক্রল করি, বই পড়ি। এতে খাওয়ার দিক থেকে মনোযোগ সরে যায়।

তাই মনকে স্থির করে খাবারকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করুন মাইন্ডফুলি খান।

নিজের খাবারটিকে ভালোভাবে দেখুন, এর রং পরখ করুন, খাবারের গন্ধ নিন, খাবারটি হাত দিয়ে ধরুন, স্বাদ নিন, চাবানোর শব্দ অনুভব করুন।

এই ছোট ছোট পরিবর্তন আপনার ধীরে ধীরে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলবে।