Source : BBC NEWS

ছবির উৎস, Reuters
রাতের গভীরে অনেকটা নাটকীয়ভাবে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের মোট নয়টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে ভারত। দেশটির দাবি, “যথাযথ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট জঙ্গি ঘাঁটিতে” এই হামলা চালানো হয়েছে।
প্রায় ২৫ মিনিটের ‘অপারেশন সিন্দুর’ নামক ওই সামরিক অভিযান শুরু হয় ভারতীয় সময় অনুযায়ী রাত একটা পাঁচ মিনিটে এবং চলে রাত দেড়টা পর্যন্ত।
ওই মাঝরাতে বিস্ফোরণের বিকট শব্দে সীমান্তবর্তী অসংখ্য মানুষের ঘুম ভেঙে যায়।
তবে পাকিস্তান জানিয়েছে, ভারত তাদের ছয়টি স্থানে হামলা চালিয়েছে এবং তারা পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ও একটি ড্রোন ভূপাতিত করেছে। যদিও ভারত এ দাবি স্বীকার করেনি।
ইসলামাবাদ বলছে, ভারতীয় বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণে পাকিস্তান অংশে ৩১ জন নিহত ও ৫৭ জন আহত হয়েছে। অন্যদিকে, ভারত বলছে যে পাকিস্তানের পাল্টা গোলাবর্ষণে তাদের অংশেরও ১৫ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে।
পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যকার এই সংঘাতের কারণ, গত এপ্রিল মাসে ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলা।
ভারত ওই হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী ও বহিঃশক্তিদের দায়ী করেছে।
তবে পাকিস্তান তাদের বিরুদ্ধে আনা ভারতের ওই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে এবং বলেছে যে ভারত এই দাবির স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি।

ছবির উৎস, Anadolu via Getty Images
এই হামলার পর পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে?
২০১৬ সালে জম্মু-কাশ্মীরের উরিতে হামলার ঘটনায় ১৯ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছিলো। তখন ভারত লাইন অব কন্ট্রোল তথা নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ চালিয়েছিলো।
এর তিন বছর পর, অর্থাৎ ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলায় ৪০ জন ভারতীয় আধাসামরিক সদস্য নিহত হলে ভারতও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বালাকোটে বিমান হামলা চালায়।
১৯৭১ সালের পর সেবারই প্রথম পাকিস্তানে ওই ধরনের অভিযান চালানো হয়। তার জবাবে পাকিস্তানও পাল্টা বিমান হামলা চালায় এবং আকাশে দুই দেশের যুদ্ধবিমান অবস্থান নেয়।
কিন্তু এবার ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পাহেলগামে হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ভারত যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা আগের চেয়ে অনেক বিস্তৃত, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভারতের মতে, ভারত শুধু তিনটি পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর অবকাঠামোকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।
সেগুলো হলো—লস্কর-ই-তৈয়বা, জইশ-ই-মোহাম্মদ ও হিজবুল মুজাহিদিন।
ভারতের ভাষ্যমতে, তাদের বিমান বাহিনী পাকিস্তান ও পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মোট নয়টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। সবচেয়ে কাছের লক্ষ্য ছিল শিয়ালকোটে, যার অবস্থান সীমান্ত থেকে মাত্র ছয় থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে।
সবচেয়ে জোরালো হামলা চালানো হয়েছে বাহাওয়ালপুরে অবস্থিত জইশ-ই-মোহাম্মদের সদর দপ্তরে— যা সীমান্ত থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার ভেতরে।
মুজাফফারাবাদে লস্করের একটি ক্যাম্পেও হামলা চালিয়েছে ভারত, যেটি নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে। ওই ক্যাম্পটির সাথে গত এপ্রিলে ভারত-শাসিত কাশ্মীরে চালানো হামলার সম্পৃক্ততা ছিল বলে জানিয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।

ছবির উৎস, AFP via Getty Images
যদিও ভারতের এই দাবির বিপরীতে পাকিস্তান বলেছে, তাদের ছয়টি স্থানে ভারত হামলা করেছে এবং ওই স্থানগুলোতে কোনো জঙ্গি ঘাঁটির অস্তিত্ব নেই।
ভারতের সামরিক ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবন বলেছেন, এর আগে ভারত পাকিস্তানের যেসব লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করেছে, সেগুলোর চেয়ে এবারের হামলার ধরন বিস্ময়কর।
তার ভাষ্য, “এর আগে বালাকোট হামলার মতো ঘটনাগুলো শুধু পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। এবার ভারত সরাসরি আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানের পাঞ্জাব পর্যন্ত আঘাত হেনেছে। ভারত এবারের অভিযানে বাহাওয়ালপুর, মুরিদকে এলাকায় লস্করের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর অবকাঠামো, সদরদপ্তর এবং ঘাঁটিকে লক্ষ্য করেছে।”
ভারতের সাবেক পাকিস্তান হাইকমিশনার অজয় বিসারিয়া বলেন যে এবারের অভিযান ছিল একটি “বালাকোট-প্লাস প্রতিক্রিয়া।”
এর মাধ্যমে ভারত সুনির্দিষ্ট জঙ্গি ঘাঁটি লক্ষ্য করেছে, আবার একই সঙ্গে এটাও বুঝিয়েছে এই অঞ্চলের এমন পরিণতি হোক, তা ভারত চায় না।
“এবারের অভিযান আগের তুলনায় অনেক বেশি নিখুঁত, লক্ষ্যভেদী এবং সুস্পষ্ট। তাই পাকিস্তানের পক্ষে সেগুলো অস্বীকার করাও কঠিন,” তিনি বলেন।
ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল “প্রতিরোধের বার্তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা” করা।
অধ্যাপক রাঘবন বলেন, “ভারত মনে করছে যে ২০১৯ সালে স্থাপিত প্রতিরোধ শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই, এটিকে আবার জোরদার করতে হবে। তবে যদি আমরা ভাবি যে কেবল প্রতিঘাতই সন্ত্রাসবাদ দমন করতে পারে, তাহলে হামলার পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য আমরা পাকিস্তানকে উসকে দিচ্ছি —যা চলমান পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে।”

ছবির উৎস, AFP via Getty Images
সীমান্ত সংঘাতের দিকে এগোচ্ছে ভারত-পাকিস্তান?
বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশই একটি বিষয়ে একমত যে ভারতের হামলার বিপরীতে পাল্টা প্রতিক্রিয়া করাটা পাকিস্তানের জন্য কেবলমাত্র সময়ের ব্যাপার এখন। তাই, এমতাবস্থায় কূটনীতিই হতে পারে দুই দেশের মধ্যে সংঘাত নিয়ন্ত্রণের একমাত্র চাবিকাঠি।
ভারতের সাবেক পাকিস্তান হাইকমিশনার অজয় বিসারিয়া বলেন, “পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া আসবেই। তাই, এই পরবর্তী ধাপ কীভাবে সামলানো হবে, এটিই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। এমন সংকটকালে কূটনৈতিকভাবে আগানোই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।”
“পাকিস্তানকে শান্ত থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে পাকিস্তানের পাল্টা জবাবের পর কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনা, যাতে দু’পক্ষই উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে ফেলে,” যোগ করেন তিনি।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষক ড. এজাজ হুসাইন মনে করেন, যেহেতু দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই চরম উত্তেজনা চলছে, তাই পাকিস্তানের মুরিদকে ও বাহাওয়ালপুরের মতো স্থানে ভারত ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ করবে, এ বিষয়টি একপ্রকার অনুমেয় ছিল।
তিনি বলেন, “পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বক্তব্য এবং প্রতিশোধ নেওয়ার দৃঢ় অবস্থানের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে ভারতের ওপর পাল্টা হামলার সম্ভাবনা বেশ প্রবল।”
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অ্যাট অ্যালবানি’র ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি মনে করেন, ভারত সামরিক অভিযান চালিয়ে পাকিস্তানের যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি করেছে, তাতে এ বিষয়টি একপ্রকার নিশ্চিত যে পাকিস্তান এই হামলার প্রতিক্রিয়া অবশ্যই জানাবে।
“যদি পাকিস্তান কোনো জবাব না দেয়, তা অর্থ দাঁড়াবে— দিল্লি চাইলেই যেকোনো সময় পাকিস্তানের ওপর হামলা চালাতে পারে আর পাকিস্তান তা মেনেও নেবে। এটি আসলে পাকিস্তানের প্রতিশোধমূলক কৌশলের সম্পূর্ণ পরিপন্থি,” বলেন তিনি।
তবে তিনি মনে করেন যে যেহেতু ভারত সরাসরি সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলোকেই লক্ষ্যবস্তু করেছে, তাই পাকিস্তানও হয়তো কেবল সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে—যদিও সেটি পুরোপুরি নিশ্চিত না।”
তবে ক্রমবর্ধমান সংঘাতের মাঝেও কেউ কেউ আশাবাদী যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই থাকবে।
ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি বলেন, “এই সংকট শুধু পাল্টা হামলা ও নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর গোলাগুলিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে।”
তবে তিনি সতর্ক করেন যে এই মুহূর্তে এটি ২০০২ সালের পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের সবচেয়ে ভয়াবহ সংকট। এটি ২০১৬ বা ২০১৯ সালের চেয়েও ভয়াবহ।

ছবির উৎস, NurPhoto via Getty Images
প্রতিশোধ নেওয়া ছাড়া পাকিস্তানের গতি নেই?
পাকিস্তানের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের হামলার আগে পাকিস্তানে যুদ্ধের উত্তেজনা খুব একটা না থাকলেও পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যেতে পারে।
“আমাদের রাজনৈতিক গণ্ডিতে গভীর ভাঙন দেখা দিয়েছে। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা কারাগারে। ইমরান খানের কারাদণ্ডের ফলে জনসাধারণের মধ্যে সামরিকবিরোধী তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে,” বলেছেন ইসলামাবাদ-ভিত্তিক বিশ্লেষক এবং জেন’স ডিফেন্স উইকলির প্রাক্তন সংবাদদাতা উমর ফারুক।
“আজ, পাকিস্তানের জনগণ ২০১৬ বা ২০১৯ সালের তুলনায় সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করতে অনেক কম আগ্রহী, যুদ্ধের উত্তেজনার স্বাভাবিক ঢেউ লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত। কিন্তু যদি মধ্য পাঞ্জাবে জনমত পরিবর্তিত হয় যেখানে ভারতবিরোধী অনুভূতি বেশি, তাহলে আমরা সামরিক বাহিনীর ওপর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বেসামরিক চাপ বৃদ্ধি দেখতে পাবে এবং এই সংঘাতের কারণে সামরিক বাহিনী আবার জনপ্রিয়তা ফিরে পাবে,” তিনি যুক্ত করেন।
ড. হুসেন একই রকম অনুভূতির প্রতিধ্বনি করেন।
“আমি বিশ্বাস করি ভারতের সাথে বর্তমান অচলাবস্থা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য জনসমর্থন ফিরে পাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্তদের কাছ থেকে, যারা সম্প্রতি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের জন্য এর সমালোচনা করেছেন,” তিনি বলেন।
“সামরিক বাহিনীর সক্রিয় প্রতিরক্ষা অবস্থান ইতিমধ্যেই মূলধারার এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কিছু সংবাদমাধ্যম দাবি করছে যে ছয় বা সাতটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করা হয়েছে।”
“যদিও এই দাবিগুলো স্বাধীনভাবে যাচাইয়ের দাবি রাখে, তবুও এগুলো জনসাধারণের মধ্যে সামরিক বাহিনীর ভাবমূর্তিকে আরও শক্তিশালী করে, যারা ঐতিহ্যগতভাবে বহিরাগত হুমকির সময়ে জাতীয় প্রতিরক্ষার বর্ণনার চারপাশে একত্রিত হয়।”

ভারত ও পাকিস্তান কি সংঘাত থেকে সরে আসতে পারবে?
পহেলগামে হামলার পরপরই ভারত দ্রুত প্রতিশোধমূলক কিছু পদক্ষেপ নেয়।
প্রধান সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করা, পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করা, কূটনীতিকদের বহিষ্কার এবং পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য বেশিরভাগ ভিসা বন্ধ করে দেয় তারা।
উভয় পক্ষের সৈন্যরা হালকা অস্ত্রের গুলি বিনিময় করেছে এবং ভারত তার আকাশসীমা থেকে সব পাকিস্তানি বিমান নিষিদ্ধ করে যা পাকিস্তানের পূর্ববর্তী পদক্ষেপের প্রতিফলন। প্রতিক্রিয়ায়, পাকিস্তান ১৯৭২ সালের শান্তি চুক্তি স্থগিত করে এবং নিজস্ব প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
তবে ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পরও ভারত একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল। সেময় তারা দ্রুত পাকিস্তানের সর্বাধিক পছন্দের দেশের মর্যাদা প্রত্যাহার করে, ভারী শুল্ক আরোপ করে এবং গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ও পরিবহন সংযোগ স্থগিত করে।
ভারত যখন বালাকোটে বিমান হামলা শুরু করে, তার পরে প্রতিশোধমূলক পাকিস্তানি বিমান হামলা এবং ভারতীয় পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে আটক করে, তখন সংকট আরও তীব্র হয়।
তবে সেবার কূটনৈতিক চ্যানেলগুলো অবশেষে উত্তেজনা হ্রাসে সফল হয় এবং পাকিস্তান শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে পাইলটকে মুক্তি দেয়।