Source : BBC NEWS

তেলআবিবে মানুষের উচ্ছ্বাস

ছবির উৎস, Getty Images

এক ঘন্টা আগে

গাজায় ১৫ মাস ধরে চলা সহিংসতার পর যুদ্ধবিরতি চুক্তি রোববার থেকে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে ছয় সপ্তাহের প্রাথমিক যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয় ইসরায়েল ও হামাস। ।

যুদ্ধবিরতি আলোচনার মধ্যস্থতাকারী কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল থানি বলেছেন, ইসরায়েলের পার্লামেন্টে অনুমোদন পাওয়ার পর এই চুক্তি কার্যকর হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, এই চুক্তির ফলে গাজায় লড়াই বন্ধ হবে, ফিলিস্তিনিদের জন্য মানবিক ত্রাণ সহায়তা বাড়বে এবং জিম্মিরা তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যাবে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, চুক্তির অনেক বিষয় চূড়ান্ত করার আগে আরো কাজ বাকি আছে। এই চুক্তিতে জোর দেওয়ার জন্য তিনি জো বাইডেন ও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানান।

হামাস নেতা খলিল আল হাইয়া বলেছেন, ফিলিস্তিনি জনগণের ‘প্রতিরোধের’ ফসল এই চুক্তি।

তিন ধাপের এই চুক্তি গাজায় যুদ্ধবিরতি, সেখান থেকে ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহার এবং হামাসের হাতে বন্দি জিম্মিদের মুক্তি অন্তর্ভুক্ত।

যদিও এখনও গাজায় ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত রয়েছে। বুধবার যুদ্ধবিরতি চুক্তির ঘোষণা আসার পর ইসরায়েলি বিমান হামলায় ২০ জনেরও বেশি নিহত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে হামাসের সিভিল ডিফেন্স এজেন্সি।

বিবিসি বাংলার অন্যান্য খবর
ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজার অনেক এলাকা

ছবির উৎস, Getty Images

চুক্তি কার্যকর হবে তিন ধাপে

কাতারের প্রধানমন্ত্রী ইসরায়েল ও হামাস উভয় পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, হামাসের হাতে আটক ৩৩ জিম্মির মুক্তির পরিবর্তে ইসরায়েলের কারাগারে বন্দি ফিলিস্তিনিদের অনেককে ছেড়ে দেওয়া হবে।

গাজার ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকাগুলো থেকে ইসরায়েলি বাহিনী আরো পূর্ব দিকে সরে যাবে। এল ফলে বাস্তুচ্যূত ফিলিস্তিনিরা তাদের বাড়িতে ফিরতে পারবেন।

এছাড়াও ত্রাণবাহিনী শত শত ট্রাক প্রতিদিন গাজায় প্রবেশের সুযোগ পাবে।

চুক্তির দ্বিতীয় ধাপের আলোচনায় স্থান পাবে বাকি জিম্মিদের মুক্তি এবং ‘টেকসই শান্তির’ জন্য ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি।

তৃতীয় ও চূড়ান্ত ধাপে আসবে গাজার পুনর্গঠন। এর জন্য অনকে বছর লেগৈ যেতে পারে। তবে হামাসের হাতে আর কেউ জিম্মি থাকলে তাদের মুক্তির বিষয়টিও আলোচনায় আসবে এই ধাপে।

শেখ মোহাম্মদ আল থানি বলেন, চুক্তির বিষয়গুলো চূড়ান্ত করার পর কয়েকদিনের মধ্যেই এটি সবিস্তারে জানানো হবে।

তিনি আরো জানান, কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও মিসর এই চুক্তি করার বিষয়ে সহায়তা করেছে এবং তারা ইসরায়েল ও হামাস যেন চুক্তির সব শর্ত মেনে চলে সেজন্যও তারা সচেষ্ট থাকবে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

ছবির উৎস, Reuters

প্রথমে ট্রাম্পকে ফোন নেতানিয়াহুর

যুদ্ধবিরতির খবর নিশ্চিত হওয়ার সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কাকে প্রথমে ফোন করেছিলেন সেটি খুবই লক্ষ্যণীয়।

তার কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, নেতানিয়াহু নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে কথা বলে “ইসরায়েলকে কয়েক ডজন জিম্মি এবং তাদের পরিবারের দুর্দশা দূর করতে সাহায্য করার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন”।

ওয়াশিংটনে শিগগিরই দুই নেতার দেখা হওয়ার কথা। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার একদিন পরে ২০শে জানুয়ারি ট্রাম্পের দায়িত্ব নেওয়ার কথা রয়েছে।

নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে দেয়া বিবৃতিতে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

জিম্মি চুক্তির বিষয়ে সাহায্য করার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে। এ বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে যে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বাইডেনের সাথে পরে কথা বলেছেন।

ইসরায়েলি জনগণের উচ্ছ্বাস

ছবির উৎস, Getty Images

যেভাবে এগিয়েছে আলোচনা

হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের ব্রিফিং থেকে এই চুক্তি হওয়ার পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে আরও বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়।

এতে বোঝা যায় হামাসের ওপর সামরিক চাপ ছিল যা দলটিকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছিল।

মার্কিন প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই দীর্ঘমেয়াদী চূক্তির সূচনা এবং আলোচনা প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়ার রূপরেখা বর্ণনা করেছেন।

দুর্বল হয়ে যাওয়া হামাস কীভাবে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের শাসনামলে তার মিত্রদের বন্ধুত্ব হারিয়েছে এবং ইরান ও লেবানন-ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর মুখোমুখি হয়েছে সে বিষয়টি বর্ণনা করেছেন তিনি।

হোয়াইট হাউজের এই কর্মকর্তা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফের ভূমিকারও বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, উইটকফ এই চুক্তির আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন, এ অঞ্চলে জো বাইডেনের শীর্ষ উপদেষ্টা ব্রেট ম্যাকগার্কের সাথে অংশীদার হিসাবে কাজ করেছিলেন তিনি। ব্রেটও ট্রাম্পের অধীনে কাজ করেছিলেন।

হোয়াইট হাউস এ বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী যে এই ইস্যুতে অন্তত বাইডেন এবং ট্রাম্প প্রেসিডেন্সির মধ্যে একটি নির্বিঘ্ন পরিবর্তন হবে।

চুক্তি নিয়ে ইসরায়েলি অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য

অনেক ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি চুক্তির ঘোষণার পরে আশা প্রকাশ করেছেন। তবে চুক্তির চূড়ান্ত ঘোষণা আসার আগেই ইসরায়েলের অতি ডানপন্থী অতি জাতীয়তাবাদী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ তার প্রতিক্রিয়ায় চুক্তিটিকে ‘খারাপ এবং বিপদজনক’ বলে অভিহিত করেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স এ এক পোস্টে তিনি বলেন, “ব্যাপক শক্তির সাথে যুদ্ধে ফিরে আসার সম্পূর্ণ নিশ্চয়তাই এই সরকারে আমাদের টিকে থাকার একটি পরিষ্কার শর্ত।”

বৃহস্পতিবার হামাসের সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে আলোচনা করবে ইসরায়েল সরকার। যদিও স্মোট্রিচ ও তার সহকর্মী ডানপন্থী মন্ত্রী ইতামার বেন ভির বলেছেন তারা এটির বিরোধিতা করবেন।

চুক্তি আটকে দেওয়ার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা আপাতত তাদের নেই।

যুদ্ধবিরতির খবর পেয়ে ইসরায়েলিদের উদযাপন

ছবির উৎস, Getty Images

‘শান্তিই শ্রেষ্ঠ ওষুধ’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস ঘেব্রেইসাস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স এ যুদ্ধবিরতি চুক্তির খবর জানিয়ে উদযাপন করেছেন।

তিনি বলেছেন, তার সংস্থা “সাহায্য বাড়াতে প্রস্তুত”।

“গাজা যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি মুক্তির চুক্তিকে স্বাগতম এবং এটি উৎসাহব্যঞ্জক। অনেক জীবনহানি হয়েছে এবং অনেক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা আশা করি সব পক্ষ চুক্তিকে সম্মান করবে এবং স্থায়ী শান্তির জন্য কাজ করবে,” বলেন ঘেব্রেইসাস।

“শান্তিই শ্রেষ্ঠ ওষুধ!” বলেন তিনি।

গাজায় হামলা চলছে

যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলেও গাজায় সামরিক অভিযান শেষ হয়নি।

হামাস পরিচালিত সিভিল ডিফেন্স এজেন্সি জানিয়েছে, কাতারি ঘোষণার পর আজ ইসরায়েলি বিমান হামলায় ২০ জনেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে গাজা শহরের শেখ রাদওয়ান পাড়ার একটি আবাসিক এলাকার ১২ জন রয়েছে।

তবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

রোববারের আগে যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হবে না।

স্থায়ীভাবে যুদ্ধ শেষ হবে?

বিবিসি নিউজের সাথে কথা বলেছেন হোয়াইট হাউজের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিউনিকেশন্স অ্যাডভাইজর জন কিরবি।

তিনি বলেছেন, যখন জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হবে এবং সাহায্য বিতরণ করা হবে, তখন ইসরায়েল ও হামাস তিন ধাপের যুদ্ধবিরতি চুক্তির দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা করবে।

কিরবি জানিয়েছেন, চুক্তির দ্বিতীয় ধাপ হলো, যে শর্তগুলোর বিষয়ে এখনও একমত হওয়া যায়নি। এর অংশ গবে- সম্ভবত গাজা থেকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রত্যাহার এবং স্থায়ীভাবে যুদ্ধ শেষ করা।

“দ্বিতীয় ধাপ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কারণ আপনি যদি সে পর্যন্ত যেতে পারেন, তবে এই যুদ্ধ স্থায়ীভাবে শেষ হওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে,” বলেন মি. কিরবি।

এটা করা সম্ভব কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি আমরা পারি। এটা একটা ভালো চুক্তি।”

তিনি আরও বলেন, “এর জন্য প্রয়োজন নেতৃত্ব এবং এর বাস্তবায়ন।”

জিম্মিদের মুক্তি আশা করছেন ইসরায়েলিরা

ছবির উৎস, Getty Images

‘ক্ষমা করবে না’ হামাস

হামাসের প্রধান আলোচক যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পর্কে একটি বিবৃতি দিয়েছেন।

এতে বলেছেন, যুদ্ধের সময় গাজায় দুর্ভোগের জন্য ইসরায়েলকে “মাফ করবে না” দলটি।

খলিল আল হায়া বলেছেন, “সকল ভুক্তভোগী, প্রতিটি রক্তের ফোঁটা, দুঃখ ও নিপীড়নের প্রতিটি অশ্রুর পক্ষে আমরা বলি, আমরা ভুলবো না এবং আমরা ক্ষমা করবো না। “

ইসরায়েল এ অঞ্চলে তাদের সামরিক অভিযানের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে বলেও জানান তিনি।

যুদ্ধবিরতির খবর আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে গাজায়

ছবির উৎস, Getty Images

চ্যালেঞ্জ নিয়ে সতর্কতা ইসরায়েলের

ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারযোগ যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর স্থানীয় সময় পৌনে তিনটায় একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

সরকারের প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাষণ হিসেবে তিনি জিম্মি এবং যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পর্কে এ সংবাদ সম্মেলনটি করেছেন।

হারযোগ বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তার আলোচনাকারী দলকে “এই চুক্তি চূড়ান্ত করার চেষ্টায়” সমর্থন করেছেন।

কারণ তিনি মন্ত্রিসভা এবং সরকারকে এটিকে মেনে নেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।

ইসরায়েলি মন্ত্রিসভাকে এখনও একটি ভোটে চুক্তিটিকে অনুমোদন দিতে হবে। যদিও সরকারের ডানপন্থী কিছু মন্ত্রীর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও তারা তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

তবে ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট সামনের কঠিন পথ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন ‘কোনো বিভ্রম’ হওয়া উচিত নয়।

“এই চুক্তি যখন স্বাক্ষর, অনুমোদন ও বাস্তবায়ন হবে তখন বেদনাদায়ক ও চ্যালেঞ্জিং মুহূর্তগুলো নিয়ে আসবে। এটা উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জগুলোও উপস্থাপন করবে। এটা কোনো সাধারণ পরিস্থিতি নয়। এটা আমাদের পরিচিত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি” বলেন প্রেসিডেন্ট হারযোগ।

গাজায় ইসরায়েলি হামলা বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছ এই চুক্তি

ছবির উৎস, Getty Images

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামলা চালানোর পর এই সহিংসতার শুরু। হামাস যোদ্ধারা প্রায় ১২০০ ইসরায়েলিকে হত্যা এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায়।

এরপর ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক হামলা শুরু করে। তাদের হামলায় এ পর্যন্ত ৪৬ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তির মৃত্যু হয়েছে বলে হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

তাদের ২৩ লাখ জনগোষ্ঠির বেশিরভাগই এই যুদ্ধে আশ্রয় হারিয়েছে। গাজায় খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ ও নিরাপদ আশ্রয়ের গভীর সংকট তৈরি হয়েছে।

এদিকে ইসরায়েলের দাবি, হামাসের হাতে এখনও তাদের ৯৪ জন নাগরিক জিম্মি আছেন। এদের মধ্যে ৬০ জন এখনো জীবিত এবং ৩৪ জন মৃত বলে ধারণা করা হচ্ছে।