Source : BBC NEWS

পুলিশ, র‍্যাব ও আনসারের নতুন পোশাক চূড়ান্ত

বাংলাদেশের পুলিশ, র‍্যাব ও আনসার এই তিনটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরিবর্তন করে নতুন রংয়ের পোশাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুন পোশাকের ছবি সোমবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও হাস্যরস তৈরি হয়েছে।

হাবিবাহ নাসরিন নামে একজন ফেসবুক পোস্ট লিখেছেন, ‘হলুদ হিমু, পেস্ট কালারের র‍্যাব’।

অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ র‍্যাবের কালো পোশাক নিয়ে ‘হলুদ হিমু ও কালো র‍্যাব’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন যেটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

সোমবার আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুলিশের পোশাকের রং হচ্ছে ‘আয়রন’। র‍্যাবের পোশাক হচ্ছে জলপাই বা অলিভ রংয়ের এবং আনসারের পোশাকের নতুন রং ‘গোল্ডেন হুইট’।

এই তিনটি পোশাকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হাস্যরস তৈরি হয়েছে র‍্যাবের পোশাক নিয়ে।

শরিফুল মওলা রিগান নামে একজন ফেসবুকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নতুন পোশাকের ছবি শেয়ার করে লিখেছেন- ‘র‍্যাব পুলিশের চাইতেও আনসারকে অনেক স্মার্ট দেখাচ্ছে’।

বিবিসি বাংলা এ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে র‍্যাব, পুলিশ ও আনসারে কর্মকর্তাদের সদস্যদের সাথে কথা বলেছে।

যেখানে অনেককে এটি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। তবে তারা কেউই নিজেদের নাম প্রকাশ করতে চাননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকায় কর্মরত একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “পোশাক বদল করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ বা মানসিকতা বদলানোর যায় না”।

যদিও পোশাক পরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সোমবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, মানসিকতায় পরিবর্তন আনতেই পোশাকের পরিবর্তন করা হচ্ছে।

কিন্তু পোশাক পরিবর্তন করে মানসিকতার পরিবর্তন কতটা সম্ভব? এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজি নুরুল হুদার কাছে।

মি. হুদা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “পোশাক পরিবর্তন করে আচরণগত কোন পরিবর্তন না আসার সম্ভাবনাই বেশি। আচরণগত পরিবর্তন করতে হলে নীতি ও কৌশল দরকার”।

এ নিয়ে আরো পড়তে পারেন
ছাত্র বিক্ষোভে ব্যাপক শক্তি প্রয়োগ করেছে পুলিশ

ছবির উৎস, Getty Images

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাস্যরস

সোমবার যখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় তখনই বেশ কয়েকটি রংয়ের নমুনা নিয়ে আসা হয়েছিল এই বৈঠকে। সেখান থেকে ওই তিন রংয়ের পোশাক বাছাই করা হয়।

এরপর সেই নমুনা পোশাকের ছবি নিয়ে নানা সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তখন এটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে র‍্যাবের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা বিতর্কও ছিল। বর্তমানে র‍্যাবের পোশাকটি যে রংটি করা হয়েছে তা নিয়েও অনেক হাস্যরস করতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

নতুন পোশাক দেখে মো. মহসীন মোল্লা নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘র‍্যাব হইলো পুলিশ, পুলিশ হলো গার্ড, আর আনসার হইলো চৌকিদার’।

জুলফিকার আলী নামের একজন ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “পুলিশের পোশাকটা র‍্যাব কে একটু পরিবর্তন করে দেওয়া হল। পুলিশের আচরণ র‍্যাবে স্থানান্তরিত হচ্ছে না তো? অবশ্যই বাঘের চামড়া গরুর গায়ে লাগালে সেতো আর বাঘ হবে না। পরিবর্তন করতে হবে সবাইকে মনোভাব”।

সোমবার তিনটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই পোশাক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক ধরনের হাস্যকর ভিডিও বানিয়ে পোস্ট করতে দেখা গেছে।

সেখানে কেউ কেউ বলছেন, বিগত সরকারের সময় র‍্যাব পুলিশ কিংবা আনসারের কর্মকাণ্ড নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ছিল। রং পাল্টে এই তিনটি বাহিনীকে মূলত শাস্তি দেয়া হয়েছে বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন।

বিবিসি বাংলার অন্যান্য খবর:
সরকার পতনের দিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে

নতুন পোশাক নিয়ে অসন্তোষ

সোমবার আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আয়রন, রয়েল ব্লু, ডিপখাকি, ডিপ ব্লু, জলপাইসহ বেশ কয়েকটি রংয়ের পোশাকের মডেল উপস্থাপন করা হয়।

সেখান থেকে তিনটি বাহিনীর জন্য আলাদা তিনটি পোশাক চূড়ান্ত করা হয়।

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সোনালি রংয়ের শার্ট-প্যান্ট নির্ধারণ করা হয়েছে আনসারের জন্য।

আনসারের জন্য নতুন যে পোশাক নির্ধারণ করা হয়েছে সেটি নিয়ে বাহিনীটির মধ্যে তীব্র অসন্তোষ রয়েছে।

রংপুরে কর্মরত আনসারের একজন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “পুলিশ কালো প্যান্ট পেয়েছে। আনসার খাকি প্যান্ট দিয়ে বৈষম্য করা হয়েছে। কালো প্যান্ট দেয়া নি”।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুলিশের পোশাকের রং হচ্ছে ‘আয়রন’। ঢাকায় কর্মরত পুলিশের একজন পরিদর্শক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “এই ধরনের পোশাক মূলত মালয়েশিয়ায় ব্যবহার হয়ে থাকে। আগের পোশাকের চেয়ে এটি আরো খারাপ হয়েছে”।

পুলিশে কর্মরত কয়েকজন বিবিসি বাংলাকে বলেন, নতুন এই পোশাকের রং নির্ধারণের আগে তাদের সবার মতামত নেয়া হয়নি।

ঢাকার রাজারবাগে কর্মরত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদ মর্যাদার এক কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এটি নিয়ে পাবলিক ফোরামে আলোচনার মাধ্যমে আমাদের মতামত নেয়া হয়নি। তেমন কোন সার্ভে করা হয়নি”।

“পুলিশের নতুন পোশাকের রং অনেক ডিপ্রেসিং, এটি আমাদের জন্য প্রযোজ্য না”, যোগ করেন ওই কর্মকর্তা।

পোশাক পরিবর্তনের পর র‍্যাবের পোশাক নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মঙ্গলবার এ নিয়ে চট্টগ্রামের দুইজন র‍্যাব কর্মকর্তার সাথে যখন কথা হয় তারা তাদের অস্বস্তির কথা জানিয়েছেন।

পুলিশের কালো পোশাক পরিবর্তন পরে হালকা জলপাই বা অলিভ রং করা নিয়ে সমালোচনা করে সেখানকার র‍্যাবের একজন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আগে কালো পোশাক দেখে মানুষ র‍্যাবকে ভয় পাইতো। নতুন পোশাক পড়ে রাস্তায় বেরে হলে এখন মানুষ দেখে হাসবে”।

পরিবর্তিত পোশাক নিয়ে র‍্যাবের কাছ থেকে মঙ্গলবার যখন মতামত চাওয়া হয়, চট্টগ্রামে কর্মরত র‍্যাবের সবাই একবাক্যে এটি নিয়ে তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে ওই মতামতে।

অন্য একটি বাহিনী থেকে র‍্যাবে পোস্টে হয়েছে সেখানকার এক কর্মকর্তার।

বিবিসি বাংলাকে ওই র‍্যাব কর্মকর্তা বলেন, “জোর করে যদি চাপিয়েও দেয় এখন আর আফসোস ছাড়া কিছু করার নাই। এখানে সবাই বিভিন্ন বাহিনী থেকে। নিজ বাহিনীতে ফেরত গিয়ে সম্মান বাঁচাতে হবে”।

যদিও সোমবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানিয়েছেন, প্রায় ১৮ ধরনের পোশাক উপস্থাপন করা হয়েছিল বৈঠকে। সেখান থেকে পুলিশ, র‍্যাব ও আনসারের জন্য তিনটি নতুন ডিজাইনের পোশাক বাছাই করা হয়েছে।

র‍্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠায় বাহিনীটি সংস্কারের দাবি উঠেছে

ছবির উৎস, Getty Images

পোশাকে পাল্টে মনোভাব বদল সম্ভব?

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ই অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পুলিশ বাহিনী সংস্কারের দাবি ওঠে। একই সঙ্গে পুলিশের পোশাক পরিবর্তন দাবি ওঠে।

সোমবার আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বলেছিলেন, এতে এই তিন বাহিনীর মন মানসিকতায় পরিবর্তন আসবে।

পরের দিন ওই তিনটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের সাথে কথা বলে যতটুকু বোঝা গেছে এই ‘পোশাকি’ পরিবর্তনের চেয়ে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল অভ্যন্তরীণ সংস্কার।

সেটি কিভাবে হতে পারে? এমন প্রশ্নে ডিএমপির গুলশান জোনের একটি থানায় কর্মরত পুলিশের পরিদর্শক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “পোশাক পরিবর্তন করে মানসিকতায় পরিবর্তন আনা সম্ভব না”।

“এখনো ডিসি-ওসি রাজনৈতিক দলের গোলামী বন্ধ করেনি, চেয়ারের লোভে তারা আগের সরকারের সাথে যা করতো তাই করছে চেয়ার ধরে রাখার জন্য। আপনি এই পরিবর্তন পোশাক দিয়ে কিভাবে আনবেন?” প্রশ্ন রাখেন তিনি।

গত বছরের জুলাই অগাস্টের গণহত্যার পর যখন শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে তখন র‍্যাব পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ ও কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল।

ঢাকায় কর্মরত একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমাদের উচিত সেবামূলক কাজের মাধ্যমে আচরণের পরিবর্তন আনা। শুধু পোশাক পাল্টে তো পুলিশের কুকীর্তি বদলে দেয়া যাবে না”।

ঠিক একই মনোভাব পোষণ করেন বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা।

মি. হুদা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমার মতে যারা এটা করছেন তারা কী উদ্দেশ্যে এটা আমার জানা নেই। সেটা পরিষ্কার না। পোশাক পরিবর্তনের সাথে পারফরমেন্সের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পর্কে আছে কী-না সে সম্পর্কে আমার ধারণা নেই”।

বিবিসি বাংলার অন্যান্য খবর
তিনটি বাহিনীর জন্য ১৮টি পোশাকের মধ্য থেকে তিনটি পোশাক চূড়ান্ত করা হয়েছে

কীভাবে পরিবর্তন আনা হবে?

গত পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরদিন থেকে পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন দাবিতে কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দেন।

তখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন পুলিশ সদস্যদের সাথে বৈঠকও করেন।

তখন পুলিশের কেউ কেউ ইউনিফর্ম নিয়ে অস্বস্তির কথাও জানিয়েছিলেন।

গত ১১ই অগাস্ট সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন পুলিশের পোশাক ও লোগো পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন।

পোশাক বদলাতে গিয়ে বড় ধরনের টাকার চাপ যেন না পড়ে এজন্য ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করার কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।

সোমবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেয়ার পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, এই পোশাক পরিবর্তনের পেছনে মনোবল বৃদ্ধি ও দুর্নীতিরোধসহ নানান বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

নতুন পোশাক তৈরিতে বড় ধরনের অর্থের প্রয়োজন হবে কি না এমন প্রশ্ন ছিল সাংবাদিকদের।

জবাবে উপদেষ্টা মি. চৌধুরী জানিয়েছেন, নিয়মিত এসব বাহিনীর সদস্যদের নতুন পোশাক তৈরি করা হচ্ছে। সে ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে পরিবর্তিত পোশাক তৈরি হবে। এটার জন্য বাড়তি অর্থের খুব একটা দরকার হবে না।

পুলিশের সাবেক আইজি নুরুল হুদা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “পোশাক বদলে নতুন করে তিনটি বাহিনীর পোশাক তৈরি করতে গেলে রাষ্ট্রের খরচ তো কিছু বাড়বেই”।

কিন্তু এই মুহূর্তে সেটি কতখানি প্রয়োজন ছিল সেইও প্রশ্ন তিনি রেখেছেন।

মি. হুদা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এটা কতখানি জরুরি তার চেয়ে বেশি প্রশ্ন অগ্রাধিকার কি? এটা অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে না”।

অবশ্য সরকারে পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এক সাথেই নয়, ধীরে ধীরে বদল করা হবে পুলিশ ও অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক।