Source : BBC NEWS

এক ঘন্টা আগে
বাংলাদেশে মাদারীপুরে ‘বিদাত’ আখ্যায়িত করে একদল ইসলামপন্থীর একটি বটগাছ কেটে ফেলার ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে। যদিও বিশাল গাছটি সম্পূর্ণ কেটে ফেলার আগেই স্থানীয় প্রশাসন তাতে হস্তক্ষেপ করেছে।
এর আগে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে ‘ধর্মবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে পাঠাগার থেকে পাঁচটি বস্তায় করে বই তুলে নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে গিয়ে জমা দেয়ার ঘটনা নিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
আবার গত কয়েকদিন আগে কুড়িগ্রামের একজন শিক্ষকের ফেসবুক পোস্টের জের ধরে সালিশ করে তাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে- সেই ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে লাইভ করার ঘটনা ঘটেছে।
গত কয়েক মাসে ‘ধর্ম বিরোধী’ কর্মকাণ্ডের অজুহাত দিয়ে সারাদেশে নানা জায়গায় মাজারে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি ‘তৌহিদী জনতা’ কিংবা ‘বিক্ষুব্ধ মুসল্লিদের’ দাবির মুখে দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দেয়ার ঘটনাও আলোচনায় এসেছিলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ডঃ এ কে এম খাদেমুল হক বলছেন এসব ঘটনাগুলোকে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা হিসেবেই দেখা উচিত বলেই তিনি মনে করেন। কারণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর তারা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছেন এবং তাদের এসব ঘটনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে দেখা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে ইসলাম বিষয়ক লেখক ও বিশ্লেষক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ বলছেন ধর্মীয় অঙ্গনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই ‘অতি অধিকার বোধে’র এবং নিজেরাই তাৎক্ষণিকভাবে সবকিছুর সমাধান করে নেয়ার একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

বটগাছ কেটে ফেলার ঘটনা
মাদারীপুর সদর উপজেলার শিড়খাড়া ইউনিয়নে আলম মিরের কান্দি এলাকায় শতবর্ষী বটগাছ কেটে ফেলার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। গাছটির শাখা প্রশাখা অনেক কাটার পর মূল গাছটি পুরোপুরি কাটা শেষ করার আগে প্রশাসন তা বন্ধ করেছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াদিয়া শাবাব বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ঘটনার পর তারা গাছের মালিকসহ অনেকের সাথে কথা বলেছেন।
“আমরা কথা বলছি। এখানে অন্য অন্য কোনো বিষয় আছে কি-না সেটা আমরা খুঁজে বের করছি। তেমন কিছু পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে,” বলছিলেন তিনি।
এদিকে ভাইরাল হওয়া ভিডিও তে দেখা যাচ্ছে ‘মুসল্লি’ পরিচয় ধারী একদল ব্যক্তি করাত দিয়ে বিশাল বটগাছের বিভিন্ন অংশ কাটছেন। এর শাখা গুলো কেটে ফেলার পাশাপাশি মূল গাছও কিছুটা কেটে ফেলা হয়েছে বলে বলছেন ওই ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার আবুল কালাম আজাদ।
“এ গাছটি অনেক পুরনো গাছ। নদীর পাড়ে সুন্দর জায়গায়। দীর্ঘকাল ধরেই দেখছি কেউ এর ছায়ায় আশ্রয় নেয়, আবার কেউ বা মানত করে, শিন্নি দেয়। কেউ প্রার্থনা করে। কেউ লাল কাপড় বাধে। এ নিয়ে কোনদিন কারও সমস্যা হয়নি। কিন্তু এখন একদল বলছে এগুলো সব শিরক। এলাকাবাসী দেখেছে তারাই গাছ কেটেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তিনি জানিয়েছেন, গাছটি কেটে ফেলার খবর শুনে আজ বহু মানুষ সেটি দেখতে এসেছিলেন। তবে শাখা প্রশাখা কাটলেও যারা কাটার জন্য এসেছিলো তা মূল গাছটি পুরোপুরি কাটা শেষ করতে পারেনি বলেও জানিয়েছেন তিনি।
তবে গাছটি কাটার কারণ শুধু ধর্মীয় বলতে রাজি নন স্থানীয় কেউ কেউ। তারা দিয়েছেন যে গাছটি বিক্রি করতে এর মালিককে বাধ্য করার জন্য ধর্মীয় ইস্যু সামনে এনে পুরো ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে।
জানা গেছে, শতবর্ষী গাছটি নিয়ে এলাকায় বেশ কৌতূহল আছে এবং অনেকেই নিজেদের অনেক ধরনের বিশ্বাস নিয়ে নানা আচারও পালন করতো।

আরো কয়েকটি ঘটনা
টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলায় একটি পাঠাগার থেকে ‘ধর্মবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে গত ২৪শে এপ্রিল প্রায় পাঁচ বস্তা বই নিয়ে যায় একদল ব্যক্তি। পরে তারা সেই বইয়ের বস্তাগুলো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে জমা দেয়।
তখন তারা অভিযোগ করেছিলো বইগুলো ধর্মবিরোধী এবং এগুলো পড়ে যুবসমাজ ধর্মবিরোধী হচ্ছে বলে দাবি করেন তারা। এছাড়া বই তুলে নেয়ার সময় তারা পাঠাগারের সাথে জড়িতদের নাস্তিক আখ্যা দেয়।
জানা গেছে যেসব বই ওই ব্যক্তিরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলো তার মধ্যে বেশিরভাগই ছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা।
ধনবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শাহীন মাহমুদ বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন যে ঘটনার পর তারা দুই পক্ষকে নিয়ে বসে এর সমাধান করেছেন।
“সব বই পাঠাগারে ফেরত দেয়া হয়েছে। পাঠাগারের দুজন সদস্যের বিরুদ্ধে নাস্তিকতা প্রচারের অভিযোগ করা হয়েছিলো। দুই পক্ষই দুঃখ প্রকাশ করেছে। এখন আর কোন সমস্যা নেই,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
যদিও স্থানীয়রা বলছেন, কথিত তৌহিদী জনতা পরিচয়ধারী ব্যক্তিরা বেশ কিছুদিন ধরেই পাঠাগারটি উচ্ছেদের চেষ্টা করছে। যিনি এসবের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি নিজেও একটি ধর্মভিত্তিক সংগঠনের স্থানীয় পর্যায়ের একজন নেতা বলে জানা গেছে।

ছবির উৎস, ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও
এছাড়া এই মাসের শুরুতেই কুড়িগ্রামের এক উপজেলায় একটি কলেজের একজন নারী শিক্ষক পর্দা বিষয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেয়ার পর তাকে কলেজ থেকে চাকুরিচ্যুতির দাবি করে কলেজে উপস্থিত হয় একদল ব্যক্তি।
এ নিয়ে এলাকায় তুমুল উত্তেজনার পর তারাই সালিশ করে ওই শিক্ষককে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে এবং সেই ক্ষমা চাওয়ার দৃশ্য ফেসবুকে লাইভ করে।
সেখানকার ইউএনও সিব্বির আহমেদ অবশ্য বিবিসিকে বলেছেন বিষয়টি স্থানীয়ভাবে মিটমাট হয়েছে।
কিন্তু এরই মধ্যে ওই শিক্ষককে বোরকা পড়িয়ে ক্ষমা প্রার্থনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বাড়ছে?
গত বছর পাঁচই অগাস্টে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর কখনো কখনো ‘ধর্মবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে কিংবা কখনো ‘তৌহিদী জনতা বা বিক্ষুব্ধ মুসল্লির’ ব্যানারে এমন নানা ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে।
সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসের ‘অ্যাজ বাংলাদেশ রিইনভেন্টস ইটসেলফ্, ইসলামিস্ট হার্ড লাইনারস্ সি অ্যান ওপেনিং’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
এতে দেশে ইসলামি কট্টরপন্থীদের নানা তৎপরতার তথ্য বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও নারীদের প্রতি বিদ্বেষের মতো বিষয়গুলো উঠে এসেছিলো।
যদিও সরকার এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে তখন এটিকে ‘বিভ্রান্তিকর’ উল্লেখ করেছিলো। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী তখন ‘উগ্রবাদের উত্থানের’ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছিলেন। তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও বলেছিলেন যে, বাংলাদেশে উগ্রবাদের উত্থানের যে কোনো চেষ্টা প্রতিহত করবে সরকার।
তারপরেও বিক্ষুব্ধ মুসল্লি কিংবা তৌহিদী জনতার ব্যানারে দেশে নানা ঘটনা ঘটেই চলেছে এবং একটি গোষ্ঠীর এসব তৎপরতার ক্ষেত্রে সরকারও নমনীয়তা প্রদর্শন করে বলে অনেকে মনে করছেন।
বিশ্লেষক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ বলছেন, এটিকে ঠিক ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বলা যাবে না, বরং ধর্মীয় অঙ্গন থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটি ‘অতি অধিকার বোধে’র বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে।
“ধর্মীয় অঙ্গনে যারা করে তারা তৌহিদী জনতা নাম নিয়ে করছে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য ক্ষেত্রে হয়তো ভিন্ন নামে করছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তার মতে, কোনো একটা আন্দোলন নাগরিক জনতার অংশগ্রহণে সফল হলে তার একটা জের তৈরি হয় এবং সব ক্ষেত্রেই তার প্রভাব দেখা যায়।
“যেহেতু আন্দোলনের মাধ্যমে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান হয়েছে তাই তাৎক্ষণিক আন্দোলনে সবকিছু সমাধান করার একটি প্রবণতা চলছে। তারা নিজের মতো করে সমাধানের চেষ্টা করছে। আমার ধারণা তেমনি একটি পরিস্থিতি চলছে,” বলছিলেন তিনি।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ডঃ এ কে এম খাদেমুল হক বলছেন এসব ঘটনাগুলোকে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা হিসেবেই দেখা উচিত বলেই তিনি মনে করেন।
“বাংলাদেশের কিছু মানুষের মধ্যে এমন ভাবনা তৈরি হয়েছে এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের পর তারা এখন বেশী প্রকাশ্যে আসছে। আবার এমন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও দেখা যাচ্ছে না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
মি. হক বলেন এসব ঘটনা বা এগুলো যারা ঘটায় তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ধর্মপ্রাণ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই।
“যারা এগুলো করছে তারা নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করার জন্যই করছে এবং তারা কোনোভাবেই ধর্মপ্রাণ মানুষদের প্রতিনিধিত্বও করে না। সরকারের উচিত এসব তৎপরতার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া,” বলছিলেন তিনি।